top ad image
top ad image
home iconarrow iconখবরাখবর

জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমী: আধ্যাত্মিকতার চিরন্তন কবি

জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমী: আধ্যাত্মিকতার চিরন্তন কবি
লেখক আমজাদ হোসাইন। ফাইল ছবি

মাওলানা জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমী (রহ.)। বিশ্বব্যাপী পরিচিত একজন দরবেশ, সুফি কবি, দার্শনিক এবং আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক। তাঁর জীবন, সাহিত্য এবং দর্শনের প্রতিটি স্তর আজও মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। মাওলানা রুমীর কর্ম এবং দর্শন শুধু তাঁর সময়কালে নয়, বর্তমান যুগেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি ছিলেন প্রেম, ঐক্য এবং মানবতার এমন এক দূত, যাঁর দর্শন ধর্ম, জাতি এবং সংস্কৃতির সব সীমারেখাকে অতিক্রম করে। এই নিবন্ধে আমরা তাঁর জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং তাঁর কাজের গভীর তাৎপর্য তুলে ধরব, যেখানে অজানা গল্প এবং তাঁর অবিনশ্বর কীর্তি পাঠককে নতুন করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করবে।

শৈশবের বিস্ময়: আধ্যাত্মিকতার বীজ রোপণ

১২০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বর্তমান আফগানিস্তানের বলখ শহরে জন্মগ্রহণ করেন মাওলানা রুমী। তাঁর পিতা বাহা উদ্দিন ওয়ালাদ ছিলেন একজন অসাধারণ খ্যাতিসম্পন্ন আলেম এবং সুফি সাধক। বাহা উদ্দিনকে তাঁর সময়ের ‘সুলতান-উল-উলামা’ বলা হতো। শৈশব থেকেই মাওলানা রুমী তাঁর পিতার সোহবত ও ছায়ায় বড় হন, যেখান থেকে তিনি আধ্যাত্মিকতা এবং জ্ঞানের প্রথম পাঠ গ্রহণ করেন।

শোনা যায়, শৈশবেই মাওলানা রুমীর মধ্যে অসাধারণ প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি পুরো কোরআন মুখস্থ করেন এবং এর ব্যাখ্যায় তাঁর পিতাকে সাহায্য করতে শুরু করেন। একটি কিংবদন্তি আছে। একদিন মাওলানা রুমী একটি বাগানে হাঁটছিলেন। তখন একটি পাখি এসে তাঁর কাঁধে বসে এবং এক অনন্য সুরে গান গাইতে শুরু করে। স্থানীয় লোকেরা এটিকে আধ্যাত্মিকতার একটি আলামত হিসেবে দেখেন এবং বিশ্বাস করেন। বলা হয় মাওলানা রুমী বিশেষ উদ্দেশ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন।

পরিবারের প্রস্থান: জ্ঞানার্জনের পথে দীর্ঘ যাত্রায় এক শ্রেণির নামধারী আলেমদের আক্রমণের হুমকির কারণে বাহা উদ্দিন পরিবার নিয়ে বলখ ত্যাগ করেন। এই ভ্রমণ শুধু এক স্থান থেকে আরেক স্থানে গমন ছিল না; এটি ছিল জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

তুরস্কের দিকে যাত্রার পথে তাঁদের পরিবার ইরানের নিশাপুর শহরে অবস্থান করেন। নিশাপুরে মাওলানা রুমীর সাক্ষাৎ হয় বিশিষ্ট দরবেশ ও সুফি কবি ফরিদ উদ্দিন আত্তারের সঙ্গে। আত্তার তাঁকে একটি বই উপহার দেন, যার নাম “আসরারনামা” (রহস্যের গ্রন্থ)। এই বইটি মাওলানা রুমীর আধ্যাত্মিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। আত্তার তখন বলেছিলেন, ‘এই শিশু একদিন বিশ্বকে আলোকিত করবে।’

