নৌকা আছে, বৈঠা নেই— দড়ি টেনে নদী পার!

সারা দেশে অবকাঠামোগত নানা উন্নয়নের মধ্যেও এখনো যেন মধ্যযুগে পড়ে রয়েছে নড়াইল সদর উপজেলার মুলিয়া ইউনিয়নের মুলিয়া বাজার খেয়াঘাট। সেখানে নৌকা থাকলেও নেই মাঝি। নেই বৈঠাও। ঘাটের দুই পারের দুই খুঁটিতে বাঁধা দড়ি টেনে টেনে নৌকায় নদী পার হচ্ছেন ১৮ গ্রামের মানুষ।
দীর্ঘ দিন ধরে সেতুর দাবি থাকলেও সে দাবি পূরণ করেনি কেউ। সে কারণেই নদীর দুই পাড়ে পোঁতা বাশের খুঁটিতে দড়ি বেঁধে পারাপার হতে হচ্ছে মুলিয়া তুলারামপুর ও শেখহাটি ইউনিয়নের মানুষদের। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে চাকরিজীবীসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষকেই এই খেয়া ঘাট পার হতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নড়াইল জেলা শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মুলিয়া ইউনিয়ন।এ ইউনিয়নের মাঝ বরাবর বয়ে চলেছে কাজলা নদী, যা ইউনিয়নকে দুই ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে। প্রতিদিনের প্রয়োজনে এই নদী পার হয়ে আসা-যাওয়া করতে হয় নদীর পশ্চিম পাড়ের তিন ইউনিয়ন— শেখহাটি, তুলারামপুর ও মুলিয়ার বাসিন্দাদের।
সেতু না থাকায় এই নদীপথটুকু পাড়ি দিতে বছরের পর বছর ধরে ভোগান্তি পোহাচ্ছে মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, কৃষিপণ্য সরবরাহ, রোগী নানা-নেওয়াসহ আরও নানা কাজে এ নদীপথ পেরোনোর বিকল্পও যে নেই। স্থানীয়রা বলছেন, নির্বাচন এলেই জনপ্রতিনিধিরা নদীতে সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কারও কোনো প্রতিশ্রুতিই আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
খেয়াঘাটের মাঝি রতন বিশ্বাস বলেন, ৬০ বছর ধরে এই খেয়াঘাটে লোক পারাপার করে আসছি। নদী তো ছোট। বৈঠা লাগে না। নদীর দুপারে বাঁশ পুঁতে তার সঙ্গে দড়ি বেঁধে দিয়েই লোক পারাপার করে আসছি। নৌকা চালাতে তেমন অসুবিধা হয় না।
পানতিতা গ্রামের প্রবীণ মন্জুরোন রায় বলেন, ৯০ বছর ধরে শুনছি এখানে একটি সেতু হবে। সেতু আর হয় না, ভোগান্তিও কমে না। অনেক এমপি অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। টেন্ডার করে শুনলাম সেতু হয়ে যাবে। কিন্তু সেতুর খবর নেই। আমাদের যে কষ্ট, সেই কষ্ট রয়েই গেল।
মুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মিহির রঞ্জন বিশ্বাস বলেন, বর্ষায় যখন ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়, তখন অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের নদী পারাপার নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। দড়ি টানা এই নৌকা পারাপারে বিশেষ করে স্কুলের বাচ্চাদের অনেক কষ্ট হয়।

দৈনন্দিন প্রয়োজনে প্রতিদিন তিন ইউনিয়নের অন্তত ১৮ গ্রামের বাসিন্দাদের এই খেয়া ঘাট পারাপার হতে হয়। ছবি: রাজনীতি ডটকম
মুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী তমালিকা বিশ্বাস বলেন, প্রতিদিন চার-পাঁচবার খেয়া পার হতে হয়। এ জন্য আমাদের অনেক সমস্যা হয়। খেয়া অন্য পারে থাকলে অন্তত আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। বর্ষাকালে খেয়া ঘাট পিচ্ছিল হয়ে যায়। পারাপারে অনেক কষ্ট হয়। ফলে এখানে সেতু খুব প্রয়োজন।
জানতে চাইলে শেখহাটি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাসুম গাজী বলেন, মুলিয়া খেয়া পার হয়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ পেরোলেই জেলা শহর। খেয়া পান না হয়ে যদি তুলারামপুর কিংবা বাহিরগ্রাম হয়ে ঘুরে যেতে হয় তাহলে ১৮ কিলোমিটার পথ ঘুরতে হয়। কম সময়ে জেলা শহরে যেতে শেখহাটি ইউনিয়নের সাত গ্রামের মানুষ এ পথে চলাচল করে থাকে। নদী ওপর একটা সেতু হলে আমাদের দুর্ভোগ দূর হতো।
তুলারামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন, ইউনিয়নের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতটি গ্রামের মানুষকে কম সময়ে জেলা শহরে পৌঁছাতে হলে মুলিয়া খেয়াঘাট ছাড়া কোনো পথ নেই।
মুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রবীন্দ্রণাথ বিশ্বাস বলেন, ইউনিয়নের চার গ্রাম নদীর ওপারে থাকায় কাজলা নদী আমার ইউনিয়নের মানুষদের ভাগ করে ফেলেছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ছাড়াও মুমুর্ষু কোনো রোগী কিংবা গর্ভবতী নারীদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে নদী পারাপারে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
জানতে চাইলে নড়াইল এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ কুমার কুন্ডু বলেন, কাজলা নদীর মুলিয়া বাজার খেয়াঘাটে সাড়ে ৪০০ মিটার একটি সেতু নির্মাণে নকশা প্রস্তুতসহ রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। অর্থ বরাদ্দ পেলে আশা করছি দ্রুত এটি বাস্তবায়ন করা যাবে।