top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

আ.লীগের অনুপস্থিতি প্রতিপক্ষ করেছে বিএনপি-জামায়াতকে

আ.লীগের অনুপস্থিতি প্রতিপক্ষ করেছে বিএনপি-জামায়াতকে
বিএনপি ও জামায়াতের লোগো। ছবি: রাজনীতি ডটকম

বিএনপি-জামায়াতের ২৫ বছরের ঐক্যে ফাটল অনেকটাই প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় এখন জামায়াত বিএনপির অথবা বিএনপি জামায়াতের প্রতিপক্ষ।

সাম্প্রতিককালে দুই দলের নেতাদের কথাবার্তায় এটি স্পষ্ট, বিএনপি-জামায়াত একে অন্যের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ শক্ত অবস্থানে ফিরে না আসা পর্যন্ত দল দুটির এক হওয়ার সম্ভাবনা আর নেই।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের সময় ১৯৯৯ সালে গড়ে উঠেছিল চার দলীয় এই জোট। এ জোটের প্রধান দুটি দল ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। দল দুটি ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায়ও আসে। এরপর আবার বিরোধী দলে যায়। চার দলীয় জোট থেকে ২০ দলীয় জোট হয়। শেখ হাসিনার শাসনামলের শেষ দিকে দল দুটির মধ্যে দূরত্ব দেখা দেয়।

গত কয়েক বছর ধরেই নানা বিষয়ে টানাপোড়েন চলছে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সভা-সমাবেশের বক্তব্য-বিবৃতিতে মন্তব্য ছোড়াছুড়ি চলছে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর এই বিরোধ আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।

এর আগে নানা প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একই সুরে কথা বলেছেন বিএনপি-জামায়াতের নেতারা। রাজপথে লড়েছেন ঐক্যবদ্ধভাবেই। এবার অনেকটা প্রকাশ্যেই বিরোধে জড়িয়েছেন তারা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন সত্তার বহির্প্রকাশ ঘটেছে পরস্পরবিরোধী সাম্প্রতিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নিয়েছে দল দুটি।

জামায়াতের সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দি হয়ে নানা সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে পড়েছে বিএনপি। স্বাধীনতাবিরোধী বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে বিএনপিকেও। বিএনপির মধ্যে জামায়াত ও জামায়াতবিরোধী দুটি ধারাও তৈরি হয়েছে।

জামায়াত প্রসঙ্গে এক বিএনপি নেতার মূল্যায়ন হলো— বিএনপি ও জামায়াত পানি ও তেলের মতো। তাদের রাজনীতি কখনোই এক ছিল না। ভবিষ্যতেও এক হবে না। গণতন্ত্র উদ্ধার করতে জামায়াতের সঙ্গে কৌশলগত ঐক্য করেছিল বিএনপি।

আওয়ামী লীগও নব্বইয়ের দশকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামাতের শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।

জোটের নেতৃত্বশীল দল বিএনপি মনে করেছিল, জোট শরিক হিসেবে জামায়াত তাদের কৌশলের সঙ্গেই থাকবে। কিন্তু জামায়াত ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছে। সে অনেকটাই স্বাধীন, একাই পথ চলছে। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর জামায়াতের বিশেষ প্রভাব থাকার কথাও রাজনৈতিক মহলে আলোচিত।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ রাজনীতি ডটকমকে বলেন, জামায়াত ও বিএনপি দুটি আলাদা রাজনৈতিক দল। দুটি দলের মধ্যে সব রাজনৈতিক বিষয়ে ঐক্য থাকবে, এমন নয়। এখন যে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য বা অবস্থান, তা একেবারেই স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।

অধ্যাপক সাব্বির আরও বলেন, বিএনপি হয়তো ভেবেছিল, আগামী নির্বাচন ঘিরে বিএনপির কৌশলের সঙ্গে জামায়াত থাকবে। কিন্তু তারা সেটা থাকবে না। এটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে জামায়াতের স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বা সিদ্ধান্ত। এখানে বিরোধের কিছু নেই।

দুই দলের বিরোধ প্রথম প্রকাশ্যে আসে গত ২৯ ডিসেম্বর। রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, খুব ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করের চেষ্টা করছে একাত্তরের বিরোধীতাকারী জামায়াতে ইসলামী। ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করেন, ইসলাম মানে তো মোনাফেকি করা না।

এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে সেদিন রাতেই জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান একটি বিবৃতি দেন।

বিবৃতিতে তিনি বলেন, রিজভী অবশ্যই জানেন, ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত জোটকে এড়িয়ে ভিন্ন মতের লোকদের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় যেতে ঐক্য করা কি জাতির সঙ্গে মোনাফেকি নয়? জনগণ এই রাজনৈতিক ছন্দ পতনের ইতিহাস ভুলে যায়নি।

এরপরই জামায়াতে ইসলামীর বিবৃতির পালটা জবাব হিসেবে বিএনপি ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। একটি ছবি যুক্ত করে দেওয়া ওই পোস্টে বলা হয়, ২০১৮ সালের নির্বাচনে দর কষাকষি করে জোট থেকে ২২টি আসন বাগিয়ে নিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। সেই নির্বাচনে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানও ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হন। তাহলে কার সঙ্গে জোট? আর কার সঙ্গে মোনাফেকির কথা বললেন আমির?

এরই মধ্যে রংপুরে এক জনসভায় জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, দেশে পরীক্ষিত দুটি দেশপ্রেমিক শক্তি আছে— একটি সেনাবাহিনী, আরেকটি জামায়াতে ইসলামী। আওয়ামী লীগ সরকার এ দুই শক্তিরই ক্ষতিসাধন করেছে। আগেই সেনাবাহিনীর ক্ষতিসাধন করেছে। পরে জামায়াতকে তছনছ করে দিতে উঠে পড়ে লেগেছিল।

জামায়াতের আমিরের এমন বক্তব্যের পালটা জবাব দিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ভূমিকা জানতে চেয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আপনারা কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন? কোন সেক্টর কমান্ডারের অধীনে যুদ্ধ করেছেন?’

রিজভী আরও বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দল বলেছে, দেশপ্রেমিক তারা এবং সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী দেশপ্রেমিক নিঃসন্দেহে। কারণ তাদের পূর্বসূরীরা এই বাংলাদেশ নির্মাণে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। তাদের অন্যতম মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানেও সেনাবাহিনী উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে।’

জামায়াতের উদ্দেশে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আমি ইসলামপন্থি সেই রাজনৈতিক দলকে বলতে চাই, একাত্তরে আপনাদের রাজনৈতিক ভূমিকা কী ছিল? কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন, কোন সেক্টর কমান্ডারের আন্ডারে যুদ্ধ করেছেন? বাংলাদেশে কেউ দেশপ্রেমিক নেই, শুধু একটি রাজনৈতিক দল দেশপ্রেমিক— এ ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করলে মানুষ হাসবে, মানুষ হাসি ছাড়া আর কিছু দেবে না।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ২০২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘পরকিয়া’ করছে জামায়াত।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু জামায়াতের সমালোচনা করে বলেন, কিছু দল আছে, আমাদের সঙ্গে থাকলে ১৯টা সিট পায়। আমাদের থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলে তিনটা সিট পায়।

এদিকে জামায়াত-বিএনপির এই বাগ্‌যুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমানের দেশপ্রেম সম্পর্কিত বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে দলটি।

জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বিবৃতিতে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে নিজ দেশের নাগরিকদের হত্যায় জড়িত থাকা দেশপ্রেমের পরিচয় নয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষে ও মানবতাবিরোধী অবস্থান নিয়েও স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীকে দেশপ্রেমিক শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা ইতিহাসের নির্মম রসিকতা ছাড়া কিছুই নয়।

সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নেও বিএনপি ও জামায়াতের বিরোধ এখন তুঙ্গে। জামায়াত এখন দ্বৈত ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে বিএনপি ও এর মিত্রদের মধ্যে।

জামায়াত এখন বিএনপিকে ছাড়াই পথ চলতে চায়— সেটিও স্পষ্ট। যেহেতু আপাতত মাঠে আওয়ামী লীগ নেই, সেহেতু রাজনীতিতে এই দুই দলের দূরত্ব বাড়তেই থাকবে— এমনটি ধরে নেওয়াই যায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে এই দূরত্ব বা বিরোধ হয়তো তৈরি হতো না। আওয়ামী লীগ কখনো রাজনীতির মাঠে ফিরলে তখন আবার বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে পারে— এমন অভিমত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

লেখক: সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

r1 ad
r1 ad
top ad image