উপজেলা নির্বাচন: দ্বিতীয় ধাপে কোটিপতি প্রার্থী ১১৬
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে এ কথা বলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি জানায়, দ্বিতীয় ধাপে কোটিপতি প্রার্থী ১১৬ জন। প্রতি চারজন প্রার্থীর একজন ঋণগ্রস্ত। মোট প্রার্থীর ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে।
উপজেলা পরিষদে গতবার নির্বাচিতদের আয় ও সম্পদ দ্রুত বেড়েছে। তাদের স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের আয় এবং সম্পদও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। গতকাল রবিবার সকালে রাজধানীর ধানমণ্ডির মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দ্বিতীয় ধাপে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানিয়েছে টিআইবি।
টিআইবি দেখিয়েছে, গত পাঁচ বছরে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচিত হননি এমন প্রার্থীদের তুলনা করলে দেখা যায়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আয় ও সম্পদ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকার সঙ্গে দ্রুত আয় ও সম্পদ বাড়ার প্রবণতা স্পষ্ট।
যারা পদে আসীন ছিলেন এমন প্রার্থীদের গত ১০ বছরের হিসাব তুলনা করলে দেখা যায়, পদাসীন প্রার্থীদের আয় ও অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে যথাক্রমে ৫৪০.৬৮ শতাংশ ও ২১১.৯৮ শতাংশ। পদে না থাকাদের আয় ৫৬.৪৭ শতাংশ বাড়লেও, সম্পদ কমেছে ৪৫.৪৪ শতাংশ। যারা পদে ছিলেন পাঁচ বছরে তাদের আয় বেড়েছে ১৪০.৬১ শতাংশ আর যারা পদে ছিলেন না তাদের আয় বেড়েছে ৭৭.৪৪ শতাংশ। একইভাবে পদে থাকা প্রার্থীদের অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ২৩১.৬২ শতাংশ এবং যারা পদে ছিলেন না তাদের বেড়েছে ১০০.৩৩ শতাংশ। শুধু নির্বাচিতদেরই নয়, তাদের স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের আয়-সম্পদও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সংরক্ষিত পদ ছাড়া প্রার্থীদের মধ্যে নারী প্রার্থী দুই শতাংশেরও কম। ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য প্রায় একচ্ছত্র। একদলীয় আধিপত্যের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছে, স্থানীয় পর্যায়ে পরিবারতন্ত্র বাড়ছে। তাছাড়া যারা আগে থেকেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন তাদের আয়-সম্পদের বৃদ্ধি যারা জনপ্রতিনিধি ছিলেন না তাদের থেকে বহুগুণ বেশি।’
তিনি বলেন, ‘স্পষ্ট বোঝা যায়, কেন জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই জনগণের কল্যাণ থেকে সরে গিয়ে নিজের সম্পদ বৃদ্ধিতে স্থির হয়েছে। অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির যে চিত্র হলফনামায় দেখা গেছে, তা তাদের বৈধ আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, সম্পদ অর্জনে ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে কি না, সেটা যাচাই করার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ দায়িত্ব পালনে আগ্রহী নয়। হলফনামায় যে তথ্য দেওয়া হয় তা পর্যাপ্ত ও নির্ভরযোগ্য কি না, তাও খতিয়ে দেখা হয় না।’
হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট। ব্যবসায়ী প্রার্থীর সংখ্যা চতুর্থ নির্বাচনের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫৭ শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৭০.৫১ শতাংশই ব্যবসায়ী। ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের প্রায় ৬৮.৭৩ শতাংশ, নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ২৯.২৬ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৫১.৬৩ শতাংশ নিজেকে গৃহিণী উল্লেখ করেছেন অথবা গৃহস্থালির কাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে গৃহস্থালিকে পেশা হিসেবে দেখানো প্রার্থীদের ১৪.৫৫ শতাংশের আয় আসে ব্যবসা থেকে।
প্রার্থীদের ৪২ শতাংশই আয় দেখিয়েছেন সাড়ে ৩ লাখ টাকার নিচে, অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন মাত্র ১০ শতাংশ প্রার্থী। চেয়ারম্যান ও অন্যান্য প্রার্থীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আয়-বৈষম্য লক্ষ করা গেছে। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২১ শতাংশের আয় সাড়ে ৩ লাখ টাকার নিচে, অন্য প্রার্থীদের ক্ষেত্রে তা ৫৩ শতাংশ। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২৩.৬২ শতাংশের আয় সাড়ে ১৬ লাখ টাকার ওপর। অন্যান্য প্রার্থীর ক্ষেত্রে তা মাত্র ৩.২৫ শতাংশ। অর্থাৎ চেয়ারম্যান পদে ধনীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সার্বিকভাবে দ্বিতীয় ধাপের প্রার্থীদের ১১৬ জনের ১ কোটি টাকা বা তার বেশি সম্পদ রয়েছে। কোটিপতির সংখ্যা আগের নির্বাচনের তুলনায় বেড়ে তিনগুণের বেশি হয়েছে।
দ্বিতীয় ধাপের প্রার্থীদের হলফনামার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পাঁচ বছরে একজন প্রার্থীর আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৯০০ শতাংশ, অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৬৬৬ শতাংশ। ১০ বছরে একজন প্রার্থীর আয় বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৩৩৬ শতাংশ। পাঁচ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা পেছনে ফেলেছেন সংসদ সদস্যদের। সংসদ নির্বাচনে একজন সংসদ সদস্যদের সম্পদ বৃদ্ধির হার ছিল সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ, সেখানে একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর সম্পদ বেড়েছে ১১ হাজার শতাংশের বেশি। ১০০ বিঘা বা ৩৩ একরের বেশি জমি আছে চারজন প্রার্থীর।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সহসমন্বয়ক ইকরামুল হক ইভান। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক ও গবেষণা দলের প্রধান মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা- নির্বাহী ব্যবস্থাপনা ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা দলের সদস্য ও আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সহসমন্বয়ক রিফাত রহমান ও কে. এম. রফিকুল আলম।