রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে বিএনপি-ছাত্র সম্পর্কে ফাটল?
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত আড়াই মাসে নতুন সরকার গঠন কিংবা বিভিন্ন ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির ঐকমত্য থাকলেও এই প্রথম রাষ্ট্রপতি অপসারণ ইস্যুতে বিভেদ দেখা যাচ্ছে। বিএনপির সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠক করেও এখনো কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি।
প্রশ্ন উঠেছে— তাহলে কি সরকার পতনের আড়াই মাসের মাথায় আওয়ামী লীগবিরোধীদের মধ্যে ঐক্যে ফাটল ধরল? জবাবে বিএনপি বলছে, সাংবিধানিক সংকট তৈরির হতে পারে— এমন আশঙ্কার জায়গা থেকেই এই পথে হাঁটতে চাচ্ছে না দলটি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এটাকে দূরত্ব বা ফাটল বলা যাবে না। তারা রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন ইস্যুতে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আমরা তাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছি, এভাবে রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন হলে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে।’
এ প্রশ্নে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মনে করছে, রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যুতে বিএনপি যে সংকটের কথা ভাবছে সেটি রাজনৈতিক। সেই সংকট আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘হয়তো বিএনপি ভাবছে এখন রাষ্ট্রপতি অপসারণ হলে আগামী নির্বাচন আয়োজনে দেরি হতে পারে। আমরা তাদের আশ্বস্ত করব যে প্রয়োজনের তুলনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একদিনও যেন বেশি না থাকে।’
গত কয়েকদিনে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এই ইস্যুতে আলোচনা করছে ছাত্রদের পৃথক দুটি প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাষ্ট্রপতির এই মুহূর্তে কোনো ক্ষমতা নেই। তাই তাকে অপসারণ করলে বা তিনি পদে থাকলে খুব বেশি সংকটও তৈরি হওয়ার কথা না
রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে বিএনপির আপত্তি কেন?
গত সপ্তাহে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইস্যুতে দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে সাক্ষাৎকার দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগের কোনো দালিলিক প্রমাণ তার কাছে নেই। ওই বক্তব্য ঘিরেই দেশ জুড়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবিতে গত মঙ্গলবার বঙ্গভবন ঘেরাও করে কয়েকটি সংগঠনও।
একই দিন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবিতে আলটিমেটাম দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও সাংবাদিকদের ডেকে ব্রিফ করে বলেন, রাষ্ট্রপতি ওই বক্তব্যের মাধ্যমে মিথ্যাচার করেছেন, শপথভঙ্গ করেছেন। এই বক্তব্যের পর রাষ্ট্রপতি পদে থাকার নৈতিক অধিকার তার রয়েছে কি না, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি। বিষয়টি উপদেষ্টা পরিষদও আলোচনা করবে— এমনটিই জানান উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
পরদিনই বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে। সেখান থেকে বেরিয়ে বিএনপি নেতারা জানান, এই মুহূর্তে দেশে কোনো সাংবিধানিক সংকট তৈরি হোক, সেটি তারা চান না।
এরপর গত শনিবার বিএনপির সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে বৈঠক করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা। কিন্তু ছাত্র নেতাদের সঙ্গে এ বৈঠকেও আগের অবস্থানে অনড় ছিল বিএনপি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা এই ইস্যুতে সংকট বা সাংবিধানিক শূন্যতা চাইছি না দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রে উত্তরণের স্বার্থে।’
কারণ হিসেবে বিএনপি বলছে, এই মুহূর্তে এই সংকট তৈরি হলে তা অন্য কোনো অসাংবিধানিক শক্তিকে সুযোগ করে দিতে পারে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সাংবিধানিক সংকটের চেয়ে রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যুটি আরও বেশি রাজনৈতিক।
রাজনীতিবিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বলেন, ‘বিএনপি খুব ভালো করে জানে, এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে সরকার গঠন করতে পারবে। আর রাষ্ট্রপতি অপসারণ ইস্যু সামনে এলে তখন নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। সে কারণেই হয়তো বিএনপির আপত্তি।’
দুই পক্ষের ঐক্যে ফাটল?
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে প্রায় আড়াই মাস হলো। এই সময়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠনসহ নানা ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্য ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা।
এরপরই দেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে এ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে— একই দাবিতে আন্দোলন করা দুটি বড় শক্তির মধ্যে কি দূরত্ব তৈরি হলো?
