top ad image
top ad image
home iconarrow iconখবরাখবর

বিলিয়ন ডলারের তিস্তা প্রকল্পে চীনের পর ভারতের আগ্রহ

বিলিয়ন ডলারের তিস্তা প্রকল্পে চীনের পর ভারতের আগ্রহ
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৃহস্পতিবার সাক্ষাৎ করেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা। ছবি: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সৌজন্যে

তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে একটি বহুমুখী ব্যারেজ নির্মাণ প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে এতদিন আপত্তি জানিয়ে আসছিল ভারত। এবার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে, ভারত এই ব্যারেজ নির্মাণে অর্থায়ন করতে চায়। ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসে গত বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা এই প্রকল্পে অর্থায়নের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।

বৈঠকে তিস্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিস্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আপনারা জানেন, তিস্তায় আমরা একটি বৃহৎ প্রকল্প নিয়েছি। ভারত সেখানে অর্থায়ন করতে চায়। আমরা বলেছি, তিস্তা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে, সেটি আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী হতে হবে। আমাদের প্রয়োজন যেন পূরণ হয়।’

তিস্তায় চীনও অর্থায়ন করতে চাচ্ছে, এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থান জানতে চাইলে হাছান মাহমুদ বলেন, ‘ভারত যে এ ক্ষেত্রে সহায়তা করতে চাচ্ছে, সে বিষয় নিয়েই আজকে আলোচনা হয়েছে।’

সম্প্রতি তিস্তায় ব্যারেজ নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠে চীন। গত বছরের শেষ দিকে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন আশাবাদ ব্যক্ত করেন, দ্বাদশ নির্বাচনের পরে তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু হতে পারে। প্রশ্ন উঠেছে-দুই পক্ষের এই আগ্রহে প্রকল্পের কাজ এগোবে, না আটকে থাকবে।

এদিকে কাছাকাছি সময়ে ভারত ও চীন সফরের কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। দুই দেশের মধ্যে কোন সফরটি আগে হবে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তিনি বলেন, ‘দিল্লি তো কাছে, বেইজিং একটু দূরে।’

গত বুধবার সন্ধ্যায় এক বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। পরদিন বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে তিনি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। বিকেলে ভারতের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব।

বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের আপত্তির কারণেই চীনের সঙ্গে এই প্রকল্প নিয়ে এগোতে পারেনি বাংলাদেশ। তারা আরও বলছেন, ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি বছরের পর বছর অমীমাংসিত থেকে যাওয়ায় বাংলাদেশের জন্য তিস্তা ব্যারেজ অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে চীনের পাশাপাশি ভারতের অর্থায়নের প্রস্তাবও ইতিবাচক। সব পক্ষের শর্ত বিবেচনা করে সবচেয়ে যৌক্তিক প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে।

কেউ কেউ ভারত-চীন উভয় দেশকে সঙ্গে নিয়েই এই প্রকল্প করার পক্ষে মত দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘চীন ও ভারত দুই দেশই এই প্রকল্পে অর্থায়ন করতে পারে। এতে মনে হয় না তাদের আপত্তি থাকার কথা, কারণ প্রকল্পটি বাংলাদেশের। বাংলাদেশের চিন্তা থেকেই এসেছে কীভাবে বর্ষা মৌসুমের অতিরিক্ত পানি ধরে রাখা যায়; আর এটাই সমাধান।’

তিনি বলেন, ‘তিস্তা নদীতে শীত মৌসুমে পানি কমে যায়, কারণ এই নদীর সিকিম অংশে একাধিক বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। সে সময় যেটুকু পানি আসে, সেটি পশ্চিমবঙ্গেরই লাগে।’ এই প্রকল্প ব্যয় বহুল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এতে প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো খরচ হবে।’

বাংলাদেশের এই প্রকল্প নিয়ে দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্ব স্পষ্ট মন্তব্য করে ইমতিয়াজ বলেন, ‘ভারত যদি মনে করে, চীন এই প্রকল্পে থাকলে...(নিরাপত্তা ইস্যু তৈরি হতে পারে), তাহলে ভারতও অংশগ্রহণ করতে পারে।’

এমনকি জাপানও প্রকল্পে আসতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘একটি কনসোর্টিয়াম হতে পারে। নতুন টার্মিনাল (হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল) জাপান করলেও অনেক জিনিস থাইল্যান্ড, চীন বা ভারত থেকে এসেছে। আবার অনেক ব্যাপারেই ভারত-চীন একসঙ্গে কাজ করে। যেমন ব্রিকস, মিয়ানমার, ইউক্রেন ইস্যুতে তারা একসঙ্গে কাজ করছে, তাহলে এখানে পারবে না কেন!’