বাগদাদ, দামেস্ক এবং মক্কা সফরের সময় মাওলানা রুমী অনেক সুফি সাধক, দরবেশ এবং ইসলামিক পণ্ডিতের সঙ্গে দেখা করেন। দামেস্কে থাকাকালে তিনি শেখ ইবনে আরাবির বক্তৃতায় অংশ নেন। ইবনে আরাবি তখন মন্তব্য করেন, ‘তোমার পথ আলাদা, কিন্তু তুমি একদিন আধ্যাত্মিকতার নতুন অধ্যায় শুরু করবে।’

কৌনিয়ায় স্থায়ী জীবন এবং নতুন অধ্যায়

দীর্ঘ যাত্রার পর, মাওলানা রুমীর পরিবার তুরস্কের আনাতোলিয়ার কৌনিয়ায় স্থায়ী হয়। এটি ছিল সেই সময়ের শিক্ষার কেন্দ্র। কৌনিয়া আসার পর রুমী নিজের একটি খানকা স্থাপন করেন এবং সেখান থেকে ইসলামিক আইন, ধর্মতত্ত্ব, সুফিবাদ অর্থাৎ শরীয়ত ও মারেফত শিক্ষা দিতে শুরু করেন।

এই সময় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও সমৃদ্ধ হতে থাকে। তিনি গওহর খাতুনকে বিয়ে করেন এবং দাম্পত্যজীবনেও সুখী ছিলেন। তাঁদের সন্তানরা পরবর্তীতে রুমীর শিক্ষা এবং দর্শন প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

পীর শামস তাবরিয: আধ্যাত্মিক বিপ্লবের সূচনা মাওলানা রুমীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং রহস্যময় অধ্যায় শুরু হয় ১২৪৪ সালে, যখন তিনি শামস তাবরিযের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। শামস ছিলেন এক আধ্যাত্মিক দিকপাল, যাঁর জীবনযাপন ছিল সম্পূর্ণরূপে দুনিয়া থেকে উদাসীন। তিনি কাশফ অর্থাৎ আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। শামস তাবরিযের সোহবত পেয়ে মাওলানা রুমী আধ্যাত্মিক-জগতের রাজকীয় সিংহাসন লাভ করেছিলেন।

তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ নিয়েও অনেক গল্প প্রচলিত আছে। একটি গল্প অনুযায়ী, শামস মাওলানা  রুমীর সামনে একটি ধ্রুপদী বই ছুঁড়ে ফেলে দেন এবং বলেন,

‘আল্লাহর প্রেম সম্পর্কে যা কিছু জানার আছে, তা এই বইয়ে সীমাবদ্ধ নয়।’ এই কথাগুলি মাওলানা রুমীর মনে গভীর দাগ কাটে। শামস তাঁকে শেখান যে, আসল জ্ঞান আসে আত্মার গভীর উপলব্ধি থেকে।

শামসের সান্নিধ্যে মাওলানা রুমী সাংসারিক  চৌহদ্দি ছেড়ে সম্পূর্ণভাবে আধ্যাত্মিক জীবনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তাঁর শিষ্যরা তখন উদ্বিগ্ন হন এবং অনেক মুনাফিক আলেম শামস তাবরিযকে ঈর্ষা করতে শুরু করেন।

মাওলানা জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমী (রহ.)

শামসের অন্তর্ধান এবং ভেতরের রূপান্তর

শামস হঠাৎ কৌনিয়া থেকে অন্তর্ধান করেন। কেউ বলেন, তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল, আবার কেউ বলেন, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে অন্তরালে চলে যান। শামসের এই অন্তর্ধান মাওলানা রুমীকে গভীর শোকে নিমজ্জিত করে।

এই বিচ্ছেদ তাঁকে ভেঙে দেয়, কিন্তু একই সঙ্গে নতুনভাবে গড়ে তোলে। শামসের স্মৃতিতে তিনি তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ “দিওয়ান-ই-শামস-ই-তাবরিজি” রচনা করেন। এতে তিনি শামসকে "আত্মার আলো" হিসেবে অভিহিত করেন। এই কাব্যে তিনি প্রেম, বিচ্ছেদ এবং স্রষ্টার প্রতি গভীর অনুরাগের কথা তুলে ধরেন।

