top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

ইলিশ স্বল্পতা ও রেকর্ড দামের মধ্যে রপ্তানির অর্থ কী?

ইলিশ স্বল্পতা ও রেকর্ড দামের মধ্যে রপ্তানির অর্থ কী?

ঢাকার মিরপুর ছয় নম্বর বাজার থেকে ১০০ টাকা দিয়ে চাষের কই মাছ কিনছিলেন রাজিয়া সুলতানা। পাশেই ছোট ছোট-বড় ইলিশ নিয়ে যে মাছের দোকানগুলো রয়েছে সেদিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না তিনি। ভরা মৌসুমে এবার ইলিশ কিনেছেন কি না? এ প্রশ্নের উত্তরে রাজিয়া সুলতানা জানান, এ বছর শুধু নয়, ঢাকায় আসার পর কখনোই তিনি ইলিশ মাছ কিনতে পারেননি।

“ছোট-খাটো কাজ করে তিনডে ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখায়ে ইলিশ মাছ কিনে ভাত খাবো এই সামর্থ্য আমাদের নাই ভাই। যা দুই চারানা আয় করি তা দিয়ে তো ঘর-ভাড়া আবার যাবতীয় খরচা-মরচা মিলায়া হয় না। যে ইনকাম তা দিয়ে ইলিশ মাছ কিনলে ভাত খাওয়া হবে না, ভাত খাইলে ইলিশ মাছ খাওয়া হবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন রাজিয়া সুলতানা।

রাজিয়া সুলতানা ঢাকা এসেছেন ২০১৪ সালে। তার তিন সন্তান, স্বামী অসুস্থ। চায়ের দোকান করে সংসার চালান। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের জন্য ইলিশ মাছ যে কতটা দুস্প্রাপ্য হয়ে গেছে তার একটা উদাহরণ ঢাকার রাজিয়া সুলতানা।

নিম্ন আয়ের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষও ইলিশ মাছ কিনতে হিমিশিম খাচ্ছে। বিশ বছর ধরে বাজারে মাছ বিক্রির সঙ্গে যুক্ত একজন ইলিশ বিক্রেতা বলেন, এখন যে দাম তাতে সাধারণ মানুষের পক্ষে সিজনে একটা বড় ইলিশ কিনে খাওয়াটাও কঠিন।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাব। ক্যাব-এর তথ্য অনুযায়ী ভরা মৌসুমে ২০১৪ সালে ৫০০-১০০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের গড় দাম ছিল ৫০৫ টাকা।

বর্তমান বাজারে সেটি কমবেশি ১৪শ টাকা। সুপারশপগুলোতেও এক কেজি সাইজের ইলিশের কেজি কমবেশি দুই হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারেও সাগর ও নদীর মাছভেদে ইলিশের কেজি ১৬শ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা। এবার ভরা মৌসুমে ইলিশের দাম নিয়ে ক্ষুব্ধ ক্রেতা বিক্রেতা সবাই।

ইলিশের দাম বেশি কেন

এ বছর ইলিশের দাম বেশি হওয়ার পেছনে সরকার, ইলিশ শিকারি এবং ব্যবসায়ীরা প্রধানত ইলিশের প্রাপ্যতাকেই দায়ী করছেন। নদ-নদীতে ইলিশ স্বল্পতার কথা উল্লেখ করে বিক্রেতারা বলছেন ভারতে রপ্তানির ঘোষণা দেয়ার পর দাম আরো বেড়েছে।

সরেজমিনে সোমবার চাঁদপুরে নদীতে ইলিশের নৌকায় গিয়ে দেখা গেল জালে ইলিশ ধরা পড়ছে কম। মৌসুমে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরার অভিজ্ঞতা ভুলতে বসেছেন বলে জেলেরা। এ মৌসুমে সর্বোচ্চ একদিনে ১৫ কেজি ইলিশ ধরতে পেরেছিলেন মোমিন সোহেল।

চাঁদপুর সোমবার জাল ফেলে ছোট আকারের কিছু ইলিশ আর একটি মাত্র এক কেজির উপরে ইলিশ ধরা পড়ে। জানতে চাইলে মি. সোহেল জানান ইলিশটি ২২-২৩শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হবে।

মোমিন সোহেল বলছেন, “ ইলিশ মাছ বাড়লেতো আর দাম থাকতো না। নদীতে নৌকা নামালে একদিনে খরচা নিম্নে তিন হাজার টাকা। মাছ পাই আর না পাই।” সাগরে কুড়ি বছর ধরে ট্রলারে নিয়ে মাছ ধরেন মুহাম্মদ দুলাল। তিনিও এবছর সাগরে মাছের ঘাটতির দিকটি সামনে আনেন।