ইমতিয়াজ বলেন, ‘তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির জন্য আমরা যে অপেক্ষা করছি, দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির কারণে সেটি আসলে হবে না। তাই এই বিকল্প সমাধানে যেতে হবে। প্রতি বছর আমাদের তিস্তা পাড়ের দুই কোটি কৃষক উৎপাদন করতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হন; এই সমাধানের সুফল তারা পাবেন, একইসঙ্গে আমাদের উৎপাদন বাড়বে।’।

চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মুন্সি ফয়েজ আহমদ। তাঁর ভাষ্য, কোন দেশের অর্থ নেওয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এই প্রতিবেদককে তিনি আরও বলেন, ‘তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পে একাধিক দেশের অর্থায়নের আগ্রহ ইতিবাচক। যাদের ঋণ শর্ত ভালো হবে, তাদের অর্থ নেওয়া যৌক্তিক হবে।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘আগ্রহী রাষ্ট্রগুলোকে বোঝাতে হবে, আমরা যার কাছ থেকেই অর্থ গ্রহণ করি না কেন, আমাদের উদ্দেশ্য পুরোপুরি আমাদের দেশের কল্যাণের জন্য।’

মুন্সি ফয়েজ বলেন, ‘এমন একটি ধারণা দেওয়া হয় যে, এখানে চীনা বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিলে তারা ভারতের সব গোপন কথা-বার্তা জেনে ফেলবে। এই ধারণা ঠিক না। এ ক্ষেত্রে অন্য দেশের উদ্বেগের কারণ নেই। আমাদের নিজেদের স্বার্থে এসব ব্যাপারে একটু সতর্ক হতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা যেকোনো দেশের কাছ থেকে সাহায্য নিতে পারি কিন্তু আমাদের মাটি ব্যবহার করে অন্য কারও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে দেব না।’

বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিস্তা প্রকল্পের কাজ যেখানে শুরু হবে, সেখান থেকে ভারতের শিলিগুড়ি করিডোর খুব দূরে নয়। শিলিগুড়ি করিডোরকে ভারত ‘চিকেন্স নেক’ নামেও অভিহিত করে। তিস্তা উন্নয়ন কাজে অজুহাতে চীন এই করিডোর নিজেদের কব্জায় নিতে চায়—এমন ধারণা ভারতের। এ কারণে ভারত বরাবর আপত্তি জানিয়ে আসছে।

কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের সদস্য হচ্ছে বাংলাদেশ

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের জানান, কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশ এতে অংশগ্রহণ করবে।

এছাড়া ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দুর্যোগ প্রশমন কার্যক্রম একসঙ্গে পরিচালনার ব্যাপারেও ভারতের প্রস্তাব রয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রসচিব। বৃহত্তর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক সীমানায় প্রতিবেশী দেশগুলোর কৌশলগত সহযোগিতা জোরদারে ২০১১ সালে শ্রীলঙ্কার উদ্যোগে ‘কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভ’ গঠিত হয়।

২০২০ সালে কার্যকর হওয়া এই জোটকে অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে চীনবিরোধী জোট হিসেবে দেখা হয়। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মরিশাস ও ভারত এই জোটের সদস্য। বাংলাদেশ গত তিন-চার বছর ধরে এই কনক্লেভের বৈঠকে পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশ নিয়ে আসছে।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠকে তিস্তা ইস্যুর সমাধান, গঙ্গা চুক্তি নবায়ন, সব ধরনের যোগাযোগ ও দ্বিপক্ষীয় সব ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়েও কথা হয়েছে।’

গত কয়েক সপ্তাহে সীমান্তে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনায় বৈঠকে ঢাকার পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানো হয়। সেই সঙ্গে সীমান্তে প্রাণঘাতি নয় এমন অস্ত্র ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়।

r1 ad
r1 ad