আগরতলায় সমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ?
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে দাবি করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তারা বলছেন, ওই সমাবেশে আওয়ামী লীগ সভাপতি ভারতে অবস্থানরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অংশ নিতে পারেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ শনিবার সন্ধ্যায় নোয়াখালীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ওই সমাবেশ থেকে তারা (আওয়ামী লীগ) একটি প্রবাসী সরকারের ঘোষণা দিতে পারে। শেখ হাসিনা সেখানে নিজে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখতে পারেন বলে তথ্য রয়েছে।’
শনিবার রাতে কুমিল্লার কান্দিরপাড় এলাকায় আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে একই তথ্য দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহও। তিনি বলেন, ‘পালিয়ে গিয়েও খুনি হাসিনা দেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছেন। আমরা ফ্যাসিবাদ গংদের স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, তাদের ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা কখনোই বাংলার মাটিতে সফল হবে না।’
সমন্বয়করা এমন একটি সময় এ ধরনের বক্তব্য দিলেন যখন ‘গণহত্যা’র অভিযোগে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়েছে। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া হবে।
গত কয়েকদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বশীল কেউ এখনো এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে আওয়ামী লীগ টিকে থাকতে সত্যিই ভারতের মাটিতে সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে কি না, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে বেশ আলোচনা হচ্ছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ আসলেই কি আগরতলায় সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে? দলটি যদি সমাবেশের প্রস্তুতি নেয়ও, ভারত সরকার কি এ ধরনের দলীয় কর্মসূচি করার অনুমতি দেবে?
কীসের ভিত্তিতে এমন দাবি?
সমন্বয়কেরা বলছেন, তাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে ভারতের মাটিতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তাদের এমন তথ্যের উৎস কী?
জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব কানেকশনের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি।’
সমাবেশ করার বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে আওয়ামী লীগ নেতারা এরই মধ্যে তৎপরতা শুরু করেছেন বলেও দাবি করেন এই সমন্বয়ক। বলেন, ‘শনিবার তারা কুমিল্লার কাছে সীমান্তের এক জায়গায় মিটিংও করার চেষ্টা করেছিল। জানাজানি হওয়ার কারণে সেই প্রচেষ্টা পরে সফল হয়নি।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের দাবি অনুযায়ী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী অঞ্চলের যেসব আওয়ামী নেতারা এখনো দেশে অবস্থান করছেন, তারাই ওই বৈঠকটি করতে চেয়েছিলেন। মাসুদ বলেন, ‘আগরতলায় একটি সমাবেশ করে তারা প্রবাসী সরকার ঘোষণা দিয়ে এ দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করতে চায়।’
কিন্তু বাংলাদেশে যেখানে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ এবং আওয়ামী লীগ কোনো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ গোষ্ঠী নয়, সেখানে তারা কেন প্রবাসী সরকার ঘোষণা করতে যাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ। কিন্তু তারা নিজেরা তো এখান থেকে পদত্যাগ করে পালিয়েছে গণঅভ্যুত্থান-গণবিপ্লবের মুখে জনরোষ থেকে বাঁচতে। মানুষ রক্ত দিয়ে এখন যে সরকারকে বসিয়েছে, তারা সেই সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে চাচ্ছে। এ কারণেই তারা এমন উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে।’
গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ বিভিন্ন সময় জানিয়েছেন যে তার মা আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেননি। ফলে আওয়ামী লীগ সভাপতিই এখনো সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের ‘বৈধ প্রধানমন্ত্রী’ বলেও দাবি করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য-বিবৃতি গণমাধ্যমে এসেছে, সেখানেও শেখ হাসিনাকেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘এ রকম আলোচনা সামনে এনে এখন শেখ হাসিনা বিভিন্ন দেশে সফর করে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টার পরিকল্পনা করছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারকেও জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই সমন্বয়ক। তিনি বলেন, ‘আমরা জানিয়েছি এবং এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে সরকারকে অনুরোধ করেছি। আমরা এটাও বলেছি যে সরকারের পক্ষ থেকে কথা বলে প্রয়োজনে ভারতকে এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে, যেন তাদের মাটি ব্যবহার করে কেউ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র না করতে পারে।’
এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করেননি।
কী বলছে আওয়ামী লীগ?
