top ad image
top ad image
home iconarrow iconখবরাখবর

'প্রত্যয়' নিয়ে মুখোমুখি সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা

'প্রত্যয়' নিয়ে মুখোমুখি সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা
‘প্রত্যয়' স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে রোববার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কর্মবিরতি শুরুর ঘোষণার মধ্যেই ১ জুলাই চালু হচ্ছে নতুন পেনশন কর্মসূচি ‘প্রত্যয়’।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি ৩০ জুনের মধ্যে মেনে নিতে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।

সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিমকে’ বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে এটি প্রত্যাহার দাবিতে রোববার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও কর্মবিরতি পালন করছেন। শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মবিরতিতে প্রায় অচল হয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

দাবি আদায়ে সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।

শনিবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের মূল ফটকে সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘোষণা দেয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সমিতির মোর্চা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন।

এত দিন কর্মবিরতিতে পরীক্ষা এর আওতার বাইরে ছিল। কিন্তু কাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষাসহ দাপ্তরিক সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকবেন শিক্ষকেরা।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে; প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন।

রোববার দুপুরে কলাভবনের ফটকে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া।

তিনি বলেন, ‘সরকারের একটি কায়েমি গোষ্ঠী প্রধানমন্ত্রীকে বিভ্রান্ত করে প্রত্যয় স্কিম চালু করিয়েছে। আমরা শিক্ষকেরা আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চাই। আমরা বিভিন্নভাবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা কোনো আগ্রহ দেখাননি। ফলে সর্বাত্মক আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ ছিল না।’

এদিকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন আগে থেকেই কর্মবিরতিতে যাওয়ার কর্মসূচি দিলেও এটি চালু করতে অনড় সরকারের জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।

রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত ও স্বশাসিত সংস্থায় আগামী ১ জুলাই থেকে যাঁরা নতুন চাকরিতে যোগ দেবেন, তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যয় পেনশন কর্মসূচিতে যোগ দিতে হবে।

সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা ও তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরিতেও যাঁরা ১ জুলাই থেকে যোগদান করবেন, তাঁদের জন্য এটা প্রযোজ্য হবে।

তার মানে এসব সংস্থার নতুন চাকরিজীবীরা অবসরে যাওয়ার পর প্রচলিত পদ্ধতিতে পেনশন পাবেন না।

অর্থ মন্ত্রণালয় গত মার্চের মাঝামাঝি প্রত্যয় চালুর বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এর পর থেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এর বিরোধিতা করে আসছেন।

তবে পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রত্যয় চালুর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।

চারটি আলাদা কর্মসূচি (স্কিম) নিয়ে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয় গত বছরের ১৭ আগস্ট, এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এগুলো হচ্ছে প্রগতি, সুরক্ষা, প্রবাস ও সমতা।

প্রগতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মচারীদের জন্য।

প্রবাস শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য।

সমতা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য।

আর রিকশাচালক, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি ইত্যাদি স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য সুরক্ষা।

সরকারের হিসেবে, চার কর্মসূচিতে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩ লাখ ৩২ হাজার গ্রাহক হয়েছেন, যার বিপরীতে জমা পড়েছে ৯৭ কোটি টাকা।

এবারের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন আরেকটি কর্মসূচি চালু হবে।

সরকারি কর্মচারীরা বর্তমানে সাধারণ ভবিষ্য তহবিল (জিপিএফ) এবং স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো প্রদেয় ভবিষ্য তহবিলে (সিপিএফ) টাকা জমা রাখে, যার বিনিময়ে সরকার ১১ থেকে ১৩ শতাংশ হারে সুদ দেয়। যেসব সরকারি কর্মচারী রাজস্ব খাত থেকে বেতন পান, তাঁরা টাকা রাখেন জিপিএফে। আর যাঁরা রাজস্ব খাতের বাইরে থেকে বেতন পান, তাঁরা টাকা রাখেন সিপিএফে। পেনশনে যাওয়ার পর তাঁরা এই টাকা পেয়ে থাকেন।

