বাংলাদেশি পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্ক বসাল যুক্তরাষ্ট্র\n
ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশি পণ্যের উপর ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে মার্কিন প্রশাসন। এ ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে ওয়াশিংটন নেবে ৩৭ শতাংশ শুল্ক। পাকিস্তানের পণ্যের উপরেও শুল্ক ভারতের চেয়ে বেশি। ইসলামাবাদের ক্ষেত্রে শুল্ক ৫৮ শতাংশ, যেটা ছাড় দিয়ে দাঁড়াচ্ছে ২৯ শতাংশ। একই ভাবে নতুন নিয়মে শ্রীলঙ্কার পণ্যে ৪৪ শতাংশ শুল্ক নেবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার।
ব্রিটেনকে বাদ দিলে ব্রাজ়িল, সিঙ্গাপুর, চিলি, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক ও কলম্বিয়া— এই ছ’টি দেশের ক্ষেত্রেও ছাড়যুক্ত পারস্পরিক শুল্ক ১০ শতাংশ ধার্য করেছে ট্রাম্প প্রশাসন, যা সর্বনিম্ন। আমেরিকার ‘অভিন্ন হৃদয় বন্ধু’ ইজ়রায়েলের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে শুল্ক দাঁড়িয়েছে ১৭ শতাংশ। সম পরিমাণ শুল্ক দিতে হবে ফিলিপিন্সকেও। তাইওয়ান এবং ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে এটি যথাক্রমে ৪৬ ও ৩২ শতাংশ।
দক্ষিণ কোরিয়া, তাইল্যান্ড এবং সুইৎজ়ারল্যান্ড থেকে আসা পণ্যের উপর নতুন নিয়মে ২৫, ৩৬ এবং ৩১ শতাংশ শুল্ক নেবে আমেরিকা। ৩২ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে ইন্দোনেশিয়াকে। মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়ার পণ্যে ট্রাম্প প্রশাসন নেবে ২৪ ও ৪৯ শতাংশ শুল্ক। কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রেই শুল্কের হার সর্বাধিক বলে জানা গিয়েছে।
ওয়াশিংটনের ঐতিহ্যশালী ‘শ্বেত প্রাসাদ’-এর (পড়ুন হোয়াইট হাউস) গোলাপ বাগানে নতুন শুল্ক নীতির ঘোষণা করেন ট্রাম্প। এটি চালু করার সময়ে তিনি বলেন, ‘‘অনেক দিক ধরে অন্যান্য দেশ আমাদের দুর্বল নিয়ম-কানুনের সুযোগ নিয়ে আমেরিকাকে লুট করে চলেছে। কিন্তু আর নয়। ২ এপ্রিল চিরকাল মুক্তি দিবস হিসাবে পরিচিত হয়ে থাকবে। আমরা এখন সেই দেশগুলির উপর পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করব।’’
ট্রাম্পের এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকারে গোটা এলাকা ফেটে পড়ে। ‘‘এর মাধ্যমে আমরা চাকরি, শিল্প এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলব। আমেরিকাকে ফের ধনী করাই আমাদের লক্ষ্য। এ দেশে ফের চাকরির জোয়ার আসবে’’— ছাড় যুক্ত শুল্ক নীতি ঘোষণার সময়ে বলেন ট্রাম্প।
আমেরিকার অর্থনীতিবিদ ব্রায়ান কুলটন বলেন, “মার্কিন বাণিজ্য নীতিতে শুল্ক সংক্রান্ত এই পরিবর্তন দ্রুত কার্যকর হবে। যেখানে বিশ্বব্যপী আর্থিক বৃদ্ধির হার ২.৬ শতাংশ থেকে কমে ২.৩ শতাংশ হয়েছে, সেখানে আমেরিকার মূল্যবৃদ্ধির হার কমেছে ১.৫ শতাংশ।”
সিটি রিসার্চের অনুমান, ট্রাম্প ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতিতে ভারতের সম্ভাব্য বার্ষিক লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭০০ কোটি ডলার। সবচেয়ে ক্ষতি হতে পারে গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা এবং কৃষিক্ষেত্রে। আর সেটা অনুমান করে হাত গুটিয়ে বসে নেই নয়াদিল্লি। শুল্কর হিসাব কী ভাবে মার্কিন প্রশাসন করবে, সেই সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশিকার অপেক্ষায় রয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। সূত্রের খবর, সেই অনুযায়ী লোকসান এড়াতে পরবর্তী পদক্ষেপ করবে কেন্দ্র।
