ঢাবিতে মশাল মিছিল, স্লোগান— ‘তুমি কে আমি কে, আসিয়া আসিয়া’\n
এ দিন সকালেই ‘নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ’ সমাবেশ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। সমাবেশে অংশ নিয়ে শিক্ষকরা চলমান ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনাগুলোয় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার তীব্র সমালোচনা করেন।
সন্ধ্যায় ফের বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্য এলাকায় জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে তারা মশাল মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেন। দিনভর এবং সন্ধ্যার এই মশাল মিছিলেও শিক্ষার্থীরা ঘুরেফিরে স্লোগান তোলেন— ‘তুমি কে আমি কে, আসিয়া আসিয়া’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘হ্যাং দ্য রেপিস্ট’, ‘ধর্ষকের ফাঁসি চাই’।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উত্তাল ছিল চবিও। রোববার সন্ধ্যার পর রাত পর্যন্ত তারাও বিক্ষোভ সমাবেশ ও মশাল মিছিল করেছেন। সেখান থেকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, সরকার ধর্ষক ও নারী নিপীড়কদের সাজা নিশ্চিত করতে না পারলে তারা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করবেন।
বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়। ছবি: রাজনীতি ডটকম
ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে এ দিন ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ইতিহাস, ইংরেজি, উদ্ভিদবিজ্ঞান, এগ্রিকালচার, হিসাববিজ্ঞান, ম্যানেজমেন্টসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ২০টি বিভাগের শিক্ষার্থীরা এ দিন ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেন। ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে তারা ধর্ষণের ঘটনায় বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানান। এর মধ্যে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করাসহ তিন দাবিতে আমরণ অনশনে বসেন দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাতিন আলমাস অপূর্ব।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কে’র অধীনে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি আয়োজন করেন। শিক্ষকরা বলেন, দেশে নারী নিপীড়নের ঘটনা নতুন নয়। তবে দুঃখের বিষয় হলো শাসকদের দায়িত্বহীন আচরণ। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এমন বিচারহীনতা ও নিরাপত্তাহীনতা কখনোই কাম্য নয়।
জনপরিসরে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীরা। মাগুরাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সব ধর্ষণের ঘটনায় দোষীদের বিচার নিশ্চিতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন তারা।
ধর্ষণসহ নারীর ওপর সহিংসতার প্রতিবাদে রোববার মানববন্ধন করেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থীরা। বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া চত্বরে জেন্ডার অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের উদ্যোগে মানববন্ধনে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী অংশ নেন। পরে তারা বিক্ষোভ মিছিল করেন।
ধর্ষণের প্রতিবাদ, ধর্ষকদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত এবং মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু ও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবিতে রোববার বিক্ষোভ করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা। কুমিল্লা নগরীর কেন্দ্রস্থল কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরাও একই ধরনের কর্মসূচি পালন করেন।
নারীর প্রতি সহিংসতা রুখতে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক), বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারাল আর্টস (ইউল্যাব) এবং আরও কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও অনুষ্ঠিত হয়েছে বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ।
প্রতিবাদ কর্মসূচিগুলোতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার ব্যাপক সমালোচনা করেন বিক্ষুব্ধরা। ছবি: ফোকাস বাংলা
কেবল বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নন, ধর্ষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছেন সাধারণ মানুষরাও। দেশের প্রায় সব জেলাতেই রোববার দিনের বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশের মতো নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করেছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ।
যে মাগুরার ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে সারা দেশকে, সেই মাগুরাও দিনভর ছিল উত্তাল। ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে সকালে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের গেট ঘেরাও করেন। পরে দুপুরে সমাবেশ করে শহরের ভায়নার মোড়ে অবস্থান নেন এবং সেখান থেকে আবারও ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন তারা।
নেত্রকোনায় ‘ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে’র ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নিয়েছেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। পরে তারা জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নেটওয়ার্কের উদ্যোগে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ছবি: রাজনীতি ডটকম
নারায়ণগঞ্জে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন নারায়ণগঞ্জ কলেজ শাখার উদ্যোগে মানববন্ধন হয়েছে। মানববন্ধন থেকে বক্তরা নারীদের জন্য উপযোগী সহায়তা সেল গঠন করার দাবি জানান। ময়মনসিংহের শহিদ ফিরোজ জাহাঙ্গীর চত্বরে মানববন্ধনসহ সমাবেশ করেন মহিলা পরিষদের নেতাকর্মীরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নরসিংদী জেলা শাখা রোববার নরসিংদী প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে। মানববন্ধনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, সমাজকর্মী ও সচেতন নাগরিকরা অংশ নেন। বক্তারা নারী নির্যাতন রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
একই দাবিতে বাগেরহাটের মোংলায় রোববার বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সাধারণ শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অংশগ্রহণে। টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ঢাকা-যমুনা সেতু মহাসড়ক অবরোধ করে মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থী-জনতা। বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন শেরপুরের শিক্ষার্থীরাও। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ মিছিল করেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ। ছবি: রাজনীতি ডটকম
দেশ জুড়ে ধর্ষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিগুলোতে বক্তারা বলছেন, একদিকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় নারীকে ঊনমানুষ হিসেবে বিবেচনা করা— এ দুই প্রধান কারণে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধগুলো প্রতিরোধও করা যাচ্ছে না, দমন করাও সম্ভব হচ্ছে না। পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও সমান অধিকার দিয়ে স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর দ্রুত বিচার ধর্ষণ-নিপীড়ন কমিয়ে আনতে পারে বলে মন্তব্য করেন তারা।
এ ছাড়া ধর্ষণ ও নারীর প্রতি নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও। তারাও শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সাধারণ মানুষদের মতো সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে ঘরে-বাইরে মেয়েদের স্বাধীন বিচরণ নিশ্চিত করতে বলছেন।