মব সৃষ্টি ও গণপিটুনির ঘটনা থামছে না

আবার শুরু হয়েছে গণপিটুনি। পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, অপরাধীদের ধরে বেদম প্রহার করে ঝুলিয়েও রাখা হচ্ছে। পুলিশের ওপরও চলছে মব-হামলা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া ব্যক্তিদের বিচার হওয়া দরকার।
পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার (৪ মার্চ) সতর্কতা জারি করে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘মবের প্রতিটি ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘মব তৈরি' করে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা আউটার রিং রোডে চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইউসুফ আলীর ওপর হামলা করা হয়। হামলাকারীরা তার মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ এবং ওয়াকিটকি ছিনিয়ে নেয়। খবর পেয়ে সৈকত এলাকায় টহলরত পতেঙ্গা থানা পুলিশের একটি দল ও আশপাশের লোকজন গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। মব তৈরি করে পুলিশের ওপর হামলা চালানোর ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ১২ জনকে আটক করা হয়েছে।
চট্টগ্রামে মব সৃষ্টি করে হামলার আরেকটি ঘটনা ঘটেছে সোমবার রাতে। সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকার সেই ঘটনায় মসজিদের মাইকে ‘ডাকাত ঢুকেছে’ বলে মব তৈরি করে দুই যুবককে গণপিটুনি দেওয়া হয়। পিটুনিতে গুরুতর আহত দুই যুবক পরে মারা যান। হামলার সময় ওই যুবকদের গুলিতে স্থানীয় চার বাসিন্দা আহত হয়েছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, আটটি গুলির খোসা এবং একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা জব্দ করেছে।
তবে সম্প্রতি গণপিটুনির সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছে শরীয়তপুরে। সেখানে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন। পুলিশ জানায়, ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে মাদারীপুরের রাজারচর এলাকায় বাল্কহেডে ডাকাতির চেষ্টা করে ডাকাতরা। স্থানীয়রা তাদের ধাওয়া করে। ডাকাতরা শরীয়তপুরের তেঁতুলিয়া এলাকায় গেলে স্থানীয়রা নদীতে বাল্কহেড দিয়ে তাদের গতিপথ রোধ করে। এ সময় ডাকাতরা হাতবোমা ও এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়লে গুলিতে আহত হন চারজন। পরে ডাকাতরা স্পিডবোট ফেলে পালানোর চেষ্টা করলে সাতজনকে আটক করে গণপিটুনি দেওয়া হয়। ওই সাতজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর চারজন মারা যায়। পরে আরেকজনের লাশ নদীতে ভেসে ওঠে।
এর আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীতেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। উত্তরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে পায়ে দঁড়ি বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। উত্তরার হাউজ বিল্ডিংয়ের বিএনএস সেন্টারের সামনে ফুটওভার ব্রিজের ওপরে এ ঘটনা ঘটে। পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ ওই দুই ব্যক্তিকে উদ্ধার করে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে যায়। এখন তারা সুস্থ আছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এক দিন আগে ঢাকার পাশে টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশের দাবি, এক ব্যক্তির মেবাইল ফোন ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার সময় জনতা তাকে আটক করে গণপিটুনি দেয়।
ঢাকা এবং আশপাশে গত কয়েকমাসে এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। ১৫ ডিসেম্বর রাজধানীর গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার মার্কেটের সামনেও ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে অজ্ঞাতনামা এক যুবককে হত্যা করা হয়।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তথাকথিত মব জাস্টিসের নামে হামলা ও হত্যার হার অনেক বেড়ে যায়। তারই ধারাবাহিকতায় এখন আবার শুরু হয়েছে গণপিটুনিতে হত্যা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও অপরাধ বিশ্লেষক মো. তৌহিদুল হক বলেন, ‘যে ঘটনা এখন ঘটছে, তা আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতিরই বহিঃপ্রকাশ। পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা এবং অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। এটা প্রতিরোধে পুলিশও সক্রিয় নয়। তারা যেন ছেড়ে দিয়েছে। আর এই পরিস্থিতির শিকার হতে পারে নিরীহ মানুষও। সুযোগসন্ধানী এবং অপরাধীরা নানা গুজব রটিয়ে মব সৃষ্টি করে।’