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘তারা হয়তো একভাবে চাইছে, আমরা আরেকভাবে চিন্তা করছি। এ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। এটাকে দূরত্ব বা ফাটল বলা যাবে না।’
তবে দূরত্ব যে একেবারে তৈরি হয়নি, সেটি জোরালোভাবে বলছে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। প্লাটফর্মটির সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, ‘যে রকম ফাটল বা দূরত্ব মনে করা হচ্ছে, বিষয়টি ঠিক তেমন না। এটাকে আমরা বিরোধী হিসেবে দেখছি না। নিশ্চয়ই দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় আমরা একটা পথ বের করতে পারব।’
প্রথম দফার আলোচনায় রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে একক কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় দ্বিতীয় দফা আলোচনা শুরুর কথা জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তাতেও কি বিএনপিকে রাজি করানো সম্ভব হবে? যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে সমাধান কী?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এখন বিএনপির ভয়ের জায়গা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে না আবার নির্বাচন পিছিয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে এটা হলে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভবনা তৈরি হবে। ফলে শেষ পর্যন্ত বিএনপি রাজি নাও হতে পারে।’
রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে সংকটের সমাধান কী?
শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য নিয়ে নানা সমালোচনা তৈরি হলে গত ২১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির প্রেস উইং থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। সেখানে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগ একটি মীমাংসিত বিষয়। তাই এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি না করার আহ্বান জানান তিনি।
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলছে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুগত। এ কারণে তার পদে থাকাকে সংকট মনে করছে তারা। কিন্তু যদি বিএনপি রাজি না হয়, রাষ্ট্রপতিকে কি অপসারণ করা সম্ভব হবে?
এমন প্রশ্নের জবাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, ‘বিএনপি বড় একটি রাজনৈতিক দল। ঐকমত্য ছাড়া এই দাবি হয়তো পরিপূর্ণ হবে না। এ জন্য আমরা তাদের সাথে আবার বৈঠক করে আলোচনা করব।’
জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, ১২ জোটসহ অন্যান্য দল এবং জোট রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে ছাত্রদের দাবির সঙ্গে এরই মধ্যে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। তবে তাদের কেউ কেউ আগে রাজনৈতিক ঐকমত্যকেই গুরুত্ব দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, এটি বড় কোনো সংকট নয়।
মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এখন যারা সরকার পরিচালনা করছে তাদের জন্য রাষ্ট্রপতি কোনো বাধা না। কারণ তার তো তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। ফলে এটি নিয়ে যে সংকটের কথা ভাবা হচ্ছে, সেটি গুরুতর নয়। বরং তাকে সারানোর কারণে যদি কোনো সংকট তৈরি হয়, তাতে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ খোঁজার চেষ্টা করবে।’
বিএনপির রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে রাজি না হওয়ার পেছনে এটিও একটি কারণ হিসেবে কাজ করছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির যারা আছে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করব যেন কোনো সংকট না হয়।’
আরও যেসব ইস্যুতে আলোচনা হচ্ছে
শুধু রাষ্ট্রপতি ইস্যু না, গত কয়েক দিনে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শথপ নেওয়া নিয়েও এক ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছে। গত কয়েক দিনে জাতীয় পার্টি বাদে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটি। এসব বৈঠকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যু ছাড়াও আলোচনা চলছে বর্তমান সংবিধান বাতিলে ‘প্রোক্লেমেশন অব রিপাবলিক’ ঘোষণা এবং শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে বিগত তিনটি নির্বাচন বাতিলের বিষয়টি নিয়ে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি এই দুটি ইস্যুতেও সবগুলো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছানোর।’
কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী এই গণঅভ্যুত্থান কিংবা সরকার গঠনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এ কারণে ‘প্রোক্লেমেশন অব রিপাবলিক’ বা রাষ্ট্রীয় ফরমান জারির মাধ্যমে সংবিধান স্থগিতের ঘোষণার বিষয়টিতেও গুরুত্ব দিতে চান তারা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, ‘বিএনপি প্রোক্লেমেশন অব রিপাবলিক ঘোষণার বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমাদের জানিয়েছে।’
তবে তিনটি ইস্যুতে আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত কেবল জাতীয় নির্বাচন বাতিলের ইস্যুটিতেই সব দল একমত হয়েছে— এমনটিই জানান আরিফ সোহেল। এ কারণে তিন ইস্যু নিয়েই ঐকমত্যে পৌঁছাতে দ্বিতীয় দফায় আবারও বসার কথা ভাবছে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা।