top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

রক্ত দিয়ে কিনেছি দেশ, কারো দানে পাওয়া নয়

রক্ত দিয়ে কিনেছি দেশ, কারো দানে পাওয়া নয়
আফরোজা পারভীন| ফাইল ছবি

আন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বয়স দু’মাসের কাছাকাছি হতে চলেছে। এর মধ্যে দেশজুড়ে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা, এখনো ঘটে চলেছে। উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা খুবই কম। বেশ কিছু কর্মকর্তা- কর্মচারীর পদোন্নতি হয়েছে, অনেক নতুন পদায়ন হয়েছে, অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এগুলোকে যদি অগ্রগতি বলা হয়, তাহলে এতটুকুই।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ হয়নি, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই খারাপ। পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলা হচ্ছে। ৫ জুলাইয়ের পর পর খুলে যায় সমস্ত জেলখানার ফটক। একের পর একে বেরিয়ে আসে বিচারাধীন মামলার আসামিরা। তাদের মধ্যে এমন অনেকে আছে যাদের নাম উচ্চারণ করতে ভয় হয়। অন্যদিকে একের পর একে জেলে ঢোকেন আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

দীর্ঘদিন কর্মবিরতির পর পুলিশ কাজে যোগ দিয়েছে। তবে কেমন যেন মনমরা তারা। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা সদস্যদল নিয়ে যোগদান দিয়েছেন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে। সেখানে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে। উত্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। পত্রিকায় অনেক আশাব্যঞ্জক খবর আমরা পাচ্ছি।

ঘটেছে কিছু অদ্ভুত ঘটনাও। স্বৈরাচার পতনের চল্লিশ দিন পার হওয়া উপলক্ষে গরু জবাই দিয়ে চল্লিশা করেছেন মিরপুরের কিছু মানুষ। সেখানে উপস্থিত ছিলেন শোবিজ জগতের মানুষ, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের কেউ কেউ, স্থানীয় লোকজন। স্থানীয়দের মাঝে মাংস বিতরণ করা হয়েছে। মানুষ পরম উৎসাহে মাংস খেয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দলের শীর্ষ নেতারা এখনও জীবিত। অনেকেই জেলে আছেন, এটা ঠিক। অনেক পলাতকও আছেন। তবে হ্যাঁ, সরকার পতনের আনন্দে গরু কাটতেই পারেন!

গরু জবাই-এর আরও খবর আছে। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স.) ইসলামের আকিকা করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে। কেনা হয়েছিল দুটো গরু। ফেসবুকে সে গরুর ছবি দেখেছি। ছিল বিশাল খাওয়া দাওয়ার আয়োজন। ইসলামে আকিকার গুরুত্ব অনেক। এটা মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতির অংশ। সন্তান জন্মদানের পর আকিকা করে নাম রাখার বিধান আছে। এটা বাবা-মা বাবা বা অভিভাকের ওপর সন্তানের হক। নবীজীর আকিকা সম্পর্কে দুটো মত আছে। এক রাসুলুল্লাহর দাদা আব্দুল মুত্তালিব নিজেই তার জন্মের সপ্তম দিবসে কোরবানি দেন। তিন সব কুরাইশদের দাওয়াত করেছিলেন (রাহমাতুল্লিল আলামিন: ১/৪৩-৪৪; সিরাতুল মুস্তফা: ১/৬১) কোনো কোনো বর্ণনামতে, নবুয়ত লাভের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই আকিকা করেছিলেন। (জাদুল মাআদ:১/৫; সিরাত বিশ্বকোস: ৪/২৩০)।

আর একটি জমজমাট খবরও আছে। ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে আয়োজন করা হয়েছিল গণবিবাহের। এই উপলক্ষে হওয়ার কথা ছিল গরু ভোজ, হয়েছে আশা করি। শুনেছি একজন ছাত্র আন্দোলন পরবর্তী বিজয় উদযাপন করার জন্য ফেসবুকে গণবিবাহের প্রস্তাব দিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সেখানে কোন বিরূপ মন্তব্য না আসায় ছাত্রটি উৎসাহিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি পেইজে পোস্টটি দেন। এরপর অন্য হলগুলোও যোগ দিতে চায় এই অনুষ্ঠানে। ছাত্ররা বলেছিলেন, কয়েকটি বিয়ে হতে পারে। পাত্র-পাত্রী চেয়ে ফেসবুকে পোস্টের পর পোস্টেও দেয়া হয়েছিল বলে শুনেছি। আজকাল বিয়েতে নানান হাঙ্গামা। পাত্র-পাত্রী দেখা, আলাপ আলোচনা, পছন্দ-অপছন্দ, অভিভাবকদের সম্মতি, তারপর বিয়ের বিরাট খরচ। এতসব না করে এক গরুভোজেই যদি বিয়ে মিটে যায় মন্দ কী? ছাত্ররা গরু কাটবেন বউভাত হিসেবে। শেষাবধি অবশ্য একটি জুটিকে দেখেছিলাম বিবাহ আসরে বর কনের সাজে। বিয়ে করা ভাল কিন্তু বিয়ের সঙ্গে দায়িত্ব কর্তব্য অধিকার, সামাজিক মর্যাদা, ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয় জড়িত থাকে। দুজন ছাত্র- ছাত্রী আচমকা বিয়ে করে বসলে তাদের লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ কী, তারা চলবেন কীভাবে, তাদের বাবা-মা যদি মেনে না নেন তখন কী হবে এ বিষয়গুলোও ভাবার। তাছাড়া ছাত্র-জনতার এতবড় অভ্যুত্থানের পর এখনও ছাত্ররা লেখাপড়ায় ফিরতে পারেনি। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। উপাচার্য আর শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সমস্যা চলছে। এই অবস্থায় ছাত্রদের উচিত সবার আগে লেখাপড়ায় ফিরে যাওয়া।

খুবই বিশৃঙ্খল অবস্থা চারদিকে। রাজশাহী, ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলার যেসব ঘটনা ঘটল, তা মেনে নেয়া যায় না কিছুতেই। এভাবে চলতে থাকলে আইন আদালতের আর কেউ তোয়াক্কা করবে না। এমনিতেই সেনাবাহিনীর হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়ায় অনেকে ক্ষুব্ধ। বিএনপি ইতোমধ্যে এটাকে সরকারের ব্যর্থতা বলেছেন। ১৬ বছর যারা কথা বলেনি, কিছু চায়নি তারাই সোচ্চার হয়ে উঠেছে। গার্মেন্টস-এর সমস্যা, সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাই বোনদের দাবি, আনসার ভাইদের দাবি, উত্থাল পাহাড়। এতো শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা। আমার দীর্ঘ চাকরি জীবনে কখনই সচিবালয়ে এমন অবস্থা দেখিনি। জনতার মঞ্চ হয়েছিল ঠিকই, সেটার চরিত্র ছিল অন্যরকম। কিন্তু এবার যেটা ঘটল তা অভাবনীয়। ডিসি পদায়ন নিয়ে কর্মকর্তারা মারামারি করলেন। তাদের মধ্যে নারী কর্মকর্তারাও ছিলেন। বিষয়টা নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে, ঠিক আছে। কিন্তু সারা দেশের মানুষ বিষয়টা দেখল, আলোচনা করল, হাসল। প্রশাসনের ভাবমূর্তি কোথায় গেল! এমনিতেও আমলাদের অনেক দোষ। আমলা শুনলেই সবার ভ্রু কুঁচকে ওঠে। দেশের সব ঘি মাখন ছানা সবই নাকি আমলারা খেয়ে ফেলছে! অথচ আমলাদের ক্ষমতা কমতে কমতে তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। চাকরি জীবনের শুরুতে মাঠ প্রশাসনে ছোট ছোট ঘরে দুই তিনজন একসঙ্গে বসেন এরা। সচিবালয়ে এসেও প্রথমদিকে একই অবস্থা। যাতায়াত করেন গণমাইক্রোবাসে। এ্যাটাচড বাথরুমের চিন্তাই করা যায় না।

এখনতো যুগ্ম সচিবরাও খুপড়িতে বসেন। অথচ অন্য যে কোনো ক্যাডারে চাকরির শুরুতেই সুসজ্জিত রুম পিয়ন গাড়ি টেলিফোন আছে । তারপরও সব সময় আঙ্গুল আমলা মানে প্রশাসনের লোকজনের দিকে উঠেই থাকে। এবার আমলারা সেই বলার সুযোগটা আরও বেশি করে দিয়ে দিলেন। মনে আছে চাকরিতে প্রবেশ করার পর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে অবাক হয়েছিলাম। আমার হাসবেন্ডের একটা চিঠি এসেছিল। নামের পর লেখা সিনিয়র সচিব। গ্রামে একজন সহকারি সচিবও সচিব। যখনকার কথা বলছি তখন সিনিয়র সচিবের পদটাই সৃষ্টি হয়নি। আমার ছোট খাট শ্বশুরবাড়িটাকে সবাই ডাকত, ‘সচিবের বাড়ি’। আমার বিয়ের পর ও বাড়ি হয়ে গেল ‘দুই সচিবের বাড়ি’। ও গ্রামে এখন অনেক বড় বড় বাড়ি হয়েছে। আমাদের বাড়িটার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। কেউ থাকে না বাড়িটাতে। পরিত্যক্ত বাড়ি যেমন হয়। কিন্তু আজও ‘দুই সচিবের বাড়ি’ ওটাই। ও বাড়ির কৌলীন্য আগের মতোই।