“ইলিশের দাম না বাড়লে আমাগোতো তেলের দাম পোষাইতে হইবো। বারোদিন সাগরে ছিলাম। তিন লাখ টাকা খরচ। যে মাছ পাইছি ৪০ হাজার টাকা মন না বেঁচলে খরচা উঠবো না। গত বছর মৌসুমে ৮০ লাখ টাকা মাছ বেঁচা হইছে। এইবার ৩৫ লাখ টাকার। খরচ আছে চল্লিশ লক্ষ। নিষেধাজ্ঞা আসতেছে আর একবার সাগরে যাইতে পারবো।”

চাদপুর আড়তের একজন বিক্রেতা বলেন, গত সপ্তাহে এক কেজি ওজনের ইলিশ মানভেদে ১৬০০-১৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে যেটি এ সপ্তাহে উঠেছে ১৮০০-১৯০০ টাকা পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার চাদপুরে এক কেজি ওজনের ইলিশ মনপ্রতি ৭৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে বলে জানান পাইকাররা। মাছের সরবরাহ কম এবং চাহিদার কারণে ইলিশের দাম অত্যাধিক বলে দাবি বিক্রেতাদের।

অতীতে ইলিশের নৌকায় মাসোয়ারা, পুলিশের হয়রানির অভিযোগ ছিল সেগুলো এখন কমেছে বলে জানা যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের যারা আড়ত, ঘাট দখল সিন্ডিকেট করতো তারাও বেশিরভাগ এলাকা ছাড়া।

তাহলে এবার মাছের দাম বেশি কেন এ প্রশ্নে চাঁদপুর মাছের আড়তের ব্যবসায়ীরা মাছের ঘাটতিকেই সবচে বেশি দায়ী করেন। দীর্ঘদিন চাঁদপুরের মাছ ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন গাজী বলেন, “এই পরিমাণ দাম কোনো সময় হয়নাই এইবারই হইছে।”

আনোয়ার হোসেন গাজী ভারতে মাছ রপ্তানির সঙ্গেও যুক্ত। মাছের ঘাটতির মধ্যে রপ্তানির সিদ্ধান্ত প্রভাব ফেলেছে কিনা এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “বড় মাছ আপনি দেখেন, মাছই তো নাই। বড় মাছ খুব কম। মাছ না থাকলেতো বাড়বেই।”

এই ঘাটতির মধ্যে মাছ রপ্তানির ঘোষণায় বড় মাছগুলি বাছাই করে মজুদ করার ঘটনাও ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। আর মাছের যে মূল্য নির্ধারণের যে সিস্টেম সেটি অতীতের মতোই অব্যাহত রয়েছে যেখানে পরিবর্তন আসেনি।

শাহজাহান গাজী নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, রপ্তানির সিদ্ধান্তে বড় মাছের চাহিদা দাম দুটোই বেড়েছে। “বরগুনা, পাথরঘাটা, বরিশাল, কক্সবাজার, চিটাগাং যে যায়গায় মাছের আমদানি বেশি জেলেরা মাছটা নিয়ে আসে বেশি সবজায়গায় এলসির লোক আছে। ওই জায়গায় মাছটা নিয়ে যায়।”

বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে ইলিশের উৎপাদন প্রতিবছর বাড়লেও এবার আহরণ কমতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ গত বছর জুলাই আগস্টে বাংলাদেশে ইলিশ আহরণ হয় ৮১ হাজার ৮৭৬ মেট্রিক টন কিন্তু এবছর জুলাই আগস্টে ধরা পড়েছে বেশ কম। এবার ধরা পড়ার পরিমাণ ৫৬ হাজার ২৭৩ টন।

রপ্তানির সিদ্ধান্তে প্রভাব

বাংলাদেশ ভরা মৌসুমে স্বল্পতা এবং দেশের বাজারে গত এক দশকে কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ দামে বিক্রির মধ্যেই ভারতে ইলিশ রপ্তানি শুরু হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৪৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৫০ টন করে মোট ২৪২০ মেট্রিকটন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে।

যদিও মৎস ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতে ইলিশ রপ্তানির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। দেশের সাধারণ মানুষ ইলিশ খাবে তারপর রপ্তানির বিষয়ে বিবেচনার বিষয়ে ফরিদা আখতারের বক্তব্য অনেকে স্বাগত জানিয়েছিল।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতে ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্তের পর ইলিশের চাহিদা এবং দামে প্রভাব পড়েছে। সরকারের দাবি যে পরিমাণ ইলিশ ভারতে যাচ্ছে সেটি বাংলাদেশের মোট আহরণের হিসেবে সামান্য। কিন্তু এমন সময় মাছ রপ্তানি হচ্ছে যখন নদীতে ইলিশ কম পাওয়া যাচ্ছে।

এছাড়া ভারতে যে ইলিশ রপ্তানি হয় সেগুলো বড় সাইজের এবং নদীর মাছ বিধায় এই মাছের চাহিদা ও দাম দুটোই বেড়ে গেছে। ইলিশের দাম প্রসঙ্গে মৎস ও প্রাণীসম্পদ উপদেষ্টা বলেন,

