৪ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা আজ, যা থাকছে সুপারিশে

সংস্কারের জন্য গঠিত চারটি কমিশন তাদের সংস্কার প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। আজ বুধবার (১৫ জানুয়রি) প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে প্রতিবেদন চারটি জমা দেবে কমিশনগুলো।
যে চারটি সংস্কার কমিশন আজ প্রতিবেদন জমা দেবে সেগুলো হলো— পুলিশ সংস্কার, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার ও সংবিধান সংস্কার কমিশন। প্রথম ধাপে গঠিত ছয় সংস্কার কমিশনের মধ্যে বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মেয়াদ ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সকাল ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত কমিশনগুলোর সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টা সঙ্গে বৈঠক করবেন। তারা এ সময় প্রতিবেদনগুলো জমা দেবেন।
প্রতিবেদন হস্তান্তরের পর সেগুলো নিয়ে আলোচনা হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানান, আলোচনার সময় কমিশনের সদস্যরা জানাবেন প্রতিবেদনগুলোতে কী কী আছে। এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা বিকেল ৩টায় সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবেদনগুলো সম্পর্কে গণমাধ্যমকে জানাবেন।
এই চারটি কমিশনের মধ্যে দুদক, পুলিশ ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল ৩ অক্টোবর। দুই দিন পর ৬ অক্টোবর গঠন করা হয়েছিল সংবিধান সংস্কার কমিশন।
সবগুলো কমিশনকেই প্রতিবেদন জমা দিতে ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। সে হিসাবে প্রথম তিনটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল ২ জানুয়ারি, সংবিধান সংস্কার কমিশনের জন্য সময়টি ছিল ৫ জানুয়ারি। পরে এক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে এসব কমিশনের জন্য প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।
এ ছাড়া বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনও গঠন হয়েছিল ৩ অক্টোবর। এর মধ্যে ২ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য মেয়াদ ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। পরে গতকাল আরেক প্রজ্ঞাপনে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মেয়াদও ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে প্রথম ছয় সংস্কার কমিশন গঠনের প্রায় দেড় মাস পর গত ১৮ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে গঠন করা হয় আরও পাঁচটি কমিশন— গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারীবিষয়ক ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। এসব কমিশনও সংস্কারের জন্য সুপারিশ রেখে প্রতিবেদন জমা দিতে ৯০ দিন, তথা ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় পাচ্ছে।
যা থাকছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে
স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন সুপারিশ থাকছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। কমিশনের সদস্যদের উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে আভাস মিলেছে, সংসদে আসন বাড়ানো, ন্যূনতম ভোটার ছাড়া নির্বাচন বাতিল, জাতীয় পরিচয়পত্রের সেবা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে রাখা, দুই কক্ষের সংসদ ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বব্যবস্থার সুপারিশ থাকছে এই কমিশনের প্রতিবেদনে।
এই কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম জানিয়েছেন, আদালতের রায়ে গণভোট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরার পথ সুগম হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে এই দুটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ থাকতে পারে। দুই কক্ষের সংসদ এবং সংখ্যানুপাতিক ভোট পদ্ধতির সুপারিশও থাকতে পারে। তবে একাধিক দিনে সংসদ নির্বাচনের সুপারিশ থাকছে না।
নির্বাচনকালীন প্রশাসনের ওপর নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের সুপারিশও থাকতে পারে প্রতিবেদনে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেন কেউ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে ন্যূনতম ভোটার ভোট না দিলে কোনো আসনের ভোট বাতিলের বিধানও থাকতে পারে। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পাঁচ বছর পর পর পর্যালোচনা করার সুপারিশও এই কমিশন রাখতে পারে তাদের প্রতিবেদনে।
যা থাকছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে
এদিকে রাষ্ট্রকাঠামো ও সরকারের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার লক্ষ্য নিয়ে বেশকিছু সুপারিশ থাকছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। থাকছে প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য নানা সুপারিশ।
বর্তমান সংবিধানের কাঠামোতে প্রধানমন্ত্রীর হাতে একচ্ছত্র নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত রয়েছে, যার বিপরীতে রাষ্ট্রপতির হাতে নির্বাহী ক্ষমতা নেই বললেই চলে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্যরা জানিয়েছেন, তাদের প্রতিবেদনে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এই দুটি পদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার সুপারিশ থাকবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরোধী দল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশও থাকবে।
ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতা এড়াতে কেউ দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না— এমন প্রস্তাবনা সাধারণ মানুষসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবনাতেও উঠে এসেছে। এমন সুপারিশ থাকতে পারে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। থাকতে পারে ক্ষমতাসীন দলের প্রধানের প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার বিধান যুক্ত করার সুপারিশ।
সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া সংবিধানের ৭০ ধারায় পরিবর্তন আনার সুপারিশও থাকতে পারে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করার বিধান যুক্ত করার সুপারিশও থাকতে পারে, যা বর্তমান সংবিধানে নেই।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেন স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারে, তাদের সে অনুযায়ী ক্ষমতায়িত করার সুপারিশও করবে সংবিধান সংস্কার কমিশন। বর্তমানে নির্বাচন কমিশন ও সরকারি কর্ম কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কর্মরত। এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ থেকে পরিচালনা পদ্ধতি যেন স্বাধীন ও স্বতন্ত্র হয়, সেটি নিশ্চিত করার সুপারিশ থাকতে পারে। পাশাপাশি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও দুদককে সাংবিধানিক কমিশন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং নতুন করে স্থানীয় সরকার কমিশন করে সেটিকেও সাংবিধানিক কমিশনের স্বীকৃতির সুপারিশ থাকছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।
সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে যেভাবে
সংস্কার কমিশনগুলো গঠনের সময়ই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এসব কমিশন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সরকার সেগুলো পর্যালোচনা করবে। এরপর রাজনৈতিক দলসহ অংশীজন ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে প্রতিবেদনগুলো নিয়ে মতবিনিময় হবে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের পথ চূড়ান্ত করা হবে।
গত ১৭ নভেম্বর সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা আশা করছি নির্ধারিত সময়ে, ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যেই সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করতে পারবে। তাদের সুপারিশ নিয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ক্রমাগতভাবে আলোচনায় বসব। সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতেই আমরা সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করব।’