সমীক্ষকেরা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক নীতিতে ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে রাসায়নিক, শঙ্কর ধাতুর তৈরি পণ্য, অলঙ্কার, ওষুধ, গাড়ি এবং খাদ্যপণ্য। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৭,৪০০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করে ভারত। এর মধ্যে মুক্তা, অন্য রত্ন এবং গয়নাই ছিল ৮৫০ কোটি ডলারের।
এ ছাড়া গত বছর ৮০০ কোটি ডলারের ওষুধ এবং ৪০০ কোটি ডলারের পেট্রোপণ্য আমেরিকায় রফতানি করে একাধিক ভারতীয় সংস্থা। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর ১১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল নয়াদিল্লি। এই অঙ্ক ছিল ভারতীয় পণ্যের উপর মার্কিন শুল্কের চেয়ে প্রায় ৮.২ শতাংশ বেশি।
অন্য দিকে, গত বছর ৪,২০০ কোটি ডলার মূল্যের সামগ্রী আমেরিকা থেকে আমদানি করেছিল ভারত। এর মধ্যে কারুশিল্পজাত পণ্য এবং যন্ত্রপাতির উপর সাত শতাংশ, জুতো এবং পরিবহণ সরঞ্জামের উপর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ এবং খাদ্যদ্রব্যের উপর ৬৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে নয়াদিল্লি। ফলে ঘরোয়া বাজারে এই সামগ্রীগুলির দাম যথেষ্টই চড়া ছিল।
নয়াদিল্লির শুল্কনীতি নিয়ে এর আগেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন। গত বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় হোয়াইট হাউস থেকে এ ব্যাপারে জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়, মার্কিন কৃষিপণ্যের উপর ‘সর্বাধিক পছন্দের দেশ’গুলি (মোস্ট ফেভার্ড নেশন্স) গড়ে পাঁচ শতাংশ শুল্ক নিয়ে থাকে। সেখানে ভারতে ওই শুল্কের পরিমাণ ৩৯ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের মোটরবাইকের উপর রয়েছে ১০০ শতাংশ শুল্ক। সেখানে ভারতীয় গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থাগুলি মাত্র ২.৪ শতাংশ শুল্ক দিয়ে আমেরিকার বাজারে বাইক বিক্রি করতে পারে।
সিটি রিসার্চের সমীক্ষকদের দাবি, ট্রাম্প প্রশাসন কৃষিপণ্যের উপর পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করলে আখেরে লোকসান হবে ভারতের। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কৃষি ও খাদ্যশস্য কম পরিমাণে রফতানি করে নয়াদিল্লি। শুল্কের পার্থক্য বেশি হওয়ার কারণেই এত দিন এতে লাভের মুখ দেখা যাচ্ছিল।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কম শুল্ক-পার্থক্যের কারণে ভারত-মার্কিন বাণিজ্যে কাপড়, চামড়া এবং কারুশিল্প বা কাঠের তৈরি পণ্যের ক্ষেত্রে ঝুঁকি তুলনামূলক ভাবে কম। বহু মার্কিন সংস্থা এই পণ্যগুলি দক্ষিণ এশিয়াতেই তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া বাজারে কম শুল্ক থাকায় সেখানে এই পণ্যগুলি বিক্রি করে বেশি লাভ করতে পারেন তাঁরা।
২০২৪ সালে দু’দেশের বাণিজ্যের বহর ছিল ১৩,০০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। এর মধ্যে ভারতের উদ্বৃত্ত ৪৫০০ কোটি। অর্থাৎ, চুক্তি কার্যকর হলে বাণিজ্যের অঙ্ক চার গুণ হতে পারে। তাতে বিপুল লাভ দেখছে রফতানি সংস্থাগুলি। বিশেষত প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা এবং বিকল্প বিদ্যুতের যন্ত্রাংশ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলির লাভ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সূত্র : আনন্দবাজার