যেসব কর্মকর্তারা এসব করলেন তারাও কিন্তু জানেন, এক দিনে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব না। সময় লাগবে। সময় দেয়া হচ্ছে না বলেই বার বার এই জাতীয় ঘটনা ঘটছে। আদেশ বদলাতে হচ্ছে। এতদিন যারা ডিসি না হয়ে ছিলেন কয়েকদিন পরে হলে তাদের এমন কি ক্ষতি হতো! অথবা প্রশাসন যদি আর একটু দেখে, যাচাই করে পদায়নটা করত তাতেই কা কী ক্ষতি হত! তার জন্য এই মারামারি আর ফেসলসের কী দরকার ছিল! কথাবার্তা বলার সময়ও সতর্ক থাকা দরকার। কোনটা বলতে পারি আর কোনটা পারি না, কোনটা আমার জুরিসডিকশনে নেই না জেনে কথা বললে বেকুব হবার সম্ভাবনা ষোলআনা।

এখন যে কোনো ইস্যুতেই সচিবালয় আক্রান্ত হয়। যেন সচিবালয় রেসকোর্স বা পল্টন ময়দান। সচিবালয় এদেশের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু এ কথাটা এখন কেউ মনে রাখতে চাইছে না। এটা বড়ই বেদনার!

আমরা যদি অতীতের দিকে তাকাই দেখব, কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। বিএনপি ক্ষমতায় এসে বলেছে, আগের সরকার এই এই করেছে কাজেই আমরাও করব। তাই করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে একই কথা বলেছে, একই কাজ করেছে। কেউ বদলের চেষ্টা করেনি। কেউ এগোনোর চেষ্টা করেনি। যেন প্রতিযোগিতার মহোৎসব লেগে গেছে কে কতটা খারাপ করতে পারে। একবারও ভাবেনি এতে দেশের ক্ষতি। দেশের ক্ষতি হলে দু’চারজনের হয়তো কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু এদেশের অধিকাংশ মানুষের পায়ের তলায় মাটি থাকে না। বড় কষ্টে এই দেশ আমরা পেয়েছি একাত্তরে, রক্ত দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়।

আমরা অনেক কিছু দেখছি, টাকা নিয়ে বাচ্চাদের খেলা করতে দেখছি, ঘরের মধ্যে ভল্ট দেখছি। মনে হচ্ছে বাড়িটাই ব্যাংক । অন্যদিকে ব্যাংকে টাকা নেই। হায় হায় রবে উঠছে গ্রাহকদের মধ্যে। একবার পিপলস লিজিং অনেককে পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে, এবার পথে বসালো এস আলম। এদের বিচার হবে কবে?

একদিকে কিছু মানুষ আনন্দে গরু কাটছেন আর কিছু মানুষ গুজব ছড়াচ্ছেন। হরেক রকম গুজবে বিভ্রান্ত মানুষ। ত্রাণের টাকা আত্মসাৎ, উপদেষ্টার বোনের কানাডা মিশনে চাকরি, দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ, সংস্কৃতি উপদেষ্টা আমেরিকা চলে যাচ্ছেন, সমন্বয়কদের মধ্যে এক বিশেষ দলের লোকই বেশি। যে কোন সময় দেশে ঢুকবেন শেখ হাসিনা, আশে পাশেই আছেন এমন অজস্র কথা ভাসছে বাতাসে।

গুজব ছড়ানো খারাপ। গুজবের ডালপালা হয়। প্রতিটি মানুষের কাছে গিয়ে গুজবটি একটু করে বর্ধিত হয়, তারপর বিশাল কলেবর নেয়। কানকথা এবং গুজব তাই বিধ্বংসী। এগুলো যত পরিহার করা যায় ততই মঙ্গল।

আমাদের উচিত হবে, ধৈর্য ধরা। প্রত্যেকের চিন্তায় থাকা উচিত দেশের মঙ্গল। কারো ক্ষতিতে আনন্দিত হবার কিছু নেই। কাউকে সাজা দেবার ভার নিজ হাতে তুলে নেবেন না। বিচার আচার যা করবার তা করার জন্য আইন আদালত আছে। এটা দেশের ক্রান্তিকাল। এই ক্রান্তিকাল মোকাবিলা করতে হয় ধৈর্য সাহস সততা নিষ্ঠার সঙ্গে। হুজুকে না মাতাই ভাল। অকারণে হুজুকে মেতে পয়সা খরচ, আনন্দ উৎসবের সময় এটা নয়, সে চল্লিশাই হোক আর গণবিবাহই হোক। দেশের সংস্কার দরকার। সে সংস্কার হতে হবে যুগোপযোগী, আধুনিক এবং প্রগতিপন্থি। এ কথা যেমন সরকারের লোকজনদের জন্য প্রযোজ্য, তেমনি সাধারণ মানুষের জন্যও।

লেখক: কথাশিল্পী, গবেষক

r1 ad
r1 ad