তার কথা, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে অবশ্যই আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি করতে হবে। অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আর যারা মব সৃষ্টি ও গণপিটুনির ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব বলছে, গত ছয়মাসে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরধ ৫০ শতাংশ বেড়েছে। গত জানুয়ারিতে সারা দেশে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪২টি, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৯৯টি বেশি (৬৯ শতাংশ)। ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় গত ডিসেম্বরে মামলা হয়েছে ২৩০টি, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৯৫টি (৭০ শতাংশ) বেশি।
গত আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে এক হাজার ১৪৫টি, যা ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ের তুলনায় ৩৮২টি বেশি (৫০ শতাংশ)।
পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীতে জানুয়ারি মাসে ৩৬টি হত্যা ৫৪টি ছিনতাই , ১৪৬টি চুরি এবং আটটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ দাবি করছে এই সময়ে তারা ঢাকা শহর থেকে ৭১৯ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। এই পরিস্থিতিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত তিনটায় আচমকা নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন ডাকেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল(অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সেখানে দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতির আশ্বাস দেন তিনি।
গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেলের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর হামলার পর ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে যৌথ বাহিনীর অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু হয়। এই অভিযান শুরুর পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, ‘ডেভিল মানে শয়তান, এই অভিযানে শয়তানদের ধরা হবে। আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হবে।’
পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান মনে করেন, ‘পুলিশের মধ্যে এখনো অস্থিরতা কাটেনি, স্থিতিশীলতা আসেনি। তারা এখনো আত্মবিশ্বাসী নয়। তারা এখনো ব্যবস্থা নিতে দ্বিধাগ্রস্ত। তারা মনে করছে, কোনটা করতে গিয়ে তারা আবার কোন বিপদে পড়েন।’
পুলিশের সাবেক ডিআইজি বলেন, ‘পুলিশে যারা অপরাধ করেছে তাদের শাস্তি দেয়া হোক। কিন্তু যারা রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করেছেন, কোনো অপরাধ করেননি, তারা যেন কোনো শাস্তি না পান। সেটার একটা আশঙ্কা এখনো পুলিশে আছে। সেটা দূর করতে হবে। আর আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির কাজ পুলিশের, সেনাবাহিনী তাদের সহায়তা করতে পারে। এর বেশি কিছু নয়।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্র(আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, শুধু গত জানুয়ারি মাসে সারাদেশে গণপিটুনিতে ১৬ জন নিহত হয়েছেন। সংস্থাটির হিসেব আরো জানাচ্ছে, ২০২৪ সালে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২৮ জন। ২০১১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে দেশে গণপিটুনিতে প্রাণ হারান ৯৫৪ জন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান মনে করেন, ‘মানুষ তখনই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, যখন তুলে নেওয়ার সুযোগটা থাকে। এরপর আইনের শাসন ঢিলেঢালা থাকে, তখন এই ধরনের ঘটনা ঘটে। দুষ্কৃতকারীরা সক্রিয় হয়। কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।’
‘দুইদিন আগে যে ঢাকায় দুই নারীকে হেনস্তা করা হলো ( ধূমপান নিয়ে)- এটাও মব জাস্টিসের বহিঃপ্রকাশ। এটা নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে সরকারের দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে। আর তাতে এই ধরনের ঘটনা বন্ধ না হয়ে বরং আরো চলতে থাকে,’ বলেন তিনি।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘মব জাস্টিস কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার কোনো সুযোগ নাই। যদি অপরাধীও হয়, তাকে পুলিশের হাতে দিতে হবে। যারা মব জাস্টিসে জড়াচ্ছেন, তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছেন। মব জাস্টিসে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সবাইকে আমরা আইনের আওতায় আনছি।’
তার কথা, ‘পুলিশ এই মব জাস্টিস বন্ধের চেষ্টা করছে। হঠাৎ করেই মব সৃষ্টি হয়। তাই নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে। কোনো সুনাগরিক তো মব জাস্টিসে অংশ নেবেন না। কোনো অপরাধ হলে পুলিশকে খবর দিন। ৯৯৯-এ ফোন দিন। আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না,’ বলেন তিনি।