মসনবী শরীফ: আধ্যাত্মিক মহাকাব্যের সৃষ্টি

মাওলানা রুমীর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো ‘মসনবী শরীফ’, যা প্রায় ২৫,০০০ শ্লোক নিয়ে গঠিত। এটি শুধু একটি কাব্যগ্রন্থ নয়। বরং এটি তাসাউফ চর্চার  চিরন্তন পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত।

গ্রন্থটির গল্প এবং উপমাগুলি মানুষকে আত্মা এবং সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের পথে নিয়ে যায়। একটি বিখ্যাত কাহিনিতে তিনি বলেন, ‘যে বীজ মাটির নিচে চাপা পড়ে, সে-ই একদিন মহীরুহ হয়ে ওঠে। তেমনই, মানুষের আত্মা কষ্টে পুড়ে খাঁটি হয়ে ওঠে।’

প্রেমের সর্বজনীন ভাষা

মাওলানা রুমী প্রেমকে একটি সর্বজনীন শক্তি হিসেবে দেখতেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি: ‘ধর্ম, জাতি, ভাষা সব কিছু প্রেমের কাছে তুচ্ছ। আমি প্রেমের মানুষ।’ তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ ধর্ম দিয়ে বিভক্ত নয়; বরং প্রেমই তাঁদের একত্রিত করে। তাঁর কবিতা এবং দর্শন সব ধর্মের মানুষের মধ্যে এক সেতু হিসেবে কাজ করে।

অজানা গল্প এবং মানবিক দিক

১. দরিদ্র নারীর কাহিনি:

একবার এক দরিদ্র নারী মাওলানা রুমীর কাছে এসে বললেন, তাঁর সন্তানরা অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। মাওলানা রুমী তখন নিজের বাড়ির সমস্ত খাদ্য এবং সম্পদ সেই নারীর হাতে তুলে দেন।

২. সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা:

মাওলানা রুমী নিয়মিত গরীবদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করতেন এবং তাঁদের সঙ্গে মিশে একাত্ম হতেন। তিনি বলতেন, ‘স্রষ্টাকে খুঁজতে হলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে।’

৩. পশুপ্রেম:

একদিন মাওলানা রুমী দেখেন, একটি পাখি আঘাত পেয়ে মাটিতে পড়ে আছে। তিনি সেই পাখিটিকে যত্নসহকারে সুস্থ করেন এবং বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির প্রতি মমত্ববোধই প্রকৃত ধর্ম।’

শেষ অধ্যায়: মিলনের সুর

১২৭৩ সালে মাওলানা রুমী তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি গভীর ধ্যান এবং সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে কাটান। নিজের নফসের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর শিষ্যদের বলেন, ‘আমার মৃত্যু শোকের কারণ নয়; এটি হলো চিরন্তন প্রেমে বিলীন হওয়ার মুহূর্ত।’

১৭ ডিসেম্বর। ১২৭৩ সাল। তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী ‘শাব-ই-আরুস’ বা ‘মিলনের রজনী’ নামে পালন করা হয়।

উত্তরাধিকার: বিশ্বজনীন প্রভাব

মাওলানা রুমীর কবিতা আজও বিশ্বের প্রতিটি কোণায় মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পঠিত কবিদের একজন। তাঁর দর্শন প্রেম, মানবতা এবং ঐক্যের এমন এক বার্তা দেয়, যা সব সময় প্রাসঙ্গিক।

মাওলানা রুমী লিখেছিলেন: ‘আমি বেঁচে থাকব, যতদিন প্রেম বেঁচে থাকবে। কারণ প্রেমই আমার প্রকৃত পরিচয়।’ মাওলানা রুমীর জীবন আমাদের শেখায়, বিভেদের পৃথিবীতে কেবল প্রেমই একমাত্র পথ। তাঁর দর্শন এবং কাব্য চিরকালীন, যা মানুষকে আত্মার শুদ্ধতায় নিমগ্ন হতে এবং স্রষ্টার সঙ্গে মিলনের পথ খুঁজতে সাহায্য করে।

আমজাদ হোসাইন: লেখক ও গল্পকার

r1 ad
r1 ad
top ad image