শেয়ারবাজারে আশার আলো নিভু নিভু

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্ট সব মহল আশা করেছিল এবার শেয়ারবাজারে সুদিন ফিরে আসবে। এজন্য নতুন কমিশনও গঠন করা হয়।
কিন্তু শেয়ারবাজারে যে আশার আলো জ্বলার কথা ছিল সেভাবে তা জ্বলছে না। উল্টো কমিশনের নেয়া বেশকিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তের ফলে এখন শেয়ারবাজারে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
প্রশ্ন উঠেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব নিয়েও।
তথ্য অনুযায়ী, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশে বুধবার ২৮টি কোম্পানিকে এ ও বি ক্যাটেগরি থেকে জেড ক্যাটেগরিতে স্থানান্তর করেছে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)।
এতগুলো কোম্পানি একদিনের নোটিশে ক্যাটেগরি পরিবর্তন করে জেড ক্যাটেগরিতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্তের প্রতিফলনও দেখা গেছে শেয়ারবাজারে।
বৃহস্পতিবার ডিএসইর প্রধান সূচক ৯৭ শতাংশের বেশি কমেছে। এছাড়া বেশিরভাগ কোম্পানি শেয়ারের দর হারিয়েছে। এছাড়া শুধু গতকালেই সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন হারিয়েছে ডিএসই।
ডিএসইর তথ্য বলছে, আগে ডিএসইতে জেড ক্যাটেগরি কোম্পানির সংখ্যা ছিল ৫৬টি। নতুন করে ডিএসই আরও ২৮ কোম্পানিকে জেড ক্যাটেগরিতে পাঠায়। এতে শেয়ারবাজারে মোট জেড ক্যাটেগরির কোম্পানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৪টিতে।
তথ্য অনুযায়ী, সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে বুধবার ২৮টি কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্দেশে এ এবং বি ক্যাটেগরি থেকে জেড ক্যাটেগরিতে স্থানান্তর করে ডিএসই। এই সিদ্ধান্ত যে বিনিয়োগকারীদের মনে আতঙ্ক তৈরি করেছে তা গতকালের সূচক আর লেনদেনের চিত্র দেখলেই অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠে।
বুধবার ২৮টি কোম্পানিকে এ এবং বি ক্যাটেগরি থেকে ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে স্থানান্তর করেছে ডিএসই।
এর আগে গত ২০ মে যেকোনো কোম্পানির শেয়ার জেড ক্যাটেগরিতে স্থানান্তরে বিএসইসি নির্দেশনা জারি করে। নির্দেশনায় বেশ কিছু শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়, তার যেকোনো একটি শর্ত লঙ্ঘন করলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) ওই কোম্পানিকে জেড ক্যাটেগরিতে স্থানান্তর করতে পারবে বলে জানানো হয়।
বিএসইসির ওই নির্দেশনায় বলা হয়, তালিকাভুক্ত কোম্পানি শেষ লভ্যাংশ ঘোষণার তারিখ থেকে বা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তির তারিখ থেকে পরপর দুই বছরের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে ব্যর্থ হলে জেড ক্যাটেগরিতে স্থানান্তর করা হবে।
পাশাপাশি আইন অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করতে ব্যর্থ হলেও একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে কোনো রিট পিটিশন বা আদালতে বিচারাধীন কোনো আইনি প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ এজিএম অনুষ্ঠিত না হওয়ার ক্ষেত্রে, অর্থাৎ উপ-বিচারের বিষয় বা জোরপূর্বক ঘটনা ঘটলে জেড ক্যাটেগরিতে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২ বছর সময় পর্যন্ত বিবেচনা করা যেতে পারে।
এতে আরও বলা হয়, যদি তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংস্কার বা বিএমআরই (ভারসাম্য, আধুনিকীকরণ, পুনর্বাসন এবং সম্প্রসারণ) এর জন্য এই ধরনের কোনো সময় ব্যাতীত ন্যূনতম ছয় মাস ধরে একটানা উৎপাদনে না থাকলে জেড ক্যাটেগরিতে স্থানান্তর করা হবে।
একদিনেই বাজার মূলধন কমেছে সাড়ে ৩ হাজার কোটির বেশি।
বুধবার ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এরপর সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ডিএসইর বাজার মূলধন কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৮৫ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। এ হিসাবে একদিনে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ৩ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা।
বৃহস্পতিবার দিন শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের চেয়ে ৯৭ দশমিক ৩৭ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ৩৯৬ পয়েন্টে। ডিএসই শরিয়া সূচক ৩১ দশমিক ২৫ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ২৬১ পয়েন্টে এবং ডিএস-৩০ সূচক ৩০ দশমিক ১১ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ৬৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। ডিএসইতে মোট ৩৯৬টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে ৭২টি কোম্পানির, কমেছে ২৯৯টির এবং অপরিবর্তিত আছে ২৫টির।
এদিন মোট ৫৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছিল ৭৯৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট।
আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করছেন বিনিয়োগকারীরা
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সব জায়গায় সংস্কারের পাশাপাশি শেয়ারবাজারেও সংস্কার করা হয়। নতুন কমিশন যোগ দেয়ার পর থেকে বিনিয়োগকারীদের মনে আশার আলো জেগে উঠেছিল। তবে সেই আলো অল্প কয়েকদিনের ভেতরেই নিভু নিভু করছে।
