আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিপীড়নমূলক ভূমিকায় ফেরা বাংলাদেশের জন্য সংকটজনক: এইচআরডব্লিউ
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো দমন-পীড়ন, নির্যাতনের পুরনো চেহারায় ফিরে এসেছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটি বলছে, পুলিশ আবারও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো বাছ-বিচার ছাড়াই ফৌজদারি মামলা দায়ের করছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ যেকোনো ব্যক্তিকে যেকোনো অবস্থায় হয়রানি করার অবাধ সুযোগ পাচ্ছে।
জুলাই অভ্যুত্থান ও পরবর্তী বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এইচআরডব্লিউ মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) ৫০ পাতার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সেই পুরনো নিপীড়নমূলক ভূমিকায় ফেরা বাংলাদেশের জন্য ‘সংকটজনক’।
এদিকে পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে বিশেষায়িত ইউনিট র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানের (র্যাব) বিরুদ্ধে অসংখ্য গুম-খুন-নির্যাতনের ভয়াবহ অভিযোগ উঠলে অন্তর্বর্তী সরকার গুমবিষয়ক অনুসন্ধান কমিশন গঠন করেছিল। এরই মধ্যে ওই কমিশন র্যাব বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী র্যাবকে দ্রুত বিলুপ্ত করারও জোর দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা এইচআরডব্লিউ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দ্রুত গণহারে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গণগ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির মতো ভূমিকা থেকে সরে আসতেও আহ্বান জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ। একই সঙ্গে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে যথেচ্ছভাবে ভিন্নমত দমনে যাকে-তাকে মামলায় আসামি করা ও মোটাদাগে অভিযোগ আনার সংস্কৃতি থেকে থেকে বের হয়ে আসার কথা বলেছে সংস্থাটি।
কেউ গ্রেপ্তার হলে তাকে দ্রুত ও নিরাপদে বিচারকের সামনে হাজির করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আদালতকে ভূমিকা রাখার আহ্বান উঠে এসেছে এইচআরডব্লিউয়ের প্রতিবেদনে। সংস্থাটি বলছে, ‘গ্রেপ্তারের পর থানা ও হেফাজতে রাখা কেন্দ্রগুলোকে জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখা ও স্বাধীনভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ রাখতে হবে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সংস্কারের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও বেসামরিক সেবা, পুলিশ, সামরিক ও বিচার বিভাগসহ প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক নিরপেক্ষ ভূমিকার নিশ্চিতের ওপর জোর দিতে হবে। টেকসই সংস্কারে জাতিংঘ মানবাধিকার সংস্থাসহ (ইউএনএইচসিআর) অনান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিশেষজ্ঞ ও কারিগরি সহায়তা চাওয়া যেতে পারে।
এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক এলিন পিয়ার্স বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে গত ১৫ বছর ধরে স্বৈরাচারের রেখে যাওয়া অবস্থা থেকে দেশকে পুনরুদ্ধারের এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই সরকারের উচিত টেকসই কাঠামোগত সংস্কারের জন্য জাতিসংঘের সমর্থন তালিকাভুক্ত করা এবং অতীতের অপব্যবহার যেন কোনোভাবেই বাংলাদেশের ভবিষ্যতের নীলনকশা হয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা।
‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি দ্রুত ও কাঠামোগত সংস্কার না করতে পারে, তাহলে বহু প্রাণের বিনিময়ে কষ্টার্জিত এ অগ্রগতি সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যেতে পারে এবং একই সঙ্গে ভবিষ্যতের সরকারকে যেকোনো দমন-পীড়নমূলক ভূমিকা নেওয়ার পথ সহজ করে দেবে,’— বলেন এলিন পিয়ার্স।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এসব সংস্কারের জন্য সর্বোচ্চ এক বছর সময় রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত জরুরিভাবে সরকারকে সহায়তা ও কারিগরি সহযোগিতা দেওয়া, যেন নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর জন্য প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করা যায় এবং সরকার এই পদ্ধতিগত সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে।
বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগের আমলে বাকস্বাধীনতা দমন করতে নিবর্তনমূলক আইনটি করা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ওই আইনের পরিবর্তে একটি নতুন অধ্যাদেশ জারি করেছে। দুর্ভাগ্যবশত, নতুন অধ্যাদেশে আগের আইনের মতোই অনেকগুলো ক্ষতিকর ধারা-উপধারা রাখা হয়েছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র নেতৃত্ব ও কর্মীরা উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশি-বিদেশি বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থ দ্বারা বেষ্টিত। অনেকেই উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, সংস্কারের গতি দৃশ্যমানভাবে কমে গেছে।
গণমাধ্যম কর্মীরা এখনো নিবর্তনের শিকার হচ্ছেন উল্লেখ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, অধ্যাপক ইউনূস তার প্রশাসনকে বাকস্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার ওপর জোর দিতে বলেছেন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে কর্তৃপক্ষ আগের সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মনে করা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। নভেম্বর পর্যন্ত সরকার জুলাই অভ্যুত্থানে বিতর্কিত ভূমিকা রাখার অভিযোগে কমপক্ষে ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার মামলা দায়ের করেছে। সরকারি দপ্তরগুলোতে সংবাদ সংগ্রহের জন্য দেড় শতাধিক সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে। এ ছাড়া জাতীয় পতাকা অবমাননার জন্য পুলিশ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাও করেছে।
এর বাইরে শেখ হাসিনাবিরোধী অভ্যুত্থানে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহিংস আক্রমণকে নজিরবিহীন বলে প্রতিবেদনে গা শিউরে ওঠা কিছু বর্ণনাও তুলে ধরা হয়েছে।
এক পুলিশ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘হাসিনা সরকার নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করে নির্বিচারে জনতার ওপর টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ও তাজা বুলেট ব্যবহার করেছিল। সরাসরি শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়েছিল। আমি পুলিশ সদস্যদের আন্দোলনকারীদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোতে গুলি চালাতে দেখেছি... অনেক ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের জীবন হুমকির মুখে না থাকলেও আমি সরাসরি গুলি চালাতে দেখেছি।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আরেক পুলিশ কর্মকর্তা বর্ণনা করেছেন যে ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরাসরি সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মাঠে থাকা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বিক্ষোভকারীদের গুলি করার নির্দেশ দেন, যেন ‘তারা ভিডিও গেমে কাউকে গুলি করার নির্দেশ দিচ্ছেন।’
এমকি নিরপরাধ পথচারী ও আশপাশের ভবন থেকে নির্বিচারে গুলি চালানোর ঘটনা দেখতে থাকা মানুষদেরও নিরাপত্তা বাহিনী আক্রমণ করেছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, ‘মানুষের মধ্যে ভয় তৈরি করা ও চারপাশে কী ঘটছে তা যেন না দেখতে পারে, এমন বার্তা দিতে পুলিশ বাড়ির জানালায় অবস্থানরত মানুষজনদের ওপরও গুলি চালায়।’ পুলিশ কর্মকর্তারা বিক্ষোভ চলাকালীন প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের জন্য সুস্পষ্ট ও অন্তর্নিহিত উভয় নির্দেশ পেয়েছিলেন বলে বর্ণনা করেছেন।
একজন কর্মকর্তা ব্যাখ্যা করে বলেন, “ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের কঠোর হতে ও ‘অরাজকতা’ ছড়ানো কোনো অপরাধীকে রেহাই না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তারা স্পষ্টভাবে ‘গুলি করো’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তবে তাদের নির্দেশ ছিল স্পষ্ট— ‘সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করুন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যা প্রয়োজন মনে করেন তা করুন। কঠোর অবস্থান গ্রহণ করুন।’”