top ad image
top ad image
home iconarrow iconঅর্থের রাজনীতি

প্রশাসক নিয়োগে পোশাক খাতের অস্থিরতা কি কাটবে?

প্রশাসক নিয়োগে পোশাক খাতের অস্থিরতা কি কাটবে?
প্রায় দিনই বকেয়া বেতনের দাবি আদায়ে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকরা। ফাইল ছবি

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর গত তিন মাসে বকেয়া বেতন-ভাতা, বোনাসসহ নানা দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনে অস্থির পোশাক খাত। সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও বন্ধ হচ্ছে না এ অস্থিরতা। এবার বকেয়া বেতন পরিশোধে মালিকপক্ষের সমস্যা পেলে প্রশাসক নিয়োগের হুঁশিয়ারি দিয়েছে সরকার।

নতুন করে মন্ত্রণালয় পুনর্গঠনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় ওই হুঁশিয়ারি দেন।

তবে কোন প্রেক্ষাপটে প্রশাসক নিয়োগ করা হবে সে ব্যাখ্যা বুধবার বিবিসি বাংলাকে দিয়েছেন মি. হোসেন। বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি জানান এই মুহূর্তে বেশিরভাগ সমস্যা হচ্ছে পোশাক শ্রমিকদের বকেয়া বেতন নিয়ে। আর যেসব পোশাক কারখানা বেতন দিতে পারছে না তারা বেশিরভাগই ঋণখেলাপী। ফলে সমস্যা সমাধান করতেই এ উপায়ের কথা ভাবা হচ্ছে।

‘আইন না থাকলে প্রয়োজনে অধ্যাদেশ’

মি. হোসেন বলেন, “এই মুহূর্তে বেশিরভাগ সমস্যা হচ্ছে গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিয়ে। ওরা বেতন দিতে পারছে না পারটিকুলারলি গাজীপুরে একটা বড় কারখানার মালিক।”

এসব কারখানার কথা তুলে ধরে শ্রম উপদেষ্টা বলেন, “তাদের বেশিরভাগই ব্যাংক ডিফল্টার। এখন ব্যাঙ্কের থেকেও টাকা পাচ্ছে না। মাই ফার্স্ট পলিসি উড বি ইফ দে ক্যান নট রান এবং শ্রমিকদের তিন-চার মাস বেতন পড়ে আছে। এক্ষেত্রে ওটা বন্ধ করে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করে দেব। কারণ ব্যাংক ও ওদেরকে টাকা দিতে চায় না। কারণ তারা ঋণখেলাপী।”

প্রশাসক নিয়োগ করলে তারা কীভাবে কাজ করবে এ প্রশ্নে মি. হোসেন বলেন, “সেটা এখনো প্রক্রিয়া করিনি আমরা। আমি আমার অনুভূতিটা ব্যক্ত করলাম। নিশ্চয়ই প্রক্রিয়া হবে। না হলে কীভাবে আমরা প্রশাসক নিয়োগ করবো।”

পোশাক কারখানাগুলো যেহেতু ব্যক্তি মালিকানাধীন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সেক্ষেত্রে প্রশাসকের কর্মপ্রক্রিয়া আইনানুযায়ী নির্ধারণ করা হবে বলে জানান উপদেষ্টা।

“গার্মেন্টস বেসরকারি হলেও তিনি তো টাকা নিয়েছেন ব্যাংক থেকে। নিজের পয়সায় তো করেননি। খুব কমই আছেন যারা নিজের পয়সায় করেছে। ব্যাংকের কাছে বন্ধক আছে এগুলা। সেগুলো দেখেই, কী আইন -কানুন আছে, আইনের ভিতরেই করা হবে। আইনের বাইরে করা হবে না,” বলেন মি. হোসেন।

প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান এই উপদেষ্টা। পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সাথেও আলোচনা করা হবে বলে জানান তিনি। “আমি কয়েকটি গার্মেন্টসে যাব, শ্রমিকদের সাথে কথা বলবো। তারপরে আমি মন্ত্রণালয় থেকে বর্তমান আইন কী আছে সেটা দেখবো আর যদি পরিবর্তন করতে হয় তো পরিবর্তন করে ফেলবো।”

বিগত সরকারের সাথে বর্তমান সরকারের এখানেই পার্থক্য বলে মন্তব্য করেন মি. হোসেন। প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে এ খাতের চলমান অস্থিরতা নিরসন করা সম্ভব বলে মনে করেন এই উপদেষ্টা। কেউ যদি কোর্টে যায় সেক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানে আদালতের দ্বারস্থও হবেন বলে মন্তব্য করেন শ্রম উপদেষ্টা।

“প্রবলেম তৈরি করবেন আর প্রবলেম সলভ করতে গেলে আপনারা বলবেন যে কীভাবে করবেন? করবো, কোর্টে গেলে কোর্টে যাব। তাদের বেশিরভাগই সরকারের টাকা নিয়েছে। সেক্ষেত্রে সরকারের একটা ওনারশিপতো আছে,” বলেন মি. হোসেন।

কোন ধরনের প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক প্রয়োজন হতে পারে সে প্রশ্নে বেক্সিমকোর উদাহরণ দিয়ে মি. হোসেন বলেন, “বেক্সিমকো এতো ডিফল্ট করেছে যে বেক্সিমকো যদি একশ টাকা আর্ন করে ব্যাংক আর ওটা দিতে চায় না। বলে ওর কাছে আমি ১০ হাজার টাকা পাব। ব্যাংকের অবস্থা তো খারাপ। ব্যাংকের অবস্থা তো লোন নিতে নিতে খারাপ।”

ফলে সংকট পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেই এই উপায় ভেবেছেন উল্লেখ করে বলেন, “তো সামথিং হ্যাজ টু কাম আপ। ওই কথাই আমি বলে রাখছি। এটা এখন দেখবো যে কীভাবে করা যায়। প্রয়োজনে আইন যদি না থাকে তাহলে অর্ডিন্যান্স তৈরি করবো।”

প্রশাসক নিয়োগের বিষয়ে কারখানা মালিকরা কী ভাবছেন?

গত পাঁচই অগাস্ট দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, চট্টগ্রাম চেম্বার, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) পর্ষদ ভেঙে প্রশাসক নিয়োগ দেয় সরকার।

সেই ধারাবাহিকতায় দেশের শীর্ষ রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-তেও প্রশাসক বসায় সরকার। পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়ে গত ২০শে অক্টোবর রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেনকে প্রশাসক হিসেবে বিজিএমইএ-তে নিয়োগ দেয়া হয়।

এই সংগঠনগুলোতে মূলত শেখ হাসিনার সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, এমনকি আওয়ামী লীগের পদ-ধারী ব্যক্তিও নেতৃত্বে ছিলেন। কর্ণফুলী ইপিজেডের ‘ডেনিম এক্সপার্ট’ গার্মেন্টসের মালিক ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন রুবেলের মতে কোন প্রেক্ষাপটে সরকার প্রশাসক নিয়োগের কথা ভাবছে সেটা বিবেচ্য বিষয়।

উদাহরণ তুলে ধরে মি. রুবেল বলেন, “মনে করেন একটা গার্মেন্টসে মালিক নিরুদ্দেশ বা ঋণ দেখে চলে গেছে দেশ থেকে এমতাবস্থায় ইন্ডাস্ট্রি তো বন্ধ করা যাবে না। ইন্ডাস্ট্রি চালাইতে হবে। কারণ ওই গার্মেন্টসের সাথে এতোগুলা শ্রমিকের জীবন জড়িত এবং আরও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং ইন্ডাস্ট্রির সুনাম জড়িত।”

“ডেফিনিটলি এ ধরনের ক্ষেত্রে সরকার যদি চিন্তা করে এটা বন্ধ না করে সরকারি প্রশাসক দিয়ে বা ফাইন্যান্স করে সরকার চালাবে সেটা ভালো উদ্যোগ, সেটা হতেই পারে,” বলেন এই পোশাক শিল্প মালিক।

“কিন্তু নরমাল প্রেক্ষাপটে একটা ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে যেখানে মালিক আছে সেখানে এভাবে দিয়ে কতটুকু পজিটিভ রেজাল্ট আসবে সেখানে মালিক হিসেবে আমি সন্দেহ পোষণ করি,” যোগ করেন মি. রুবেল।

ব্যক্তি মালিকানাধীন এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে মালিকের ইচ্ছাকৃত কোন ভুল না থাকলে সংকট থেকে উদ্ধারে সরকার মনিটরিং করতে পারে বলে মন্তব্য করেন মি. রুবেল।

তিনি বলেন, “মালিক আছে কিন্তু কোনো না কোনো কারণে সে বিপদে পড়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে না করলে সেক্ষেত্রে এটাকে সাধুবাদ জানানোর কোনো কারণ দেখছি না। এটাকে সরকার সাপোর্ট দিতে পারে। নিবিড় তত্ত্বাবধানে রেখে কমিটি করে বলবে তারা দেখবে। প্রয়োজনে লোন দিয়ে হোক যেভাবে হোক সাপোর্ট দিয়ে সংকট থেকে বের করে নিয়ে আসুক।”

‘প্রশাসক নিয়োগ সাময়িক সমাধান’

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান জানান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি সাময়িক সমাধান।

মি. খান বলেন, “ফরেনসিকের ব্যাপার আছে। কেস বাই কেস ডিসিশন হবে। শেয়ার হোল্ডিং সিস্টেম থাকলে শেয়ার হোল্ডাররা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। রিস্ট্রাকচার করতে হলে সম্পদ যেটুকু আছে সেটার ভিতরে দিয়েই করতে হবে।”

তবে সরকার এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে শ্রমিকদের আস্থার জায়গা তৈরি করা জরুরি, যাতে সার্বিকভাবে পুরো পোশাক খাত বিপদে না পড়ে-এমনটাই মনে করেন করেন মি. খান।

“কারণ তৈরি পোশাক খাত একটা সংবেদনশীল খাত। যদি অল্প সংখ্যক কারখানাতেও অসুবিধা হয় তবে এটা দেশের ভাবমূর্তি এবং সার্বিকভাবে রপ্তানির ভাবমূর্তিকে প্রভাবিত করে। ফলে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে,” বলেন মি. খান।

প্রশাসক বসেছিল যেসব প্রতিষ্ঠানে

বাংলাদেশে এর আগেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সংকটের হাত থেকে তোলার জন্য প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছিল সরকারি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ। গত পাঁচই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পনের দিন পরই মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস ‘নগদ’ এ প্রশাসক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

আগামী এক বছরের জন্য ডাক বিভাগের ডিজিটাল লেনদেন সেবা ‘নগদে’ বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান দিদারকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

নগদের পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়ে এ প্রশাসককে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পদমর্যাদার আরও ছয় কর্মকর্তাকে নগদ ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসে নিয়োগ দেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তদারককারী কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যায় নগদের কর্মকর্তারা।

প্রশাসক নিয়োগের ওই সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল দেয় হাইকোর্ট। এটি এখন বিচারাধীন রয়েছে। ২০২০ সালে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সে প্রশাসক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে এরকম বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অবসায়ন চেয়ে গ্রাহকরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। সংকট সমাধানে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেড নামে এরকম আরেকটি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আদালত আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পরিচালনা বোর্ড গঠন করে দিয়েছে।

১৯৯৪ সালে রাজধানীর শাহবাগের আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেটে কয়েকটি দোকান ভাড়া নিয়ে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে যুবক।

১৮৬১ সালের সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের আওতায় আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নেয় প্রতিষ্ঠানটি এবং পরে উচ্চ সুদের বিনিময়ে আমানত সংগ্রহ ও ঋণদান কর্মসূচি চালু করে। এক তদন্তে প্রতারণামূলক কার্যক্রমসহ অবৈধ ব্যাংকিং-এর প্রমাণ পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৩ সালে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি যুবকে প্রশাসক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছিল।

r1 ad
r1 ad