জেড এইচ হায়দার নামে একজন বিনিয়োগকারীর বলেন, "শেখ হাসিনার বিদায়ের পর ভেবেছিলাম শেয়ারবাজার আবারও ঘুড়ে দাঁড়াবে। নতুন কমিশন গঠিত হলে বিনিয়োগকারীদের মনে আবারও আস্থা ফিরে আসবে। কিন্ত দেখা যাচ্ছে নতুন কমিশন আসার পর শেয়ারবাজারে আরো উল্টো রক্তক্ষরণ হচ্ছে। নতুন চেয়ারম্যান যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এগুলো আমাদের বিনিয়োগকারীদের আরও পেনিকড করে দিচ্ছে। আমরা কোনো ভাবেই এই কমিশনের ওপর আস্থা আনতে পারছি না।’
খন্দকার ইকবাল নামে একজন বিনিয়োগকারী বলেন, ‘এই যে এতগুলো কোম্পানিকে হুট করে জেডে পাঠিয়ে দেয়া হল, এতে যে বিনিয়োগকারীদের লোকসান হবে এর দায়ভার কে নেবে? এখানে বিনিয়োগকারীদের অপরাধটা কী? অপরাধ করে থাকলে কোম্পানি মালিকপক্ষ করেছে, শাস্তি দিলে তাদের শাস্তি দিতে পারে বা জরিমানা করতে পারে। এভাবে কোম্পানিকে ক্যাটেগরি পরিবর্তন করে দিয়ে সব দিক থেকে আটকে দিলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কী করবে? এই বাজারে বিনিয়োগ করাটাই কি আমাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ?
সুশাসনের নামে বাজার অস্থির!
পরিবর্তিত এই সময়ে নতুন কমিশনে গঠন করা হয়েছে শেয়ারবাজারের সুশাসন ফিরিয়ে আনার জন্য। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষিত করে বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনার কথা। তবে বর্তমান কমিশন যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এতে বাজারে উল্টো নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘কমিশনের নতুন চেয়ারম্যান দায়িত্বে এসে এ পর্যন্ত একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে এর বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যানসহ কমিশন সদস্যদের বাজার সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হচ্ছে। এতে বাজারে কমিশনের অদক্ষতা ফুটে উঠছে।
আর অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, একই ভুল বারবার করলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এতে বিনিয়োগকারীরা দেশের পুঁজিবাজারের ওপর আস্থা হারাবেন।
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর আমরা যেভাবে বিএসইসির সংস্কার চেয়েছিলাম, তা মোটেও হয়নি। বিএসইসিতে পুঁজিবাজার বিষয়ে অভিজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন নীতিনির্ধারক নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এখন কমিশনে যারা নীতিনির্ধারক পদে দায়িত্ব পালন করছেন, তারা নিজেদেরকে এতটাই জ্ঞানী ভাবছেন যে, আমাদের সঙ্গে কথা বলা বা মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করছে না। এই কমিশনের কাছে ভালো কিছু প্রত্যাশা করতে পারছি না।’
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশজুড়ে শ্রমিক অসন্তোষ ও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতিতে বর্তমানে শেয়ারবাজার এমনিতেই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এমন পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা অস্থির হযে শেয়ারবাজারে বড় বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে একের পর এক শাস্তি আরোপ করে চলেছে। যে কারণে চাঙ্গাভাবে থাকা শেয়ারবাজার হঠাৎ অস্থিরতায় পড়ে যায়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে ডিএসইর টানাপোড়েনের ডালপালাও ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমান কমিশন এসেই ডিএসইর সঙ্গে একটা দৃশ্যমান ব্যবধান তৈরি করে ফেলেছে। যার কারণে ডিএসইতে যারা বসে আছেন, তারা ক্রমেই বর্তমান কমিশনের পক্ষ ত্যাগ করছেন।
তারা বলছেন. অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর শেয়ারবাজার সংস্কার ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে বিএসইসি পুনর্গঠন করা হয়েছে। কিন্তু, বিএসইসির নতুন কমিশন ইতোমধ্যে যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার একটিও সঠিক হয়নি, কোনো সুফলও দেখা যায়নি। বরং কমিশনের বেশকিছু ভুল সিদ্ধান্ত বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যা দেশের শেয়ারবাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে। এমনকি, কমিশনে নিয়োগপ্রাপ্তদের দক্ষতা ও বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ফলে, শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরার পরিবর্তে বিএসইসির সঙ্গে বাজার মধ্যস্থতাকারীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন বলেন, ‘এখনই শেয়ারবাজারকে বিচার করা যাবে না। বাজারকে বিচার করতে গেলে আরও দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। নতুন কমিশন তো মাত্রই নিয়োগ পেলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে যেসব জায়গায় অন্যায়-অনিয়ম হয়েছে সেগুলোর প্রতিকার সবাই চায়। কিন্তু শেয়ারবাজার একটা স্পর্শকাতর জায়গা। ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের বিষয়ে চারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। ফলে এখানে প্রশ্ন চলে আসে। তাই এখানে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত প্রয়োজন ছিল। এসব সিদ্ধান্ত ভেবেচিন্তে নিলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হয়তো এতটা আতঙ্কিত হতো না।’