top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফরকে ঘিরে যা ঘটেছিল

বিক্ষোভকারীর প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘গো ব্যাক কিলার ভুট্টো’
জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশে আসার পর তাকে ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নেন শেখ মুজিবুর রহমান

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করার দুই বছরেরও বেশি সময় পর ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল পাকিস্তান। এ ঘটনার মাত্র চার মাসের মাথায় শতাধিক ব্যক্তির বিশাল এক বহর নিয়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। স্বাধীন বাংলাদেশে সেটিই ছিল পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর।

যদিও মি. ভুট্টো এর আগেও ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৭১ সালের মার্চে, যখন তিনি পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা। তিনি ঢাকায় থাকা অবস্থাতেই পাকিস্তানি সেনারা 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে সামরিক অভিযান চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছিল।

ওই ঘটনার পরদিন, অর্থাৎ ২৬শে মার্চ মি. ভুট্টো ঢাকা ত্যাগ করে করাচি যান এবং সাংবাদিকদের বলেন, ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ, পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।’ বস্তুত, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে মি. ভুট্টোর অবস্থান ছিল বেশ স্পষ্ট। এমনকি যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ১৯৭২ সালে তিনি কমনওয়েলথ থেকে পাকিস্তানকে সরিয়েও নিয়েছিলেন।

ফলে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী মি. ভুট্টোর সফরকে কেন্দ্র করে তখন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া যেমন দেখা গিয়েছিল, তেমনি ঘটেছিল নাটকীয় নানা ঘটনাও।

বিশেষ করে, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার তখন যেভাবে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে ব্যাপক আয়োজন করে মি. ভুট্টোকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, তৎকালীন সংবাদপত্রে সেটিকে 'অভূতপূর্ব' বলে বর্ণনা করা হয়েছিল।

তবে ঢাকা সফরকালে মি. ভুট্টোকে বিক্ষোভের মুখেও পড়তে হয়েছিল। এছাড়া স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মাথার টুপি না খোলায় সমালোচনাও কুড়িয়েছিলেন তিনি।

অন্য দিকে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের ওপর চালানো নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনায় ‘তওবা’ বা অনুশোচনা প্রকাশ করে সেটির জন্য এককভাবে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসকদের দায়ী করেন মি. ভুট্টো। ওই ঘটনাকে ‘বেদনাদায়ক’ বর্ণনা করে সেটির ইতি টেনে দু'দেশের মধ্যে স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনেরও আহ্বান জানান তিনি।

তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অবিভক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ভাগ চাইলে সেটি অবশ্য তখন বুঝিয়ে দিতে রাজি হননি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ফলে অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানে দফায় দফায় বৈঠক করার পরও দু'দেশের আলোচনা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।

এসব ঘটনার সবই তখনকার জাতীয় পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল। চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক, স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মি. ভুট্টোর প্রথম সফরকে ঘিরে সে সময় ঠিক কী কী ঘটনা ঘটেছিল?

কড়া নিরাপত্তায় উষ্ণ অভ্যর্থনা

পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বিশেষ একটি বিমানে করে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় পৌঁছান ২৭শে জুন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে। সে সময় তাকে বেশ ঘটা করে স্বাগত জানানো হয়েছিল বলে ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় পত্রিকাগুলোর খবরে বলা হয়েছে।

কড়া নিরাপত্তার মধ্যে মি. ভুট্টোকে সেদিন যেভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল, সেটি তুলে ধরতে ২৮শে জুন দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় আট কলামব্যাপী প্রধান শিরোনাম করা হয়েছিল ‘ঢাকায় ভুট্টোর অভূতপূর্ব সম্বর্ধনা’।

১৯৭৪ সালের ২৮ জুন বাংলাদেশের অধিকাংশ জাতীয় পত্রিকায় প্রধান শিরোনামে হয়েছিল মি. ভুট্টোর ঢাকা সফর নিয়ে

