না ফেরার দেশে হায়দার আকবর খান রনো
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) উপদেষ্টা হায়দার আকবর খান রনো আর নেই। শনিবার রাত ২টা ৫মিনিটে ঢাকার হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। হাসপাতালটির কাস্টমার কেয়ার থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। হায়দার আকবর খান রনোর শেষবিদায়ের আনুষ্ঠানিকতার বিষয়ে স্থান ও সময় পরে জানানো হবে।
হায়দার আকবর খান রনো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক প্রবাদ পুরুষ। তিনি ১৯৪২ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। মাতা কানিজ ফাতেমা মোহসিনা ও পিতা হাতেম আলী খান। তার একমাত্র ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ প্রয়াত হায়দার আনোয়ার খান জুনো। হায়দার আকবর খান রনো একাধারে মাঠে-ময়দানের সংগ্রামী রাজনৈতিক নেতা, একাত্তরের রণাঙ্গনের সৈনিক, তাত্ত্বিক ও লেখক।
১৯৫৮ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরী স্কুল থেকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পাস করেন। নটরডাম কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। তবে কারাবাসের কারণে তিনি অনার্স কোর্স সম্পন্ন করতে পারেননি। জেলখানায় বসে পরীক্ষা দিয়ে তিনি এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। পরে হাইকোর্টের সনদও লাভ করেছিলেন, কিন্তু কোনোদিন আইন পেশায় যাননি। বাংলা সাহিত্য ও বিশ্ব সাহিত্যে এবং একই সঙ্গে পদার্থবিদ্যার সর্বাধুনিক তত্ত্বসমূহ সম্পর্কেও তার একাধিক রচনা রয়েছে।
১৯৬১ সালে তিনি তদানীন্তন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভ করেন। পরবর্তী দীর্ঘ জীবনে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন বাঁক ও মোড়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। একই সঙ্গে ক্লাসিক্যাল মার্কবাদী সাহিত্য পাঠ করেছেন এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাত্ত্বিক অবদান রেখেছেন। ১৯৬৯ সালেই তিনি এই দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে পরিগণিত হন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১০ সালে রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে তিনি ওয়ার্কার্স পার্টি পরিত্যাগ করে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। তখন থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। বর্তমানে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা।
১৯৬২’র সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম নেতা। তিনিই প্রথম সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্য বক্তব্য রেখেছিলেন (১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬২)। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন তদানীন্তন সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রজীবন শেষে তিনি শ্রমিক আন্দোলনে যোগদান করেন এবং টঙ্গী অঞ্চলে শ্রমিক বস্তিতে বাস করে গড়ে তোলেন এক নতুন ধারার সংগ্রামী শ্রমিক আন্দোলন। ১৯৭০ সালে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানে তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক।
কমরেড রনো ছিলেন একাত্তরের রণাঙ্গনের সৈনিক। রনো ও তাঁর সহযোদ্ধাদের নেতৃত্বে গঠিত কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি দেশের অভ্যন্তরে ১৪টি আধামুক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। রনো এই সকল ঘাঁটি অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং রাজনৈতিক নির্দেশনা দিতেন। এই সংগঠনের প্রায় ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এই অঞ্চলগুলোতে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন এবং শহীদ হয়েছিলেন শতাধিক।
রনো ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং ১৯৯০ সালের গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম রূপকার। হায়দার আকবর খান রনো চারবার কারাবরণ করেছেন, সাতবার হুলিয়ার কারণে তাকে আত্মগোপনে যেতে হয়েছে। আইয়ুব আমল ও এরশাদ আমল- এই দুই আমল মিলিয়ে তার বাসায় মিলিটালি ও পুলিশ রেইড করেছে অর্ধশতাধিকবার। রনোর একমাত্র কন্যার নাম রানা সুলতানা। দুই নাতি; নাম- অরিত্র ও অন্তিক।
সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তিনি মার্কসবাদ, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি, সাহিত্য ও বিজ্ঞান (পদার্থবিদ্যা) সংক্রান্ত বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন ও অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন। ২০২২ সালে তিনি বাংলা একাডেমী কর্তৃক সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ২৪ বছর বয়সে তিনি প্রথম যে বইটি লেখেন তার নাম সাম্রাজ্যবাদের রূপরেখা। এই বইটিই ছিল পাকিস্তান আমলে মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্রাজবাদ সংক্রান্ত বিশ্লেষণমূলক প্রথম তাত্ত্বিক গ্রন্থ। তার মোট গ্রন্থের সংখ্যা ২৫।