top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

‘ফ্যাসিস্টদের’ প্রচারণা নিয়ে আইনে আসলে কী আছে? বিতর্ক কোথায়

‘ফ্যাসিস্টদের’ প্রচারণা নিয়ে আইনে আসলে কী আছে? বিতর্ক কোথায়

নিষিদ্ধ সংগঠন ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ প্রচার প্রচারণা বিষয়ে মিডিয়ার প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টার হুঁশিয়ারি নিয়ে নানান আলোচনা ও বিতর্ক দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের বক্তব্যকে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীদের কেউ কেউ।

সম্প্রতি তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন, “যারা মিডিয়ায় নিষিদ্ধ সংগঠন, গণহত্যার আসামি ও ফ্যাসিস্টদের প্রচার প্রচারণা করার সুযোগ করে দিবে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

মি. ইসলামের এই ঘোষণা “জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সাথে যায় কি না,” সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। কারণ গত জুলাই-অগাস্ট মাসে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অংশগ্রহণে যে মাসব্যাপী আন্দোলন হয়েছিলো, সেখানের অন্যতম প্রধান দুই দাবি ছিল ‘বাক স্বাধীনতা ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠন’।

কিন্তু তথ্য উপদেষ্টার ফেসবুক পোস্ট থেকে সেই দুই দাবির প্রতিফলন ঘটছে না বলেন মনে করেন বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মীদের কেউ কেউ। ‘এখনও সেই একই ধরনের ঘটনা আমরা প্রত্যাশা করি না। গণতান্ত্রিকভাবে, সুষ্ঠু স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম চলুক, আমরা তা চাই,’ বলছিলেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।

একে মিডিয়ার জন্য হুমকি বলে মনে করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন। ‘এখানে শুধুমাত্র নিষিদ্ধ সংগঠনের কথা বলা হয়নি। যারা ফ্যাসিস্ট বা গণহত্যার সাথে জড়িতদের কথাও বলা হয়েছে,’ বলছিলেন তিনি।

মি. ইসলামের বলা ‘নিষিদ্ধ সংগঠন, গণহত্যার আসামি ও ফ্যাসিস্ট’ সম্বন্ধে আইনে আসলে কী আছে? এ বিষয়ে আইনজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরাই বা কী বলছেন?

‘অভিযুক্তকেও বলতে দিতে হবে’

বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, নাহিদ ইসলামের ওই ঘোষণা আসলে “স্পষ্ট হুঁশিয়ারি”। তার ওই ঘোষণাকে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেওয়া বিভিন্ন ঘোষণা বা সেই আমলে হওয়া বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সাথে তুলনা করতেও দেখা যাচ্ছে।

“স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে উঠে আসা একজন তথ্য উপদেষ্টা কেন এমন ঘোষণা দিবেন, যা আসলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিপরীতে যায়?” কেউ কেউ এই প্রশ্ন করছেন।

“প্রচার প্রচারণা” দিয়ে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন? এর অর্থ কি এমন যে গণমাধ্যম তাদের কোনও খবর প্রচার করতে পারবে না? নাকি, ওই তিন শ্রেণির কারও সাথে “কোনোকিছু নিয়েই” কথা বলতে পারবে না গণমাধ্যম?

এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে বিবিসি বাংলা মি. ইসলামের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। তবে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তার ফেসবুক পোস্টে তিনি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কথা লিখেছেন। বলছেন, আওয়ামী লীগ “সন্ত্রাসী” কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি “সুশীল, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের দিয়ে ফ্যাসিবাদের বয়ান ও বৈধতা তৈরি করে।”

তার মতে, এই দলের “কুখ্যাত প্রোপাগান্ডিস্টরা (অপপ্রচারকারীরা) নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নৃশংস খুনী নেতাদের জনপরিসরে হাজির” করেছে। তারপর এখন সেটিকে “নরমালাইজ (স্বাভাবিক) করতে বিভিন্ন মিডিয়া প্লাটফর্ম ও সাংবাদিকরা উদ্যোগ নিচ্ছে।”

এসব করে কোনও লাভ হবে না জানিয়ে তিনি আরও যোগ করেন, “রক্তের উপর দিয়ে আওয়ামী লীগের পতন ঘটেছে। আওয়ামী সিম্পেথাইজাররা এটা যত দ্রুত মেনে নিবে…তত মঙ্গল।” আইনজীবী থেকে শুরু করে মানবাধিকার কর্মী কিংবা শিক্ষক, অনেকেই মনে করছেন যে নাহিদ ইসলামের এমন বক্তব্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অন্তরায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন এ প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে বলেন, নাহিদ ইসলামের ওই বক্তব্য ‘মিডিয়ার জন্য হুমকি। এখানে শুধুমাত্র নিষিদ্ধ সংগঠনের কথা বলা হয়নি। যারা ফ্যাসিস্ট বা গণহত্যার সাথে জড়িতদের কথাও বলা হয়েছে।’