অন্যান্য পত্রিকাগুলোতেও খবরটি প্রথম পাতায় বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতার খবরের শিরোনাম ছিল 'ঢাকায় ভুট্টোর আন্তরিক অভ্যর্থনা'। খবরে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নিজে সেদিন ঢাকা বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।

মি. ভুট্টো যখন বিমান থেকে নামছিলেন তখন ১৯ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানানো হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে।

‘সবার আগে বাংলার মাটিতে তাঁহাকে স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনাব ভুট্টো তাঁহাকে জড়াইয়া ধরেন ও কোলাকুলি করেন,’ ২৮শে জুন প্রকাশিত ইত্তেফাকের খবরে বলা হয়েছে।

পরে মি. ভুট্টোকে বিমানবন্দরে তৈরি অভ্যর্থনা মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা তাকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পাশাপাশি বাজানো হয় দেশটির জাতীয় সংগীতও।

মি. রহমান ছাড়াও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলের নেতারা ওইদিন বিমানবন্দরে উপস্থিতি ছিলেন। ঢাকায় অবস্থিত বেশ কয়েকটি কূটনৈতিক মিশনের প্রধানরাও সেদিন বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ভারতীয় হাই কমিশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান জেএন দীক্ষিতও ছিলেন।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে গোটা বিমানবন্দর এলাকায় কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। নিরাপত্তা এতটাই জোরদার করা হয়েছিল যে, সাংবাদিকরা পর্যন্ত দূরে দাঁড়িয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে তখনকার একাধিক পত্রিকার খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।

মি. ভুট্টোকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরের বাইরেও অনেক মানুষ সমবেত হয়েছিল। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মি. রহমানের সঙ্গে একই গাড়িতে উঠে মি. ভুট্টো বঙ্গভবনের উদ্দেশে রওনা হন বলে দৈনিক আজাদের খবরে বলা হয়েছে।

তখন বিমানবন্দর থেকে বঙ্গভবন পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ রাস্তার দু'পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কিছু মানুষ তখন মি. ভুট্টোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভও করেছিলেন।

ভুট্টোর সম্মানে নৈশভোজ

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আসার পর ২৭শে জুন রাতে তার সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। ভোজসভাটির আয়োজন করা হয়েছিল বঙ্গভবনে। সভায় অংশ নিয়ে সেই রাতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দুই প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেটি ধরেই পরের দিন ঢাকার বেশিরভাগ পত্রিকায় প্রধান শিরোনাম করা হয়েছিল।

এর মধ্যে দৈনিক বাংলার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘আসুন, নব অধ্যায়ের সূচনা করি’। খবরটিতে বলা হয়েছে যে, বিদ্বেষ ও তিক্ততা ভুলে গিয়ে দু'দেশের ‘দুঃখী’ মানুষের স্বার্থে সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মি. রহমান।

এক্ষেত্রে সম্পর্ক উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয়গুলো, বিশেষত অবিভক্ত পাকিস্তানের দায় ও সম্পদের বন্টন, বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের প্রত্যাবর্তন প্রশ্নের সুরাহা করা প্রয়োজন বলে ভাষণে উল্লেখ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

অন্যদিকে, মি. ভুট্টো তার ভাষণে ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে ‘ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর ও লজ্জাকর অধ্যায়’ মন্তব্য করেন। পাকিস্তানের সরকার ও জনগণ ‘বেদনাদায়ক’ ওই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি কামনা করে দু'দেশে মধ্যে ‘স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্বসুলভ’ সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী বলে জানান তিনি।

স্মৃতিসৌধে ভুট্টো

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সফরের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ২৮শে জুন সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে যান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মি. ভুট্টো।

সে দিন সকাল দশটার দিকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে স্মৃতিসৌধে পৌঁছান। হেলিকপ্টার থেকে নামার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমদ তাকে স্বাগত জানান।

এরপর মি. আহমদকে সঙ্গে নিয়েই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। স্মৃতিসৌধের আশপাশের এলাকায় তখন মি. ভুট্টোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছিল।

এ অবস্থায় ফুল দেওয়ার পর স্মৃতিসৌধ এলাকা ত্যাগ করার জন্য পাকিস্তানের এই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বেশ তাড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো বলেও পত্রিকার খবর থেকে জানা যাচ্ছে। এছাড়া ফুল দেওয়ার সময় মি. ভুট্টো নিজের মাথায় থাকা টুপি খোলেননি বলেও খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণের পরমুহূর্তেই জনাব ভুট্টো তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগের জন্য পা বাড়ান। কিন্তু বাংলাদেশের একজন প্রোটোকল অফিসার এসে তাঁর হাত ধরে জানান যে আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়নি। এরপর সেনাবাহিনীর ব্যান্ডে করুণ সুর বাজানো হয় এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত হয়ে আসে। জনাব ভুট্টো টুপি না খুলেই দাঁড়িয়ে থাকেন,’ ২৯ জুন দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে।

শ্রদ্ধা নিবেদনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে স্মৃতিসৌধে রাখা স্মরণী খাতায় কোনো মন্তব্য না লিখে মি. ভুট্টো দ্রুত হেলিকপ্টার গিয়ে ওঠেন বলেও বার্তা সংস্থা এনার বরাত দিয়ে খবর প্রকাশ করে দৈনিক বাংলা-সহ বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র। সফরের শেষদিনে এ বিষয়ে সাংবাদিকরা স্মৃতিসৌধে যাওয়ার অভিজ্ঞতার বিষয়ে প্রশ্ন করলে মি. ভুট্টো বলেছিলেন, ‘সেটি ছিল একটি পবিত্র মুহূর্ত।’

গণহত্যা প্রশ্নে ভুট্টোর ‘তওবা’

সফরের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ২৮শে জুন বিকেলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বঙ্গভবনে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে ভাষণ প্রদানকালে মি. ভুট্টো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনায় দুঃখ ও অনুশোচনা প্রকাশ করেন বলে পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে।

দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় মি. ভুট্টো বক্তব্য তুলে ধরে হয়েছে এভাবে, ‘আমরা সকলেই নির্যাতনের শিকারে পরিণত হইয়াছি। দেশ বিভক্ত হইয়াছে, ঐক্য বিনষ্ট হইয়াছে। অনেক দেরি হইয়াছে সত্য, কিন্তু তওবার সময় এখনও অতিক্রান্ত হয় নাই।’

মি. ভুট্টো আরও বলেন, পাকিস্তানের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে স্বীকার এবং শ্রদ্ধা করে। ‘যা হয়েছে তা নিয়ে অন্তর থেকে অনুতপ্ত হতে বা তওবা করতে দেরি হয়ে যায়নি। পাকিস্তানের মানুষ আপনাদের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানায়। তারা এবং পাকিস্তানের সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে স্বীকার করে এবং শ্রদ্ধা জানায়।’

ওই ভাষণে একাত্তরে গণহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনার জন্য একতরফাভাবে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসকদের দায়ী করেন মি. ভুট্টো। ‘ক্ষমতালোভী একনায়কদের অপরাধ ও পাপের জন্য আমাদের দায়ী করিবেন না। যাহারা আপনাদের ও আমাদের শাসন করিয়াছে, তাহাদের সহিত আমাদের এক করিয়া দেখিবেন না,’ বলেন মি. ভুট্টো।

ওই ঘটনায় নিজের কোনো হাত ছিল না এবং কখনোই সামরিক সরকারের পক্ষ নেননি বলে দাবি করেন পাকিস্তানের এই প্রধানমন্ত্রী। ‘বাংলাদেশের জনগণের নিকট আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি যে, আমাদের উপর যে বিপর্যয় নামিয়া আসিয়াছিল, উহা প্রতিরোধের জন্য আমি আমার ক্ষমতা অনুযায়ী সাধ্যমত চেষ্টা করিয়াছি,’ ভাষণে বলেন মি. ভুট্টো।

তাকে উদ্ধৃত করে ইত্তেফাক পত্রিকায় আরও লেখা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বার বার আহ্বান জানাইয়াছিলাম। কেবল আমারই নয়, দেশ-বিদেশে পাকিস্তানের সকল বন্ধুরই পরামর্শ উপেক্ষা করা হয়।’

মি. ভুট্টো যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, মন্ত্রিসভার সদস্যরা ছাড়াও ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মি. ভুট্টোর এই ভাষণ নিয়ে পরের দিন, অর্থাৎ ২৯শে জুন প্রকাশিত দৈনিক বাংলার খবরে লেখা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত কোনও কোনও অভিযোগ খন্ডনের আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তিনি মারাত্মকভাবে ইতিহাস বিকৃত করেন।’

সাংবাদিকদের তোপের মুখে ভুট্টো

সফরের শেষ দিনে ঢাকা ছাড়ার আগে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মি. ভুট্টো। সেখানে তাকে বেশ তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল বলে তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকার খবর থেকে জানা যাচ্ছে। এ নিয়ে পরের দিন, অর্থাৎ ৩০শে জুন দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় যে সংবাদ বের হয়েছিল, সেটির শিরোনাম ছিল ‘প্রশ্নবাণে জর্জরিত প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো’।

সেখানে বলা হয়েছে যে, ওই সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর সঙ্গে জড়িত পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হবে কি-না, সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন রাখেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে। এর জবাবে মি. ভুট্টো জানিয়েছিলেন, যাতে ন্যায়বিচার হয় সেটার প্রতি তিনি লক্ষ্য রাখবেন।

এরপর সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন যে, সত্যিই যদি তিনি গণহত্যায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চান, তাহলে ‘গণহত্যার জন্য দায়ী’ ব্যক্তিরা এখনও কেন পাকিস্তান সরকারের উচ্চপদে রয়েছেন? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর অবশ্য মি. ভুট্টো তখন দিতে পারেননি। বিষয়টিকে পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়’ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি।

এছাড়া ওই ধরনের প্রশ্ন না করার জন্য সাংবাদিকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন মি. ভুট্টো। প্রশ্নটি ‘উসকানিমূলক’ মন্তব্য করে তিনি আরো বলেছিলেন যে, ওই ধরনের প্রশ্ন করার অর্থ পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ’ করা।

এর আগের দিন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মি. ভুট্টো দাবি করেছিলেন যে, তিনি কখনোই পাকিস্তানের সামরিক সরকারের পক্ষে কাজ করেননি। তার সেই বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সাংবাদিকরা।

তারা জানতে চান, সত্যিই যদি সামরিক সরকারের পক্ষে না থাকতেন তাহলে মি. ভুট্টো ১৯৭১ সালে কেন ইয়াহিয়া সরকারের দূত হয়ে চীনে গিয়েছিলেন এবং কেন জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের পক্ষ নিয়েছিলেন?

জবাবে মি. ভুট্টো বলেছিলেন যে, একজন ‘দেশপ্রেমিক’ নাগরিক হিসেবে পাকিস্তান ভেঙে যাক সেটা তিনি চাননি। সেই কারণেই তখন তাকে ওইসব কাজ করতে হয়েছিল বলে দাবি করেন তিনি।

ভুট্টোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ

বাংলাদেশে আসার পর দু'দফায় বিক্ষোভের মুখে পড়েন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মি. ভুট্টো। তার বিরুদ্ধে প্রথম দফায় বিক্ষোভ দেখা যায় ঢাকা বিমানবন্দরে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যারা পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং যারা স্বজন হারিয়েছেন, তারাই এই বিক্ষোভে অংশ নিয়ে মি. ভুট্টোকে নিজ দেশে ফিরে যেতে বলেন।

এ ঘটনার পরের দিন মি. ভুট্টো দ্বিতীয় দফায় বিক্ষোভের মুখে পড়েন সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে। তিনি সেখানে পৌঁছানোর আগেই হাজারো মানুষ কালো পতাকা হাতে স্মৃতিসৌধ এলাকায় অবস্থান নেয় বলে তখনকার পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে।

মি. ভুট্টোকে বহনকারী হেলিকপ্টার স্মৃতিসৌধে পৌঁছানো পর স্লোগানে স্লোগানে তাকে পাকিস্তানে ফিরে যেতে বলেন বিক্ষোভকারীরা। তখন মি. ভুট্টোকে তারা ‘খুনি, ঘাতক এবং কসাই’ সম্বোধন করেন। বিক্ষোভকারীদের অনেকেই প্ল্যাকার্ড নিয়ে এসেছিলেন, যাতে ‘গো ব্যাক কিলার ভুট্টো’, ‘স্মৃতিসৌধের অবমাননা বাঙালিরা সইবে না’ সহ বিভিন্ন কথা লেখা ছিল।

একপর্যায়ে নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে বিক্ষোভকারীরা ভুট্টোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা লাঠিচার্জ করে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে অনেকেই আহত হন। এছাড়া বিক্ষোভকারীদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছিল বলে দৈনিক গণকণ্ঠের খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘ভুট্টো মোদের ফিরিয়ে নাও’

মি. ভুট্টোকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরের বাইরে যারা একত্র হয়েছিলেন, তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ‘বাংলাদেশে আটকে-পড়া পাকিস্তানি নাগরিকরা’ ছিলেন বলে তখনকার পত্রিকার খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে তারা সেসময় 'ভুট্টো মোদের ফিরিয়ে নাও'-সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে বলে খবরে বলা হয়েছে।

এক পর্যায়ে তারা নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে বিমানবন্দরের ভেতরে ঢোকারও চেষ্টা করে। তখন পুলিশ লাঠিপেটা করে তাদেরকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারাও সে সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে।

সেদিন বঙ্গভবনের সামনেও একই ঘটনা ঘটে। মি. ভুট্টো বঙ্গভবনে ঢোকার পর 'আটকে-পড়া পাকিস্তানি নাগরিক'-সহ অনেকে ভবনের বাইরে ফটকের সামনে ভিড় করেন। পরে দ্বিতীয় দফায় লাঠিপেটা করে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

আলোচনা ব্যর্থ

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরের প্রধান লক্ষ্য ছিল দু'দেশের মধ্যকার অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। এক্ষেত্রে অবিভক্ত পাকিস্তানের দায় ও সম্পদের বন্টন এবং বাংলাদেশে আটকে-পড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনের প্রতি শুরু থেকেই জোর দিয়ে আসছিল বাংলাদেশ।

মি. ভুট্টো বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার পর বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকও করেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু বিষয়গুলো নিয়ে তারা ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় শেষ পর্যন্ত আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায়।

বিশেষত দায় ও সম্পদের বন্টন প্রশ্নে পাকিস্তান অযৌক্তিক মনোভাব প্রকাশ করার কারণে আলোচনা ভেস্তে গেছে বলে সাংবাদিকদের জানান বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। ‘শুরু হইতে বাংলাদেশ বিভিন্ন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করিলেও পাকিস্তান ইহাতে সাড়া দেয় নাই,’ সাংবাদিকদের বলেন মি. হোসেন।

মূলত দায় ও সম্পদের বন্টনের বিষয়টি বৈঠকে তোলা হলে পাকিস্তান একটি যৌথ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে। বাংলাদেশও তাতে সম্মতি দেয়। তবে বাংলাদেশ জানায় যে, সম্পদের বন্টন করা হবে কিনা সে বিষয়ে নয়, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশ কতটুকু ভাগ পাবে সেটি নিরূপণ করাই ওই কমিটির কাজ হবে।

পাকিস্তান এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে বলে যে, আদৌ এ ধরনের ভাগাভাগির প্রয়োজন আছে কি না, প্রস্তাবিত কমিটি সেটিই খতিয়ে দেখবে। প্রাথমিকভাবে আলোচনা ভেস্তে গেলেও ভবিষ্যতে বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেন মি. ভুট্টো। এ বিষয়ে পাকিস্তান পরবর্তীতে ‘আপসমুখী’ হতে চেষ্টা করবে বলে ঢাকা ছাড়ার আগে সাংবাদিকদের জানান মি. ভুট্টো।

r1 ad
r1 ad