ঝিনাইদহে তিন খুনের নেপথ্যে কী?

ঝিনাইদহের শৈলকুপায় একটি বাওরের দখলদারিত্ব নিয়ে তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে বলে জেলার পুলিশ সুপারের ধারণা। তার কথা, ওই এলাকায় পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি বা জাসদ গণবাহিনীর অস্তিত্ব নাই।
তবে স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, এতদিন অন্য দলের সঙ্গে মিশে থাকলেও ৫ আগস্টের পর কোনো কোনো গ্রুপ আবার সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। আর সেখানে আধিপত্যের প্রশ্নে তিনজনকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।
যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা ওই জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার কায়েতপাড়া বাওর নিয়ন্ত্রণ করতেন। ওই বাওরের জেলেদের কাছ থেকে বছরে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা চাঁদা উঠত। ৮ বছর আগে ওই হাওড়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল নিহত হানিফের নেতৃত্বে তার বাহিনী।
পুলিশ শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কথিত সামরিক কমান্ডার হানিফ এবং তার দুই সহযোগীর লাশ উদ্ধার করে শৈলকুপা উপজেলার ত্রিবেনী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর শ্মশান ঘাট এলাকার একটি ক্যানালের পাশ থেকে। তাদের তিনজনকেই মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। লাশের পাশে দুইটি মোটরসাইকেল ও নিহতদের ব্যবহৃত হেলমেট পড়ে ছিল।
নিহত হানিফ হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামের রাহাজ উদ্দীনের ছেলে। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি হত্যা মামলা রয়েছে। আরেকজন হলেন তার শ্যালক একই উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের উম্মাদ আলীর ছেলে লিটন। অন্যজন হলেন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পিয়ারপুরের রায়সুল ইসলাম।
শৈলকুপা থানার ডিউটি অফিসার সাব ইন্সপেক্টর সম্রাট জানান, ‘তিনজনকে হত্যার ঘটনায় শনিবার পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। কোনো মামলাও হয়নি। লাশ ময়না তদন্তের জন্য হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। তাদের স্বজনদের খবর দেওয়া হয়েছে। তারা এলে মামলা হবে।’
তিনি বলেন, ‘হত্যার কারণ আমরা জানতে পারিনি। তবে এলাকাবাসী জানিয়েছে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তারা গুলির শব্দ শুনেছেন।’
এদিকে ওই তিনজনকে হত্যার পর দায় স্বীকার করে ‘জাসদ গণবাহিনীর কালু’ পরিচয় দিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে ‘এতদ্বারা ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনাবাসীর উদ্দেশ্যে জানানো যাইতেছে যে, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর শীর্ষ নেতা অসংখ্য খুন, গুম, দখলদারি, ডাকাতি, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হরিনাকুন্ডু নিবাসী মো. হানিফ তার দুই সহযোগীসহ জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন৷ তাদের লাশ রামচন্দ্রপুর ও পিয়ারপুর ক্যানালের পাশে রাখা আছে৷ অত্র অঞ্চলের হানিফের সহযোগীদের শুধরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো অন্যথায় আপনাদের একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।’ বার্তায় ‘কালু জাসদ গণবাহিনী’ এই নাম উল্লেখ করা হয়।
এলাকার বাসিন্দারা আরো জানান, তিনজনের লাশ যেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ওই একই স্থানে ২০০৩ সালের ৫ ডিসেম্বর পাঁচজনকে হত্যা করা হয়।
পুলিশ জানায়, নিহত হানিফ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। হরিণাকুণ্ডু উপজেলার কুলবাড়িয়া গ্রামের আব্দুর রহমান হত্যা মামলায় তার ফাঁসির আদেশ হয়। উচ্চ আদালতেও ফাঁসির রায় বহাল থাকলে শেখ হাসিনা সরকারের সময় প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের বিশেষ ক্ষমা নিয়ে এলাকায় ফিরে আসেন হানিফ এবং মৎস্যজীবী লীগের উপজেলা কমিটির সহ-সভাপতি নিযুক্ত হন। তিনি তার লোকজন নিয়ে কয়েতপাড়া বাওড়ের নিয়ন্ত্রণ নেন।
৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর হানিফ অন্য একটি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে ফিরে আসার চেষ্টা করেন৷ কিন্তু তার প্রতিপক্ষ কালু ভারতে পলাতক থাকলে ৫ আগস্টের পর দেশে ফিরে আসে। কালু এক সময় তার গ্রুপেরই নেতা ছিলেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ৯০-এর দশকে ঝিনাইদহ এলকায় বামপন্থী গোপন সংগঠনের প্রভাব ছিলোল। তারা সর্বহারা পার্টি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ গণবাহিনী নামে সক্রিয় ছিল। পরবর্তী সময়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে অনেকই খুন হন, কেউ গ্রেপ্তার হন আবার কেউবা দেশে-বিদেশে আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু হরিণাকুণ্ডু উপজেলার কায়েতপাড়া বাওড় নিয়ন্ত্রণ করতেন ওই দলের সদস্যরাই। তারা প্রকাশ্য রাজনীতিতে যোগ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখে। নিহত হানিফ ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল জিয়াউর রাহমান জিয়া নামে আরেকজনকে হত্যা করে বাওড়ের নিয়ন্ত্রণ নেয়। মৎস্যজীবী সমিতির নামে বাওড় নিয়ন্ত্রণ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তার আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিরই সদস্য ছিলেন৷ ১০৮ হেক্টরের ওই বাওড় ওই এলাকার মৎস্য ভান্ডার নামে পরিচিত। বছরে প্রায় ১০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয় ওই বাওড় থেকে।
তিনজনকে হত্যার দায় স্বীকার করে গণবাহিনীর যে কালু কমান্ডারের নামে বার্তা দেয়া হয়েছে তার নাম জানে এলাকাবাসী। ওই এলাকার একজন জানান, কালু অনেক আগেই ভারতে চলে যায়৷ তিনিও আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি করতেন৷ কিন্তু ৫ আগস্টের পর কালু এলাকায় ফিরে আসে৷ কালু এলাকায় নানাভাবে তার উপস্থিতির জানানও দেয়।
নিহত হানিফের আত্মীয় হরিণাকুন্ড উপজেলার জোড়াদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, ‘কালুর বাড়ি কুষ্টিয়ার আফজালপুরে। আমরা অনেক আগে থেকেই তার নাম জানি। তবে তাকে কখনো দেখিনি।’
স্থানীয় সূত্র জানায়, নানা চাপের মুখেও ওই এলাকায় শিমূলের নেতত্বে পুর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি টিকে ছিল। গত বছর ঝিনাহদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার খুন হন ভারতে। ওই হত্যকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড হিসাবে শিমুলকে তখন গ্রেপ্তার করা হয়৷ নিহত হানিফ তার সামরিক কমান্ডার ছিলো। আর কালু তার প্রতিপক্ষ গ্রুপের সদস্য হলেও দীর্ঘদিন ধরে দেশে ছিলের না।
ঝিনাদহ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি ) মোহাম্মদ মনজুর মোরশেদ জানান, ‘কালু নামে চরমপন্থি দলের একজন নেতার নাম এই এলাকায় শোনা যায়৷ তার নামে যে বার্তা দেয়া হয়েছে জাসদ গণবাহিনীর সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি৷ তবে এই এলাকায় চরমপন্থি দলের সদস্যদের উপস্থিতির ব্যাপারে পুলিশ এখনো নিশ্চিত নয়৷ অনেক আগে এখানকার গোপন সংগঠনগুলো বিনাশ হয়েছে।’
‘হানিফ নামে যিনি নিহত হয়েছেন তিনি এই এলাকার একটি বাওড় বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তারই গ্রুপে আগে যারা ছিলেন তারা এখন এটা দখলে নিতে চায়৷ তারাই হানিফসহ তিনজনকে হত্যা করেছে বলে আমরা খবর পাচ্ছি৷ আর কালু ভারতে পলাতক ছিরেন। তবে সে দেশে ফিরে এসেছে কী না আমরা নিশ্চিত নই।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাদ দিলে এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। আর এটা আমাতের ধারণায় ছিলো না। এলাকায় এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো বিরূপ পরিস্থিতি হয়নি।’
হানিফের আত্মীয় মো. জাহিদুল ইসলাম, ‘নিহত হানিফের ভাই সজেদুল ইসলাম ঈশা আগে হরিণাকুন্ড উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। আর নিহত হানিফ বাওড়েই ব্যবসা করতেন। তিনি ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে প্রকাশ্যেই ছিলেন। মৎসজীবী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।’
তার কথা, ‘আমাদের এলাকায় বহু বছর ধরে চরমপন্থিদের তৎপরতা নেইা তবে এখন আবার শুরু হলো কি না জানি না।’