জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ও জবাবদিহিতা রেখে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কারের আহ্বান

বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ কর্তৃত্ব, জনবল, আর্থিক সামর্থ্য ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে স্থানীয় জনগণকে কার্যকরভাবে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে পারছে না। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে এ সমস্যাগুলো অত্যন্ত প্রকট। সংসদ সদস্য, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউএনও— এ ত্রিমুখী টানাপোড়েনে উপজেলা পরিষদ যথাযথভাবে কাজ করছে না। আইনে উল্লেখ থাকলেও হস্তান্তরিত কার্যক্রমগুলো এখনো উপজেলা পরিষদের কাছে যথাযথভাবে ন্যস্ত করা হয়নি।
স্থানীয় সরকার নিয়ে এক জাতীয় সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। তারা আরও বলেন, জেলা পরিষদের কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণের কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই। সার্বিক সমন্বয়ের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কেই জেলা পরিষদে পরিণত করা দরকার। আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও পৌর এলাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যরা হস্তক্ষেপ করে থাকেন। সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে ‘নগর সরকার’ গঠনের দিকে অগ্রসর হতে হবে।
বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট (এনআইএলজি) মিলনায়তনে সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের সহায়তায় ‘গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ ও জন-আকাঙ্ক্ষার আলোকে স্থানীয় সরকার সংস্কার’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপটি যৌথভাবে আয়োজন করে গভর্ন্যান্স অ্যাডভোকেসি ফোরাম ও ইউএনডিপি।
গভর্ন্যান্স অ্যাডভোকেসি ফোরামের সমন্বয়কারী ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলীর সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। ফোরামের সদস্য আমানুর রহমানের সঞ্চালনায় এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক কানিজ ফাতেমা ও গভর্ন্যান্স অ্যাডভোকেসি ফোরামের ফ্যাসিলিটেটর অনিরুদ্ধ রায়।
সংলাপে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আনোয়ারুল হক, সুইজারল্যান্ড দূতাবাস বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কর্মসূচি ব্যবস্থাপক সোহেল ইবনে আলী। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্যদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন নারী উদ্যোগ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মাশহুদা খাতুন শেফালী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম।
সভাপতির বক্তব্যে মহসিন আলী বলেন, গভর্ন্যান্স অ্যাডভোকেসি ফোরাম ২০০৭ সাল থেকে ৫০টিরও বেশি সংগঠন নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার বিষয়ে অ্যাডভোকেসি ও ক্যাম্পেইন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ২০০৭ সালে কনভেনশনের মাধ্যমে ফোরাম যে ৪০ দফা দাবিনামা উপস্থাপন করে, তার বেশির ভাগই পরবর্তী সময়ে প্রণীত আইনগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তবে স্থানীয় সরকার কমিশন কার্যকর না করা ও সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে ভূমিকা রাখার বিধানের ফলাফল ভালো হয়নি। এ ধারাবাহিকতায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার সংস্কার উদ্যোগে সহায়তা করার জন্যই ফোরামের এ প্রয়াস। স্থানীয় সরকার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ। তাই রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি সংস্কার কমিশন ও ফোরামের এসব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, গভর্ন্যান্স অ্যাডভোকেসি ফোরাম ও ইউএনডিপির এ যৌথ উদ্যোগ সংস্কার প্রক্রিয়াকে সহায়তা করছে এবং আমরা একটি চিন্তার ঐক্য দেখতে পাচ্ছি। এরই মধ্যে আমরা ২১০টি সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দিয়েছি। বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে।
তিনি বলেন, আমরা প্রস্তাব করতে যাচ্ছি— ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড সংখ্যা বাড়ানো হোক, যেটা জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৩০টি পর্যন্ত হতে পারে। পার্বত্য এলাকার জেলা পরিষদের নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে সেবা সংক্রান্ত অভিযোগ সেল গঠন করতে হবে। জেলা পর্যায়ে একটি ১০ সদস্যের অধিদপ্তর সব ধরনের নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
কমিশন জেলা পরিষদ আরও শক্তিশালী করার প্রস্তাব করেছে জানিয়ে ড. তোফায়েল বলেন, জেলার অধীনে সব সরকারি সেবা দপ্তরগুলো হস্তান্তর করতে হবে। জেলা হবে পরিকল্পনা ইউনিট, যার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে জাতীয় পরিকল্পনার। উপজেলা ও ইউনিয়ন হবে বাস্তবায়নকারী ইউনিট। সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো একই রকম হবে। আমরা যদি স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করতে পারি তাহলে ৫০ শতাংশ দুর্নীতে কমে আসবে।
মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় মোটা দাগে ছয় ধরনের সীমাবদ্ধতা বা চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো— প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীকরণ, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার অভাব ও দুর্নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, এবং জেন্ডার ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তির সীমিত সুযোগ।
এ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে যেসব সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে— ইউনিয়ন পরিষদের ৯টি ওয়ার্ড জনসংখ্যা অনুপাতে ১২টি ওয়ার্ডে উন্নীত করতে হবে; উপজেলা পরিষদে সংসদ সদস্যদের উপদেষ্টার ভূমিকা সম্বলিত বিধান বাতিল করতে হবে; সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের ভূমিকা ও দায়-দায়িত্ব সুস্পষ্ট করতে হবে; জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কে জেলা পরিষদ কার্যালয়ে রূপান্তর করতে হবে, যেখানে জেলা পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা দেবেন একজন জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা; স্থানীয় সরকার ক্যাডার সার্ভিস চালু করতে হবে।
সুপারিশে আরও বলা হয়েছে— স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় ভিত্তিতে আয়োজন ও পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে; কাছাকাছি সময়ে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে; সব স্তরে এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারী প্রতিনিধিদের সরাসরি নির্বাচনের বিধান করতে হবে।
উপস্থিত অন্যরা মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে উত্থাপিত প্রস্তাবের অনেকগুলোর সঙ্গেই একমত পোষণ করেন। ঐকমত্যে পৌঁছানো সুপারিশ ও মতামতের মধ্যে রয়েছে— দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না করা; প্রার্থীদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনা করা; চেয়ারম্যান-মেয়রদের একক ক্ষমতার চর্চা হ্রাস করা; স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্মানি বাড়ানো; দলিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা; অভিযোগ প্রতিকারব্যবস্থা কার্যকর করা ইত্যাদি।