দ্য হিন্দুর প্রতিবেদন
বাংলাদেশে আরও চাপে পড়বে আদানি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘুষ ও প্রতারণার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন ভারতের অন্যতম শীর্ষ ধনকুবের গৌতম আদানি ও তাঁর ব্যবসায়িক গোষ্ঠী আদানি গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তারা। এ ঘটনার পর আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে আরও চাপে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যুক্তরাষ্ট্রের আদানি ও তাঁর গ্রুপের কর্মকর্তা এমন সময় অভিযুক্ত হলো, যখন ঢাকার হাইকোর্ট আদানি গ্রুপের সঙ্গে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এই চুক্তির আওতায় ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করা হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘আদানি ও শেখ হাসিনা সরকারের মধ্যে এই জ্বালানি চুক্তি শুরু থেকেই বিতর্কিত ছিল। কারণ, এটি অন্য অনেক চুক্তির মতো টেন্ডারের মাধ্যমে হয়নি। তবুও অন্তর্বর্তী সরকার ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সংলাপ চালানোর চেষ্টা করেছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রে মামলা হওয়ার পর সংলাপের সেই সুযোগ সংকুচিত হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশ এখন আদানি গ্রুপের ওপর আরও বেশি চাপ প্রয়োগ করতে পারে মূল্য সংক্রান্ত সমঝোতার জন্য।’
জানা গেছে, ২০১৭ সালের নভেম্বরে আদানি পাওয়ার লিমিটেডের ঝাড়খণ্ড পাওয়ার প্ল্যান্টের সঙ্গে ২৫ বছরের জন্য ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সম্পূর্ণ আমদানি করা কয়লায় পরিচালিত এই পাওয়ার প্ল্যান্টটিকে ২০১৯ সালের মার্চে ভারত সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে কর ছাড় দেয়। যদিও বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তির সময় কর ছাড়ের বিষয়টি গোপন করে আদানি গ্রুপ। এ ছাড়া পায়রা, রামপাল ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা কয়লার দাম টনপ্রতি ৭৫ ও ৮০ ডলার হলেও আদানি, টনপ্রতি নিয়েছে ৯৬ ডলার দরে। পরে পিডিবি দর নিয়ে আপত্তি জানালে দাম কমাতে রাজিও হয় তারা।
আদানি পাওয়ার লিমিটেড (এপিএল) ২০২৩ সালের এপ্রিলে ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় অবস্থিত ৮০০ মেগাওয়াটের আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল থার্মাল ইউনিট (প্রথম) থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে। এর আগে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) আদানিকে মূল্য পুনর্বিবেচনার জন্য চিঠি পাঠায়। আদানি প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম ৪০০ ডলার দাবি করলেও, বিপিডিবি যুক্তি দেয় যে এটি ২৫০ ডলারের কম হওয়া উচিত। কারণ, অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য তারা এই দামেই কয়লা কিনেছে।
চলতি বছরের আগস্টে হাসিনা সরকারের পতনের পর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন জ্বালানি প্রকল্প পর্যালোচনার আওতায় আসে। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত একটি বিশেষ কমিটি এই চুক্তিগুলো খতিয়ে দেখা শুরু করে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী আদানি। দেশটির বিরোধী দলের রাজনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছেন, এই রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে উপকৃত হচ্ছেন আদানি। যদিও তিনি তা অস্বীকার করেন।
বাংলাদেশে আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো মন্তব্য করেনি। তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারি পর্যায়ের বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তি অব্যাহত থাকবে এবং কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিতে হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন নেই।
ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘প্রথমে আদানির প্রস্তাব আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল, কারণ তারা অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা এনে বাংলাদেশের চাহিদা মেটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকায় বড় পরিসরের কয়লা আমদানি কঠিন ছিল। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আদানি ভারত সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পেলেও এর সুবিধা বাংলাদেশকে দেয়নি।’
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিতর্কিত এই চুক্তি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার আদানির সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যায়। আদানি পাওয়ার বকেয়া বিল নিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিলে, বাংলাদেশ সরকার ১ হাজার ৪৫০ কোটি পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়।
বিশ্লেষকদের মতে, ঢাকার হাইকোর্টের সর্বশেষ নির্দেশনায় আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি পুনরায় খতিয়ে দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে।