ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জামায়াতের ব্যানারে নির্বাচনে অংশগ্রহণের আহ্বান\n
কেবল নির্বাচনে প্রার্থী নয়, একসময় জামায়াতের রাজনীতিতে অমুসলিম কারও যুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল না। পরে সে সুযোগ তৈরি হলেও এমন নজির বিরল। এ পরিস্থিতিতে জামায়াতের আমিরের অমুসলিমদের প্রতি দলের প্রার্থী হওয়ার আহ্বান রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহল ছড়িয়েছে। যদিও দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার রাজনীতি ডটকমকে নিশ্চিত করেছেন, আগামী জাতীয় নিবার্চনের জন্য অধিকাংশ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের যে প্রাথমিক তালিকা করা হয়েছে, তাতে কোনো অমুসলিম বা নারী প্রার্থী নেই।
মিয়া গোলাম পরওয়ার রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘আমরা অতীতে কখনো ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা হিন্দুদের অন্তর্ভুক্ত করিনি। তবে এবার অন্য ধর্মাবলম্বী কেউ যদি আগ্রহী হয়, আমরা বিবেচনা করব। আমরা নীতিগতভাবে একমত হয়েছি— আমরা যদি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, সম্ভাবনাময় মনে করি, তাহলে আমরা তাকে মনোনয়ন দিতে পারি। এ রকম একটি সিদ্ধান্ত আমরা ইন্টার্নালি (দলের ভেতরে) নিয়ে রেখেছি।’
ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য কোনো কোটাব্যবস্থা থাকবে কি না বা কত শতাংশ আসনে তাদের মনোনয়ন দিতে পারেন— এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘বলে ফেলেছি বলেই যে দলে দলে, হাজারে হাজারে প্রার্থী আসবে, এমন তো না। কতজনের আগ্রহ আছে, দেখা যাক। কেউ এলে আমরা দেখব কোন জায়গা থেকে উনি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বা সেখানে তিনি টিকতে পারবেন কি না বা তিনি সবচেয়ে পপুলার (জনপ্রিয়) কি না। এগুলো বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’
‘আমরা চিন্তা করছি যে দুই-চারজন হলেও (মনোনয়ন) একটা দিয়ে উদাহরণ তৈরি করব। জামায়াতকে মানুষ মনে করে কনজারভেটিভ, সাম্প্রদায়িক, কমিউনাল। সংখ্যালঘু এদের দ্বারা নির্যাতিত হয়, এরা সংখ্যালঘুদের সম্পদ লুট করে, দখল করে— এমন ধারণা আছে অনেকের। এই ভাষণগুলো যে অসত্য, জাতি ধীরে ধীরে তা টের পাবে,’— বলেন মিয়া গোলাম পরওয়ার।
এখন পর্যন্ত কতজন অমুসলিম আগ্রহ প্রকাশ করেছে— জানতে চাইলে জামায়াতের শীর্ষ এই নেতা বলেন, ‘তারা (অমুসলিম) আমাদের অফিসে আসছেন। আমরাও তাদের কাছে যাচ্ছি। এবার দেখছি তাদের অনেকের মধ্যে আগ্রহ তুলনামূলকভাবে (কম্প্যারেটিভলি) একটু বেশি।’
তবে জামায়াতে ইসলামে বর্তমান ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা কত, হালনাগাদ না করে তাৎক্ষণিকভাবে সে সংখ্যা জানাতে পারেননি তিনি।
বুধবারের ভিন্ন ধর্মাবলম্বী প্রীতি সমাবেশে জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সভাপতি দীনবন্ধু রায় ও মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক ধর্মীয় সংখ্যানুপাতের ভিত্তিতে সংসদে আসন বরাদ্দের প্রস্তাব দেন। জাতীয় পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা সংখ্যালঘু আইন ও সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ তাদের আট দফা দাবি জামায়াতের নির্বাচনি ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান।
এসব দাবি নিয়ে জামায়াতের অবস্থান জানতে চাইলে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘দাবিগুলো এখন আসতে শুরু করেছে। আমরা কেবল গতকাল শুনলাম। আমরা দলের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। দলীয় ফোরামে আলোচনা করে তাদের কোন দাবিগুলো আমাদের নির্বাচনি ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি সেটা চূড়ান্ত করব। এখন এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না।’