অর্থ বিভাগ বলেছে, বিদ্যমান সিপিএফ ব্যবস্থায় কর্মচারী মূল বেতনের ১০ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠান মূল বেতনের ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ দেয়। প্রত্যয় কর্মসূচিতে প্রতিষ্ঠান দেবে মূল বেতনের সমান অর্থাৎ ১০ শতাংশ। বিদ্যমান সিপিএফ–ব্যবস্থা থেকে তা ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি।

প্রত্যয় কর্মসূচিতে একজন কর্মচারীর নিজ বেতন থেকে মাসিক ২৫০০ টাকা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান একই পরিমাণ টাকা ৩০ বছর চাঁদা দিলে অবসরের পর অর্থাৎ ৬০ বছর বয়স থেকে ওই কর্মচারী মাসিক ৬২ হাজার ৩৩০ টাকা হারে পেনশন পাবেন।

প্রত্যয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য কর্মচারীদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা—এ দুয়ের মধ্যে যেটা কম তা তাঁদের বেতন থেকে কাটা হবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা দেবে। এরপর উভয় অর্থ জমা হবে পেনশন কর্তৃপক্ষের তহবিলে।

অর্থ বিভাগ বলেছে, ৩০ বছর ধরে মাসিক ২৫০০ টাকা হারে চাঁদা দিলে একজন কর্মচারীর নিজ বেতন থেকে চাঁদা জমা হবে ৯ লাখ টাকা আর সংশ্লিষ্ট সংস্থা জমা করবে আরও ৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর মোট চাঁদা হবে ১৮ লাখ টাকা। তিনি যদি ৭৫ বছর বয়সে মারা যান, তাহলে ১৫ বছরে পেনশন পাবেন ১ কোটি ১২ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ টাকা, যা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর নিজ জমার ১২ দশমিক ৪৭ গুণ।

অর্থ বিভাগ আরও বলেছে, পেনশনের সুবিধা আজীবন মিলবে বলে এ অঙ্ক আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্য মুনাফার হার বৃদ্ধি পেলে মাসিক পেনশনের পরিমাণও বাড়বে।

পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, বর্তমানে অবসরভোগী চাকরিজীবীরা যেভাবে পেনশন পাচ্ছেন, সেভাবেই পাবেন। ১০ বছর চাকরি আছে—কোনো প্রতিষ্ঠানের এমন চাকরিজীবীরা নতুন ব্যবস্থার আওতায় আসতে পারেন অথবা বিদ্যমান ব্যবস্থায়ও থেকে যেতে পারেন।

অর্থ বিভাগ ও পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রত্যয় চালুর পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলছে, কর্মচারীদের অবসরোত্তর-জীবনের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে সরকার প্রত্যয় চালু করছে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় খুব কমসংখ্যক স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা ও তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে পেনশন কর্মসূচি চালু আছে।

কর্তৃপক্ষের দিক থেকে বলা হচ্ছে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী আনুতোষিকের আওতাভুক্ত এবং তাঁদের জন্য সিপিএফ–ব্যবস্থা প্রযোজ্য। এ ব্যবস্থায় কর্মচারীরা চাকরি শেষে অবসরসুবিধা হিসেবে এককালীন আনুতোষিক পেলেও মাসিক পেনশন পান না। ফলে অবসরোত্তর–জীবনে প্রায় ক্ষেত্রেই তাঁরা আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন। প্রত্যয় চালুর ফলে বিদ্যমান কর্মকর্তা–কর্মচারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে না।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি মো. আখতারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যয় স্কিম চরম অপরিপক্ব হাতের কাজ এবং বিভ্রান্তিকর। এই স্কিম বাতিল করতে হবে। যারা প্রধানমন্ত্রীকে এই কুপরামর্শ দিয়েছে, তারা ষড়যন্ত্রকারী। আমরা নিজেদের সুবিধার জন্য আন্দোলন করছি না, করছি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য।’

r1 ad
r1 ad