মিডিয়ার ওপর খবরদারি, হুমকি তৈরি করা বা মিডিয়ার স্বাধীনতাকে হস্তক্ষেপ করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন যে ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাকে বলতে দিতে হবে।’

বেসরকারি চ্যানেল একুশে টেলিভিশনে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের ‘মিথ্যা, বানোয়াট ও উসকানিমূলক’ বক্তব্য প্রচারের অভিযোগে ২০১৫ সালে মি. রহমানসহ প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবদুস সালাম ও দু'জন সংবাদকর্মীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়েছিলো।

সেই ঘটনাকে মনে করিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বিবিসি বাংলাকে বলেন, "টকশো নিয়ে এরকম ঘটনা তো এর আগেও আমরা ইটিভিতে তারেক জিয়ার বক্তব্য প্রচারের পর দেখেছি। কিন্তু এখনও সেই একই ধরনের ঘটনা আমরা প্রত্যাশা করি না। গণতান্ত্রিকভাবে, সুষ্ঠু স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম চলুক, আমরা তা চাই।"

নিষিদ্ধ সংগঠনের ব্যাপারে যা আছে আইনে

গণমাধ্যমে ‘নিষিদ্ধ সংগঠন, গণহত্যার আসামি ও ফ্যাসিস্টদের প্রচার’ নিয়ে আলাপ-আলোচনা বা তর্ক-বিতর্কের সূত্রপাত যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীনের সঞ্চালিত একটি টকশোকে ঘিরে।

সেই অনুষ্ঠানেই গত সাতই নভেম্বর রাতে অতিথি হিসাবে যুক্ত থাকার কথা ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের। কিন্তু সাদ্দাম হোসেনের অতিথি হয়ে আসার ঘোষণার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা বিষয়টিকে ঘিরে ফেসবুকে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন।

এক পর্যায়ে নিজের ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকে সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে প্রোগ্রাম স্থগিতের ঘোষণা দেন মি. মুহিউদ্দিন। স্থগিতের কারণ হিসাবে সেখানে আইনি জটিলতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

কী ধরনের জটিলতা আছে, জানতে একাধিক আইনজীবীর সাথে এ নিয়ে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা। তারা সকলেই বলেছেন, যেসব আইনের ভিত্তিতে গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হয়, সেই আইনগুলোই প্রশ্নবিদ্ধ।

প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবির মুখে গত ২৩শে অক্টোবর রাতে ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯’ এর ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ও সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

ওইসময় ওই দাবি বাস্তবায়নের জন্য তারা সরকারকে এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দিয়েছিলো। কিন্তু তাদেরকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। সময় শেষ হওয়ার আগেই সরকার তাদের দাবি মেনে নেয়।

এক্ষেত্রেও ঠিক তেমন চিত্রই দেখা গেছে। সমন্বয়করা ওই টকশো'র বিষয়ে আপত্তি জানানোর পর সরকারের তরফ থেকে তথ্য উপদেষ্টাও একই ধরনের ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন।

নিষিদ্ধ সংগঠনের বক্তব্য প্রচারের ক্ষেত্রে ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪’, ‘পেনাল কোড ১৮৬০’ - এর একাধিক ধারা এবং ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯’ - এর অধীনে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার বা জটিলতা তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে।

যে আইনের অধীনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হলো, তার ধারা নয় অনুযায়ী, "যদি কোনও ব্যক্তি ধারা ১৮-এর অধীন কোনও নিষিদ্ধ সত্তাকে সমর্থন করিবার উদ্দেশ্যে কাহাকেও অনুরোধ বা আহ্বান করেন, অথবা নিষিদ্ধ সত্তাকে সমর্থন বা উহার কর্মকাণ্ডকে গতিশীল ও উৎসাহিত করিবার উদ্দেশ্যে কোনও সভা আয়োজন, পরিচালনা বা পরিচালনায় সহায়তা করেন, অথবা বক্তৃতা প্রদান করেন, তাহা হইলে তিনি অপরাধ সংঘটন করিবেন।"

শুধু তাই নয়, "যদি কোনও ব্যক্তি কোনও নিষিদ্ধ সত্তার জন্য সমর্থন চাহিয়া অথবা উহার কর্মকাণ্ডকে সক্রিয় করিবার উদ্দেশ্যে কোনও সভায় বক্তৃতা করেন অথবা রেডিও, টেলিভিশন অথবা কোনও মুদ্রণ বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কোনও তথ্য সম্প্রচার করেন, তাহা হইলে তিনি অপরাধ সংঘটন করিবেন।"

এখানে সত্তা মানে মূলত সংগঠনই। ২০০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরি অবস্থার মধ্যে যে অধ্যাদেশ জারি করেছিলো, পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তা ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন’ হিসাবে সংসদে পাশ হয়। ২০১৩ সালে এই আইনের সংশোধনের সময় এই শব্দগত পরিবর্তন করা হয়।

এই আইনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন যে আওয়ামী লীগ সরকার এই আইন দিয়েই বিরোধী দলকে মিছিল-আন্দোলন করতে দিতো না।

তিনি এও বলেন, “সংগঠন নিষিদ্ধ হলেও ব্যক্তি নিষিদ্ধ হতে পারে না, সে যত ঘৃণিত হোক না কেন। তবে কেউ দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর এরকম প্রচার করাটা সুপ্রিম কোর্টের আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ।”

“আর, সংগঠন নিষিদ্ধ হলে সংগঠনের কোনও ব্যক্তি সংগঠন সংক্রান্ত কথা না বলে নিজস্ব কথা বলতে পারবেন। কিন্তু এখানে সমস্যা হলো, ছাত্রলীগের একজন নেতা ছাত্রলীগ সম্বন্ধেই বলবে। তাই সে নিষিদ্ধের মাঝে পড়ে যাচ্ছে। চাইলে সে অন্য কিছু বলতে পারবে। কিন্তু সে দলীয় কর্মকাণ্ডকে জাস্টিফাই করে কিছু বলতে পারবো না,” যোগ করেন মি. করিম।

মি. করিম আরও যোগ করেন, “যদি কোনও ব্যক্তি এমন কোনও কর্মকাণ্ড করে, যা সন্ত্রাসের পর্যায়ে পড়ে এবং তিনি যদি তার বক্তব্যে এমন কিছু বলেন যা প্রচার হলে দেশের শৃঙ্খলা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে…সেরকম হলে পেনাল কোডের অধীনেও অপরাধ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”

'পেনাল কোড, ১৮৬০' - এর ধারা ১২১ (ক), বিশেষত ১২৪ (ক) - তে রাষ্ট্রদ্রোহের কথা বলা আছে। ১২৪ (ক) ধারার নাম-ই ‘সিডিশন’ বা বিদ্রোহপূর্ণ আচরণ বা বিদ্রোহ। এ​​ই ধারায় বলা আছে যে কোনও ব্যক্তি যদি কোনোভাবে আইনসঙ্গতভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা অবজ্ঞা সৃষ্টি করে; অথবা, সৃষ্টি করার চেষ্টা করে; অথবা, সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরি করতে অন্যকে প্ররোচিত করে বা প্ররোচিত করার চেষ্টা করে, তাহলে তার সেই কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে।

আইনজীবী মি. করিম বলেন, কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের বা সংগঠনের কর্মীর বক্তব্য প্রচার করলে সেটি ঘিরে জনআক্রোশের সৃষ্টি হতে পারে। অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে। ‘তাই, এই ধরনের (নিষিদ্ধ সংগঠনের) বিষয়গুলো সাংবাদিক বা অন্য কোনও ব্যক্তি সামনে আনলে সেও (ওই অপরাধের) সহযোগী হয়ে যেতে পারে।’

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঠিক এই কাছাকাছি কারণে বা সরকারের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনও বক্তব্য প্রচারের কারণে অনেকের নামে মামলা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। রইল বাকি ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪’। এই আইনের ধারা তিনের কারণে আইনি জটিলতা হতে পারে।

এতে রাষ্ট্র-বিরোধী কার্যকলাপের সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং প্রতিরক্ষা বিরোধী কার্যকলাপ, বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষতি সাধন, জন নিরাপত্তা বিরোধী কাজ করা, জনসাধারণের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা-সহ নানা বিষয়।

এছাড়াও, জনগণের মধ্যে বা জনগোষ্ঠীর কোনও অংশের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টি করা, দেশের আইন ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় বাধা দেয়া এবং দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করা রাষ্ট্র-বিরোধী কার্যকলাপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

‘বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী কিছু কার্যকলাপ প্রতিহত করার জন্য’ ১৯৭৪ সালের নয়ই ফেব্রুয়ারি এই আইন করা হয়। পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইন ১৯৫২, জন নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ এবং ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ তফসিলি অপরাধ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশকে প্রতিস্থাপনের জন্য আইনটি পাশ করা হয়েছিল।

‘এই আইন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও কোনও সরকারের আমলেই সেই আইনকে বাতিল করা হয়নি। বরং, যে যখন ক্ষমতায় এসেছে, এই আইনটি তার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে,’ বলছিলেন মি. করিম।

এই আইনগুলোতে দেশের শান্তিশৃঙ্খলার কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। এটি আসলে কী? উত্তরে আহসানুল করিম বলেন, “পাবলিক পিস (জনগণের শান্তি) কী, তা আবার সরকার ঠিক করবে।”

দ্বন্দ্ব ও দ্বিমত যেখানে

নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, গণহত্যার আসামি ও ফ্যাসিস্টদের প্রচার প্রচারণা করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু আইনজীবীরা বলছেন, গণহত্যার আসামিরা সাক্ষাৎকার দিতে পারবেন না, আইনে এমন কিছু নেই এবং, আইনে ফ্যাসিস্ট বলে কোনও শব্দ নাই।

আইনজীবী মি. করিম বলেন, ‘গণহত্যার আসামি হলে ইন্টার্ভিউ দেওয়া যাবে না, তা না। এর আগে হাইকোর্ট এক আদেশে বলেছিলো, একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কোনও রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে পারবে না।’

ফ্যাসিস্ট প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, "সংবাদমাধ্যম সংবাদ প্রচার করে, তৈরি করে না। এখন, একটি ফ্যাসিস্ট সংগঠন কোথাও গিয়ে মিছিল করলো। সেই মিছিলের সংবাদ পরিবেশন করাটা সংবাদমাধ্যমের কাজ। সেই সংবাদ প্রচার না করা তথ্য গোপন হয়ে গেল।"

তাই, "এখানে এই পার্থক্য বোঝা দরকার যে কোনটা অপরাধের উদ্দেশ্যে কাজ, কোনটা সংবাদমাধ্যমের কাজ। সংবাদমাধ্যম যদি এমন কোনও কর্মকাণ্ড প্রচার করে, যা থেকে বোঝা যায় যে তা খবর তৈরির চেষ্টা করছে বা কাউকে সহযোগিতা করছে, তাহলে সেই সংবাদমাধ্যম আইনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব," যোগ করেন তিনি।

প্রায় কাছাকাছি ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন। তিনি গণহত্যা প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী'র ভূমিকার কথা তুলে ধরেন।

‘গণহত্যায় জড়িত থাকার দল আরও আছে আমাদের দেশে। জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে… আওয়ামী লীগ যা করেছে, ছাত্রলীগ যা করেছে, তাদের বিচারের জন্য হলেও তাদেরকে আলোচনায় আনতে হবে। তাদের যে কর্মকাণ্ড, তাদের জবাবদিহির জন্য মিডিয়ায় তাদের বক্তব্য শুনতে হবে। তা না করে (নাহিদ ইসলামের) এই ধরনের ঘোষণা বাকস্বাধীনতা বা সংবাদ মাধ্যমের ওপর হুমকিস্বরূপ।’

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলছেন, ‘নিষিদ্ধ বা ফ্যাসিস্টদের সংগঠনের কারও ওপরও যদি অবিচার মামলা অত্যাচার নিপীড়ন হয়, সেই ব্যাপারে মানবাধিকার কর্মীরা কথা বলবে, সাংবাদিকরা তথ্য প্রচার করবে, এটা একেবারেই স্বাভাবিক। এখানে আইন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত করার সুযোগ নেই।’

‘যখন কাউকে নির্যাতন করা হয় বা হুমকি দেওয়া হয়, সেটিও তো ফ্যাসিস্টসুলভ কার্যক্রম। সেক্ষেত্রে সরকারের কোনও পর্যায় থেকেই এই ধরনের কথাবার্তা প্রত্যাশা করছি না আমরা মানবাধিকার কর্মীরা। গত অগাস্ট মাসে যে গণঅভ্যুত্থান, এটি তো কথা বলার জন্যই। এটি তো স্বাধীনতা ভোগ করার জন্যই। কোনোভাবে স্বাধীনতাকে সীমিত করা বা মানুষের কণ্ঠরোধ করার জন্য এই গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়নি,’ বলছিলেন মি. খান।

r1 ad
r1 ad