“দাম যে যে কারণে বাড়ছে এই মন্ত্রণালয় সব কারণ খতিয়ে দেখবে এবং আমরা অন্যান্য মন্ত্রণালয় সবারই সহযোগিতা নেব। এই অঙ্গীকারটা আমাদের রাখতেই হবে যে দেশের মানুষকে ইলিশ খাওয়াতে হবে। এটা তাদের অধিকার। সেটা রক্ষা করার জন্য আমরা কাজ করবো।”

উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, “আহরণ কম প্রাপ্যতা কম এবং মানুষ খেতে পারছে না। এটা আমাদের দিক থেকে খুব দুঃখিত হব যদি আমরা এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি। কিন্তু আমাদের দিক থেকে একেবারে সর্বোচ্চ চেষ্টা আছে। রপ্তানির ঘোষণার আগে এক কেজি ওজনের মাছের দামটা পণেরশ টাকা ছিল এখন এটা ষোলশ সতেরশ টাকা শোনা যাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই হওয়া উচিৎ না।”

প্রাপ্যতার হৃাসের দিকটি তুলে ধরে ফরিদা আখতার বিবিসিকে বলেন, রপ্তানির বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। “এবার আহরণ কম সেই অর্থে এবার রপ্তানি না করলেই হতো। সেটা যে কারণেই হোক হচ্ছে। রপ্তানির প্রসঙ্গটা আমাদের মন্ত্রণালয়ের না। রপ্তানি করবে হলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আমাদের কথা হলো দেশের মানুষকে খাওয়ানো আমি এই কথাটায় এখনো আছি।”

ইলিশ কূটনীতি?

ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্তের পেছনে কূটনীতির ভূমিকা আছে কী না এমন প্রশ্ন অনেকের। বাংলাদেশ থেকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে নিয়মিত পূজা উপলক্ষ্যে ইলিশ রপ্তানি হয়েছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বিবিসিকে বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের ইলিশের খুব চাহিদা। অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশ থেকে ভারতে ইলিশ যায়। মি. কবির বলছেন বাংলাদেশ থেকে প্রথম ইলিশ রপ্তানি হয় ১৯৯২ সালে।

“তখন প্রণব মুখার্জী ছিলেন আমার যেটুক মনে পড়ে প্লানিং মিনিস্টার। তখন উনি পাঁচ হাজার টনের পারমিট দিয়েছিলে যে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা যায়। কলকাতায় এটার খুব ডিমান্ড। ৯২’তে আমি কলকাতায় কাজ করি তখন আমি প্রথম ইলিশ রিসিভ করি ওইদিক থেকে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশন কলকাতা আর এদিক থেকে ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন মিজ ত্রিপাটি তো আমরা দুজনে বেনাপোলে এক্সচেঞ্জ করলাম ব্যাক ইন নাইনটিন নাইনটি টু।”

ভারতে ইলিশ রপ্তানির বিপক্ষে মৎস উপদেষ্টার অবস্থান এবং বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃস্থানীয় ছাত্র নেতারাও ভারতের বিষয়ে একটা কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের প্রেক্ষাপটে ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্তের আলাদা অর্থ খুঁজছেন অনেকে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভারতে ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত একটা কূটনৈতিক তাৎপর্য বহন করছে বলেও মনে করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং কূটনৈতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবির বলেন, একটা মেজেসতো আছেই।“আমাদের দিক থেকে আমরা একটা তাদেরকে একটা শুভেচ্ছা দেখালাম আশা করি তারাও এই শুভেচ্ছাটাকে ফেরত দেবে বা সেভাবে রিসিপ্রোকেট করবে। এটা একটা কূটনীতিক খুব সাটল কূটনীতিক একটা আপনি বলতে পারেন যে ইঙ্গিত হিসেবে তারা যদি নিতে চায়। কিন্তু ভারতের সাম্প্রতিক কথাবার্তা বা তাদের নেত্রিবৃন্দের কাছ থেকে যে ধরনের বক্তব্য আসছে সেটা কিন্তু খুব সুখকর মনে হচ্ছে না।”

তবে ইলিশ রপ্তানির কূটনীতি প্রসঙ্গে মৎস উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, “গত সরকারের আমলে কিছু ঘটনা ঘটে গেছে যে তিস্তার পানি পেতে হলে কিছু ইলিশ দিয়ে ওদেরকে সন্তষ্ট করা যায় কিনা। আসলে মাছটা বা মাছ খায় কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ। সারা ভারত কিন্তু খায় না। এটা এমন বড় ধরনের ইস্যু হওয়া উচিৎ না ডিপ্লোমেটিক্যালি।”

r1 ad
r1 ad