আওয়ামী লীগ ভারতের মাটিতে সমাবেশ ও প্রবাসী সরকার ঘোষণা করতে যাচ্ছে বলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক যে দাবি করেছেন, তার কোনো ভিত্তি নেই বলে বলছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এগুলো সব ভিত্তিহীন, অসত্য এবং প্রোপাগান্ডা।’
ক্ষমতা গ্রহণের পর অন্তর্বর্তী সরকার এখন দেশ চালাতে পারছে না বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সিনিয়র আরেক নেতা বলেন, ‘দেশে এখন জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। অরাজকতা চলছে। মোট কথা, কোনো কিছুর ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই।’
এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির নেতারা।
বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই তারা এখন এসব প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। কিন্তু এসব করে পার পাওয়া যাবে না। ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব অবশ্যই অন্তর্বর্তীকালীন অবৈধ সরকারকে নিতে হবে।’
তবে নেতাকর্মীদের অনেকে এরই মধ্যে দেশ ছেড়েছেন এবং এখনো ছাড়ার চেষ্টা করছেন বলে স্বীকার করেছেন নাছিম। তিনি বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর যেভাবে অত্যাচার-নির্যাতন-মামলা-হামলা চালানো হচ্ছে, তাতে করে জীবন বাঁচাতে কেউ যদি দেশের বাইরে আশ্রয় নেয়, সেটা কি সে পারে না?’
ভারত কী বলছে?
ভারত সরকারের কর্মকর্তারাও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দাবিকে সম্পূর্ণ ‘গাঁজাখুরি ও ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে ভারত অবশ্য বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভারত সরকারের একটি সূত্র বিবিসি বাংলাকে প্রতিক্রিয়া দিয়ে বলেছেন, ‘কারা বলছেন এসব কথা? তারা কি কোনো দায়িত্বপূর্ণ পদে আছেন? পাশের দেশে যে কেউ একটা আজগুবি কথা বললেই আমরা কেন জবাব দিতে যাব?’
ত্রিপুরা ও দিল্লির নানা মহলে খোঁজখবর নিয়েও নিশ্চিত হওয়া গেছে, এ ধরনের দাবির কোনো ভিত্তি নেই। কারণ, প্রথমত, আওয়ামী লীগের পালিয়ে আসা নেতাকর্মীরা যদি ত্রিপুরার মাটিতে বড় আকারের কোনো সমাবেশ করতে চান, সেটা একেবারে গোপনে বা স্থানীয়দের কাউকে টের পেতে না দিয়ে করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে ত্রিপুরার সরকারি ও বেসরকারি একাধিক সূত্র বিবিসিকে নিশ্চিত করেছে, রাজধানী আগরতলায় এ ধরনের কোনো তৎপরতা গত কয়েক সপ্তাহে তাদের আদৌ চোখে পড়েনি।
দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ যদি ভারতের মাটিতে কোনো প্রকাশ্য সভা করেও, সেখানে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে ভাষণ দিতে দেওয়া হবে— এমন সম্ভাবনাও একেবারেই নেই। গত আড়াই মাসে ভারত বারবার এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে নিজের সুরক্ষার জন্য শেখ হাসিনাকে ভারতে চলে আসতে হয়েছে এবং তখন তাকে আতিথেয়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে তাকে প্রকাশ্য রাজনীতিতে অংশ নিতে দেওয়া হবে— ভারত এখনো এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
ফলে প্রকাশ্য কোনো রাজনৈতিক সভায় শেখ হাসিনা ভাষণ দিলে বা তার অডিও বার্তা প্রচার করা হলে দিল্লির জন্য তা কূটনৈতিকভাবে খুবই অস্বস্তিকর হবে। শেখ হাসিনাকে তাই আপাতত সেটা ‘অ্যালাও’ করা হবে না বলে বলছেন কর্মকর্তারা।
তৃতীয়ত, ৫ অগাস্টের পালাবদলের পর আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী পালিয়ে ভারতে চলে গেছেন। তাদের অনেকেরই আগে থেকে ভারতের ভিসা ছিল, কেউ কেউ আবার এসেছেন ‘বিশেষ ব্যবস্থায়’। বিবিসি জানতে পেরেছে, ভারত তাদের সবাইকেই অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘লো প্রোফাইল’ বজায় রেখে চলার নির্দেশ দিয়েছে। প্রকাশ্য কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতেও নিষেধ করা হয়েছে তাদের। রাতারাতি সে অবস্থান পরিবর্তন করে ভারতের মাটিতে সমাবেশ করতে উৎসাহ দেওয়া হবে— এমন কোনো কারণ ঘটেনি।
বিবিসির শুভজ্যোতি ঘোষের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি পদস্থ সূত্র বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ভারতের মাটিতে শক্তি সঞ্চয় করে বাংলাদেশে ফিরে আসতে চাইছে, এ জন্যই সীমান্তের খুব কাছে সভা-সমাবেশ করছে— বাংলাদেশের মানুষকে আওয়ামী জুজু দেখাতেই এগুলো বলা। এটি বোঝাই যাচ্ছে। আমাদের সেই ফাঁদে পা-দেওয়ার কোনো কারণ নেই!’ বিবিসি বাংলা।