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত প্রার্থীর তালিকায় অমুসলিম কাউকে রাখা হয়নি। এখন তাদের প্রার্থী করার ঘোষণা অমুসলিমদের ভোট আকৃষ্ট করার কৌশল কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতে সেক্রেটারি বলেন, ‘এমন কথা প্রযোজ্য নয়। এখন প্রাইমারি সিলেকশন হয়েছে। আমরা এখনো তালিকা চূড়ান্ত করিনি। চূড়ান্ত করার পর যদি ভিন্ন ধর্মবলম্বীরা বাদ যায় তখন এই প্রশ্নটা প্রযোজ্য হবে।’
একসময় ধর্মভিত্তিক এই দলটির দলটির লক্ষ্য ছিল ‘আল্লাহ তা’য়ালার প্রবর্তিত আইনসমূহের ভিত্তিতে শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা করা’। তবে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সর্বশেষ সংশোধিত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য— বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং মহান আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টি অর্জন।
দলের স্থায়ী কর্মনীতিতে বলা হয়েছে, ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষের মানবিক, নৈতিক চরিত্রের সংশোধন এবং বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অনুকুলে জনমত গঠন করবে।
জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র জুড়েই বিভিন্ন স্থানে রয়েছে দলের সাংগঠনিক বিভিন্ন স্তরে থাকা নেতাকর্মীদের আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য রেখে ইমান ও আক্বিদা বজায় রাখার কথা। দলের যেকোনো স্তরে যুক্ত হতে হলে যে শপথনামা পাঠ করতে হয় তাতেও আল্লাহ তা’য়ালা ও রসুল (সা.)-এর আদেশ পালন ও আনুগত্যকে সবকিছুর ওপরে অগ্রাধিকার দিতেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে বলা হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীতে একসময় অমুসলিম সদস্য যুক্ত হওয়ার বিধানই ছিল না। পরে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অমুসলিম যে কারও জন্য জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামোতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত করা হয়। মুসলিমদের জন্য দলে যুক্ত হতে ইসলামের ইমান-আক্বিদায় শপথ নিতে হয়। অমুসলিমদের ক্ষেত্রে অবশ্য সে বিধান নেই। তাদের শপথ নিতে হয় চারটি বিষয়ে—
জামায়াতের লক্ষ্য ইসলাম ধর্ম প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করা। তাহলে জামায়তে ইসলামের লক্ষ্যের সঙ্গে ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মতাদর্শ সাংঘর্ষিক হয়ে যায় কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘অন্য ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারে ইসলাম নিশ্চয়তা দিয়েছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকে আমরা বলি, তারাও এ দেশের নাগরিক। ইসলাম ধর্ম ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের যে অধিকার দিয়েছে সেটা আমরা দেবো।’
‘তাতে আগ্রহী হয়ে যদি তারা আমাদের ভোট দেয়, তারা যদি তাদের সমর্থকদের বলে যে এই লোক (জামায়েত) ক্ষমতায় এলে আমরা ভালো থাকব, সেটা তাদের ব্যাপার। ভোট আমার প্রাথমিক উদ্দেশ্য না। আমার উদ্দেশ্য অন্য ধর্মালম্বীদের অধিকার, মানবিক মর্যাদা, সাম্য ও প্রাপ্রতা— যা সংবিধানে নিশ্চিত করেছে, সেটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই,’— বলেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামীর এমন অবস্থানকে ‘রাজনৈতিক স্টান্টবাজি’ বলেই মনে করছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক আলতাফ পারভেজ। ‘মাওলানা মওদূদীর রাষ্ট্রচিন্তা: একটি পর্যলোচনা’ নামে তিনি একটি বইও লিখেছেন। জামায়াতের রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তি মূলতই এই মওলানা মওদূদীর চিন্তা ও তাত্ত্বিক অবস্থান।
আলতাফ পারভেজ রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘নির্বাচনে এলে বিভিন্ন দল জনপ্রিয়তার জন্য বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক স্ট্যান্ড নেয়। মিডিয়ায় নিউজ হওয়া, মানুষকে খুশি করার জন্য নানা কথা বলে। এগুলো রাজনৈতিক স্টান্টবাজি। জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্যও সে রকম কিছু। জামায়াতের যে মূল তাত্ত্বিক মাওলানা মওদূদী, তিনি অমুসলিম ও নারীদের নেতৃত্ব পর্যায়ে জায়গা দেওয়াকে নিরুৎসাহিত করেছেন। তার স্পষ্ট অভিমত, জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় ইস্যুতে অমুসলিমদের মতামত নেওয়া যাবে না।’
‘জামায়াত সেক্যুলার দল নয়, ইসলামপন্থি দল। জামায়েত ইসলামী নানা ধরনের শরিয়া আইনের বাস্তবায়ন চায়। তাদের নামের সঙ্গেই ধর্মীয় পরিচিতি রয়েছে। অমুসলিমদের তারা এমপি-মন্ত্রী বানাবে, সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। শুধু রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার খোরাক হওয়ার জন্য তারা এই স্টান্টবাজি করছে,’— বলেন আলতাফ পারভেজ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ‘জামায়াতে ইসলামী: উত্থান বিপর্যয় পুনরুত্থান’ বইয়ের লেখক মহিউদ্দিন আহমদ রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘রাজনীতিতে আন্তরিকতা বলে কিছু নেই। দলের স্বার্থ হাসিল হবে কি না, লাভ হবে কি না, সেটাই মূল বিষয়। তারা (জামায়াতে ইসলামী) যদি মনে করে যে এতে তাদের দলের লাভ হবে, তাদের দলের বিস্তৃতি বাড়বে, ভোট বাড়বে, লোকজন আসবে তাহলে, সেজন্য তারা এগুলো করে। এখানে আদর্শের কোনো ব্যাপারস্যাপার নেই।’
মহিউদ্দিন আরও বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী আগেও বলত যে ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম। কিন্তু তারা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধীদলীয় জোটে গেছে। ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে তারা ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দিয়েছিল। শরিয়াহ হচ্ছে একটা মুখরোচক শব্দ। সেটা তারা ব্যবহার করে। দলের ফায়দা তাদের কাছে মুখ্য বিষয়।’
এদিকে সম্প্রতি নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ঘিরেও আলোচনায় উঠে এসেছে জামায়াতে ইসলামী। সম্প্রতি এই কমিশন সুপারিশসসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে। প্রধান উপদেষ্টা এখনই বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশও দিয়েছেন। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য ইসলামি দলগুলো ওই প্রতিবেদনের বিরোধিতা করেছে। কমিশনের সুপারিশগুলোকে ‘অগ্রহণযোগ্য ও বিতর্কিত’ অখ্যা দিয়েছে।
ওই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর ২০ এপ্রিল দলের এক বিবৃতিতে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা পবিত্র কুরআনের বিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের অস্তিত্বের ওপর একটি সুপরিকল্পিত আঘাত। এ প্রস্তাবনার মাধ্যমে দেশের ধর্মীয় ভারসাম্য, পারিবারিক কাঠামো ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।
জাতীয় নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের মনোনয়নের বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘নারীদের মনোনয়ন ও নির্বাচন করার সুযোগ আমাদের নীতিমালায় ছিল না। এখন পর্যন্ত নেই। তাদের অন্তর্ভুক্ত চাইলে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেটি রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিবেচনাধীন থাকবে।’
‘আমাদের কেন্দ্রীয় শুরা পরিষদে ১১২ জনের মতো নারী সদস্য আছেন। প্রত্যেক জেলায় নারীদের মজলিসে শুরা আছে। তবে জামায়াত নারী নেতৃত্বে বিশ্বাস করে না। দলের নীতিমালা অনুযায়ী কোনো নারী দলের আমির বা প্রধান হতে পারবেন না,’— বলেন মিয়া পরওয়ার।