কাজী আজহার আলী: যার জীবন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
দেখতে দেখতে পনের বছর কেটে গেল। কাজী আজহার আলী স্যার আমাদের মাঝে নেই। আজ ১৫ ডিসেম্বর তাঁর ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৯ সালের এই দিনে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। যে কজন মহান পুরুষ স্বীয় কর্মতৎপরতা, ঈর্ষণীয় ত্যাগ আর অনুপম ব্যক্তিসত্তা দিয়ে জলন্ত সূর্যের মতো ইতিহাসে নিজের অস্তিত্বের অনিবার্যতা প্রমাণ করেছেন, কাজী আজহার আলী তাদের মধ্যে অন্যতম।
ইতিহাসের কিংবদন্তি হাজি মুহম্মদ মুহসীনকে মানুষ আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তাঁর মানবহিতৈষী কাজের জন্য। গৌরী সেনের উপমা এখনো মানুষের মুখে মুখে। তাঁর নিজের অর্থসম্পদ মানুষের কল্যাণে, মানুষের প্রয়োজনে অকাতরে বিলিয়েছেন। কিন্তু আজহার আলী জীবনের সর্বস্ব মানুষ আর মানবতার জন্য শুধু বিলিয়েই দেননি, শিক্ষা, চিকিৎসা, সমাজসেবা, বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণে নতুন এক জগত গড়েছেন-যার স্রষ্টা তিনি নিজে।
বিখ্যাত ব্যক্তিদের না দেখে বা সান্নিধ্যে না এসে মানুষ কল্পনায় তাঁকে শ্রদ্ধার উন্নত আসনে দেয়। কিন্তু তাঁকে কাছ থেকে দেখার পর বা তাঁর সান্নিধ্যে থাকার পর সেই উন্নত ধারণা নিঃশেষ হয়ে যায়।
প্রত্যেক মানুষেরই দুটি রূপ থাকে-একটি মানুষকে দেখানোর জন্য, অন্যটি তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত, যা অন্য কেউ জানতে পারে না। পৃথিবীর যে কজন ক্ষণজন্ম পুরুষ নিজের দুটো রূপকেই মানুষের জন্য উম্মুক্ত করে দিয়েছেন, কাজী আজহার আলী তাঁদেরই একজন, যার ফলে তিনি পরিণত হয়েছেন সোনার মানুষে।
কাজী আজহার আলী মৌলিক মানবীয় দোষ-ত্রুটিগুলো থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করেছেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি কাউকে শত্রু ভাবেননি বা ঘৃণা করেননি। তাঁর বড় দুর্বলতা হলো তিনি বেশি ভালো মানুষ, বেশি ভদ্র ও হাসি-খুশি। ত্রুটি ছিল বেশি বিশ্বস্ত! দোষ হলো, বেশি আন্তরিক! সমস্যা হলো, ধারাবাহিকভাবে অত্যধিক পরিশ্রম করতেন! তাঁর অতিরিক্ত দোষ ছিল মানুষকে বেশি ভালোবাসতেন! স্বার্থপর মানুষের মন তুষ্ট করতেও তিনি কুন্ঠিত হতেন না। এতটাই সৎ ও সহজ সরল যে সারা পৃথিবীর বিনিময়েও দেশ, জাতির স্বার্থ ও বিবেক জলাঞ্জলি দেননি। তিনি বিত্তশালী ছিলেন, কিন্তু অপব্যয়কে পাপ মনে করতেন। ঘৃণা করতেন লোক দেখানো কাজকে।
বেশিরভাগ বিত্তশালীই অঢেল অর্থের কারণে মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেন। নৈতিকতার পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হন। অঢেল সম্পদের মালিক হয়েও পরিবর্তিত হয়নি তাঁর নীতি-নৈতিকতা। সম্পদকে যেমন শক্তি মনে করেননি, তেমনি ক্ষমতাকেও সম্পদ ভাবেননি। তিনি প্রমাণ করেছেন, অঢেল সম্পদ থাকলেও মানুষ মানুষ থাকতে পারে। প্রশস্ত রাখতে পারে হৃদয়, বিবেক রাখতে পারে শাণিত। তিনি প্রমাণ করেছেন, বিত্তবান ব্যক্তিরও মানবিক সত্তা অটুট থাকতে পারে। বিত্তের কুহেলী তমসায় হারিয়ে যায়নি তাঁর চাদর। নিজের সবকিছু মানবতার জন্য উৎসর্গ করে তিনি মানবসেবার অনিবার্য অঙ্গে পরিণত হতে সক্ষম হয়েছেন।
জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় ভ্রমণে কাটিয়েছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথ প্রশস্ত করার জন্য। বড়দের সম্মান করেছেন, ছোটদের বিলিয়েছেন অঢেল স্নেহ। হাসেননি বা কাঁদেননি নিজের জন্য। ব্যক্তিগত জীবনকে জনগণের সামনে উম্মুক্ত করে দিয়েছেন। ঘুম বর্জন করেছেন। নিজের জন্য পৃথিবীর আনন্দ-বিনোদনকে নিষিদ্ধ করেছেন। নিজের প্রশংসা শুনেও তাঁর ভেতরে কোনো ভাবান্তর পরিলক্ষিত হয়নি। অধিক ধনসম্পদ, প্রচণ্ড ক্ষমতা, প্রচুর সম্মান- এসবের যেকোনো একটি মানুষকে বিচ্যুত করতে পারে। কিন্তু এত কিছু থাকার পরও তিনি সঠিক পথে পরিচালিত হয়েছিলেন। ক্রোধ, ঘৃণা, হটকারিতা, হিংসা-দ্বেষ, শত্রুতা, স্বার্থপরতার মতো কুপ্রবৃত্তিগুলোকে তিনি স্থান দেননি।
কাজী আলী নিজের আরামআয়েশ জলাঞ্জলি দিয়ে জীবনভর শুধু মানুষের জন্য কাজ করেছেন। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও অবৈতনিক উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরী স্কুল অ্যান্ড কলেজ নিয়মিত তত্ত্বাবধান-এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নতুন নতুন পরিকল্পনা বের করা, তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিকে সবার কাছে তুলে ধরাই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। প্রায় অর্ধ শতাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি।
কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে তাঁর সবচেয়ে কাজে থাকা মানুষটিই বেশি মূল্যায়ন করতে পারেন। কারণ, তাঁর সামনে উন্মোচিত হয় সান্নিধ্য পাওয়া লোকটির বিভিন্ন দিক। ২০০৩ সাল থেকে কাজী আজহার আলী স্যারের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আমি স্যারকে দেখেছি অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা ও ভদ্র একজন মানুষ হিসেবে।
বাংলাদেশে ইউনিভার্সিটিতে আমাকে বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হয়। সাংবাদিকতা আমার জন্য নতুন নয়। কিন্তু কাজী আজহার আলী স্যারের সান্নিধ্যে এবং তাঁর দিকনির্দেশনায় আমি অনেক কিছু শিখেছি।
অনেক সময় স্যার ও আমি দুজন একত্রে চা খেতে খেতে পত্রিকা দেখে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলো চিহ্নিত করতাম। আমি যখন প্রথম বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিতে আসি, তখন এখানে এতোকিছু ছিল না। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির বর্তমান উন্নয়নের আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। এর জন্য বেশির ভাগ ধন্যবাদ স্যারেরই প্রাপ্য।
কাজী আজহার আলী স্যারের সঙ্গে কাজ করা ছিল খুবই কষ্টকর। প্রথম দিকে ভীষণ কষ্ট হতো। তিনি ক্লান্ত হতেন না। পরে তাঁর সঙ্গে কাজ করা আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়। তিনি সময়ানুবর্তী।ছিলেন। তাঁকে নির্দিষ্ট সময়েই কাজ পেতে হবে। প্রথম দিকে তাঁর আচরণ ছিল বসের মতো। আমার কাজ যখন সন্তোষজনক পেলেন, তাঁর আচরণ তখন বন্ধুসুলভ হয়ে ওঠে। এর পরও কাজে অযথা সময়ক্ষেপণ তিনি সহ্য করতেন না।
কাজী আজহার আলী স্যার সবসময় ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতেন। কারও কাছে তিনি আবেগ প্রকাশ করতেন না। তিনি আবেগতাড়িত ছিলেন না। তিনি সুন্দর রসিকতাও জানতেন। আমাদের সঙ্গে মাঝে মধ্যেরসিকতাও করতেন। তিনি এমন এক মহান মানুষ, যিনি নিজের জন্য নিজেই আলাদা ভূবন তৈরি করেছেন। প্রচন্ড কাজের চাপ ও টেনশনের মধ্যে তিনি হাসি-খুশি থাকতেন। বোঝা যেত না কী বড় ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার ভেতর।
একজন মানুষকে পরিপূর্ণ করতে যেসব গুণাবলি দরকার, তার সবকটিই তাঁর মধ্যে ছিল। অগ্রজদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, জ্ঞাণীকে সম্মান দেখানো এবং যোগ্যতার স্বীকৃতি দিতে কুন্ঠিত হতেন না। উন্নত মানসিকতা নিয়ে সুদৃঢ় লক্ষ্যের পানে এগিয়ে গেছেন ক্লান্তিহীন পরিশ্রমের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন আদর্শ সংগঠক। নির্মাণ এবং নতূন সৃষ্টির প্রতি ছিল অদম্য আগ্রহ। তিনি যেমন প্রাচীনকে মূল্য দিতেন, তেমনি আধুনিকতাকেও গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। নিজেকে ভুলে যাওয়ার কারণে জীবনের সবকিছু উজাড় করে দিতে পেরেছেন মানবতার কল্যাণে। তিনি ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক। জ্ঞানের বিকাশে এবং বিজ্ঞানের উন্নয়নে ব্যয়িত হয়েছে তাঁর সময়। মানুষের কল্যাণ চিন্তায় কাটিয়েছেন বিনিদ্র রজনী।
আপনি নিজেকে এতো হাসি-খুশি রাখেন কীভাবে? বাংলা একাডেমির বইমেলায় স্যারের সঙ্গে গাড়িতে যেতে যেতে এ প্রশ্নটি করেছিলাম। জবাবে স্যার বলেছিলেন, হাসি-খুশি থাকা নির্ভর করে চিন্তাভাবনা এবং অন্যের সঙ্গে কী ব্যবহার করা হয় তার ওপর। আমি সব সময় ভবিষ্যতের দিকে তাকাই। অতীত নিয়ে সময় নষ্ট করি না। অন্ধকার নিয়ে ভাবি না। ইতিবাচক দৃষ্টি, আলো ও কাজের কথা চিন্তা করি। সবকিছুর মধ্যে এ তিনটি খুঁজে পাই। এ জন্য অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হতে দিই না।
যে মানুষটি মানুষ আর মানবতার জন্য এত কিছু করেছেন, তার সম্পর্কে এত সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়। তিনি একজন ব্যক্তি নন, ছিলেন একজন সফল সংগঠক ও সংস্কারক। তাঁর জীবন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ক্ষণজন্মা এই মানুষটি অমর হয়ে থাকবেন তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে।
সোহেল আহসান নিপু : ডেপুটি রেজিস্ট্রার (পিআর), বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি