তাপে পুড়ছে দেশ
গোটা দেশ পুড়ছে। মানুষ তো বটেই তীব্র দাবদাহে ধুঁকছে পশু-পাখিও। জিহ্বা বেরিয়ে পড়েছে কুকুর-বেড়ালের। গত দুই বছর ধরে ক্রমাগত তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। শোনা যাচ্ছে, কেউ একজন নাকি ছাদে কড়াই রেখে তেল ঢেলে তাতে মাছ দিয়েছিল। মাছ মচমচে ভাজা হয়ে গিয়েছে। কথাটা শুনে হাসি পেলেও ব্যাপারটা অনেকটা ওরকমই। এমন চলতে থাকলে অবাক হবো না যদি গাছের শুকনো ডাল পালায় আগুন জ্বলে ওঠে!
প্রচণ্ড তাপে চিরচেনা ঢাকার যানজটের চেহারাও খানিকটা বদলে গেছে। এখন জট অনেকটাই কম। জরুরি প্রয়োজন না হলে কেউ বাইরে বের হয় না। বাইরে বের হয় শুধু তারাই যাদের না বেরিয়ে উপায় নেই, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী মানুষ। আর বের হয় তারা যাদের ঘরে বাইরে এসি। তবে বাইরের তপ্ত হাওয়ায় হিমশীতল কুলারও বেশিক্ষণ কুল রাখে না।
একশ্রেণির মানুষ ঘর থেকে না বের হলেও চলে। তারা ঘরে বসে এসির হাওয়া খেতে খেতে ‘কী গরম’ ‘কী গরম’ বলতে বলতে ঠাণ্ডা পানীয়ে চুমুক দিয়ে গরম উপভোগ করতে পারেন আর গালিগালাজ করতে পারেন নগর পরিকল্পনাবিদদের। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষের সেটা চলে না। তাদের অনেকের ঘরে এসি তো দূর, ফ্যান, ফ্রিজও নেই। অনেকের বাড়িতে পানিও নেই। তীব্র গরমে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় অনেক অঞ্চলেই পানির তীব্র সঙ্কট। রাস্তার টাইম কলে সময় ধরে যে পানি আসে সে পানি ধরার সময় তারা পায় না। তাই অনেকে পানিও খেতে পারেন না পিপাসা পেলে, গোসল তো করতে পারেনই না। আমরা প্রতিদিনই হিট স্ট্রোকে দু একজন মারা যাবার খবর পাচ্ছি। কিন্তু চোখে দেখলাম সেদিন। কী বীভৎস! একজন অজ্ঞাত ফেরিওয়ালা রাস্তায় মরে পড়ে আছেন। সবাই দূর থেকে দেখছেন। কেউ কাছে আসছেন না। তার কাঁধে দাড় হাড়ি-পাতিলের বোঝা। হাড়ি-পাতিল ফেরি করতে করতে তিনি হিটস্ট্রোকে মারা যান। স্বাভাবিক! সারাদিন রোদে রোদে ঘুরতে হয়। মাথার উপর একটা ছাতাও নেই। ছাতা কেনার পয়সা আছে কিনা জানি না, তবে ছাতা ধরার হাত তার নেই। কারণ কাঁধে দাড় আর সেই দাড় ব্যালান্স করছে দুহাত। এদের সংখ্যাই বেশি। এর পরিবারের লোকজন হয়ত জানতেও পারবে না, তাদের বাবা-মা বা সন্তান রাস্তায় মরে পড়ে আছে। প্রার্থনা করি, যেন তার পরিবার জানতে পারে, যেন ভদ্রলোকের পারলৌকিক কাজটুকু হয়! এরপর তার পরিবারের কী হবে সে তো সবারই জানা। লোকটির বয়সও বেশি না।
সেদিন একজন সিএনজি চালককে আক্ষেপ করে বলতে শুনলাম, আয় রোজগার নেই। গরমে যাত্রী পান না। অথচ পেট তো বসে নেই। বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে। গ্রামে যে চলে যাবেন তারও উপায় নেই। গ্রামে ঘর দোর কিছু নেই। নদী ভাঙ্গনে তলিয়ে গেছে।
এই প্রান্তিক মানুষ নিয়েই বাংলাদেশ। কিন্তু এদেশে সম্পদের এত অসাম্য, বণ্টনের এত তারতম্য থাকার কথা ছিল না। বৈষম্য ছিল বলেই আমরা পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছিলাম বুুকের রক্ত ঢেলে। রক্ত চলে গেল, তেপ্পান্ন বছর পার হয়ে গেল বৈষম্য রয়েই গেল!
যাক গরমের প্রসঙ্গে আসি। বিউটিফিকেশনের নামে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে গাছ। বলা হচ্ছে- যা গাছ কাটা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি রোপন করা হচ্ছে। এই চিন্তাটা কেউ করছে না যে, বিশ বছর বয়সী একটা গাছ সহজে কেটে ফেলা যায়। কিন্তু আজ গাছ রোপন করলে গাছটা ওই পর্যায়ে যেতে বিশ বছর লাগে। বিউটিফিকেশন বড় না পরিবেশ রক্ষা বড়? মানুষের জীবন বাঁচানো বড়? যখন ঢাকা শহরে, গ্রামে-গঞ্জে, সুন্দরবনে গাছে কোনো হাত পড়েনি তখন কী ঢাকা আর এদেশের বিউটি কিছু কম ছিল! বরং অনেক বেশি সুন্দর আর প্রাকৃতিক ছিল আমাদের ঢাকা। মনোরম ছিল গোটা দেশ। গাছ কাটা পড়ছে, অক্সিজেন কমছে, পাখিরা আশ্রয় শূন্য হচ্ছে, বন্য প্রাণি আশ্রয় হারাচ্ছে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। আর তারই প্রভাবে প্রকৃতির এই অতি গরম অতি শীতের প্রকোপ। এ দেশটাকে এখন আর নাতিশীতোষ বলা যায় না। ষড়ঋতুর দেশও বলা যায় না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ঋতুগুলি তাদের নিজস্বতা হারিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কখন গরম, কখন শীত, কখন বর্ষা কমই বুঝি। আবার যখন বুঝি তুমুলভাবে বুঝি। তেড়ে ফুড়ে নিয়ে যায়, ভাসিয়ে নেয়, কুঁকড়ে ফেলে কিংবা পুড়িয়ে মারে। পরিমিতি বা ভারসাম্য নেই বলেই এমনটা হচ্ছে। নদী ভরাট হচ্ছে। কারখানার বর্জ্য ফেলার জায়গা এখন আমাদের নদীগুলো। নদীর পানি কালো, দূষিত, দুর্গন্ধযুক্ত। মাঝি সম্প্রদায় আর বোধহয় বেশিদিন এদেশে থাকবে না। মৎস্যকূল মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। নদী জবর দখল করে প্লট হচ্ছে, কারখানা হচ্ছে। নদীর সাথে এখন আর ‘প্রমত্তা’ বা ‘ঢেউ খেলানো’ ‘কূল ছাপানো’ শব্দগুলো মানানসই না। দু’দশ বছর পর হয়ত নদীর ছবি স্থান পাবে বইয়ের পাতায়। নদী বলতে দেশে আর কিছুই থাকবে না।
পৃথিবীর বড় বড় দেশের শহরগুলো বেড়ে উঠেছে পরিকল্পিতভাবে। এ দেশে পকিল্পনার বালাই নেই। আমাদের দেশে প্রায় সবই ঢাকাকেন্দ্রিক। চাকরি-বাকরি, শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে প্রায় সব কাজে ছুটে আসতে হয় ঢাকায়। ফলে ঠাসাঠাসি মানুষ, ঠাসাঠাসি দালানকোঠা, শপিংমল, রেস্তোরাঁ। ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস নেই, হাসপাতালে পার্কিং নেই, কলেজে খেলার মাঠ নেই। তারপরও দেদারসে চলছে। যে যেভাবে প্লান দিচ্ছে পাস হয়ে যাচ্ছে। তাই রাস্তার অনেকটা দখল করে যেমন আমরা বাড়ি দেখতে পাই, তেমনি বাড়ি দেখতে পাই মাঝনদীর ভিতরে। আর মানুষের আচার আচরণের কথা নাই বা বললাম। আইন কানুন মানার কোনো বালাই নেই দেশে।
লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে ফুট ওভারব্রিজ বানানো হচ্ছে। অধিকাংশ ব্রিজ কেউ ব্যবহার করছে না। ঝুঁকিপূর্ণভাবে রাস্তা পার হচ্ছে। ব্রিজজুড়ে বসেছে ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের দোকান। রাতে আশে পাশে চলছে ছিনতাই মাদক আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। যত্রতত্র আমরা ফেলছি ময়লা, পলিথিন, সর্দি কাশি। ড্রেন ভরে যাচ্ছে পলিথিনে। আটকে যাচ্ছে পানিপ্রবাহ। সে পানি বিষাক্ত হচ্ছে। পোকা মাকড়ের জন্ম হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে।
এই যে এত কথা বললাম, এর সবকিছু মিলেই দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। তার অনিবার্য প্রভাব এসে পড়েছে আমাদের জীবনে। উত্তরোত্তর তাপমাত্রা বাড়ছে। দিনরাত চলছে গরীবের ঘরে ফ্যান। বিল দিতে গিয়ে খাবারে টান পড়ছে।
গত বছর প্রবল তাপদাহের সময় দেশে একজন চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এমন নয় যে এই প্রথম কোনো দেশে হিট অফিসার নিয়োগ দেয়া হলো। এমন আর কয়েকজন আছেন বিভিন্ন দেশে। প্রচণ্ড গরমে মানুষ পড়েছে তাকে নিয়ে। হিট অফিসার থাকতে কেন দেশে এতো গরম, এই এক বছরে তিনি কী করলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। যারা এসব আলোচনা করছেন তারা সম্ভবত ভুলে যাচ্ছেন বছরের পর বছর ধরে সৃষ্ট অব্যবস্থাপনা একদিনে দূর করা সম্ভব না। উনি এক বছর এসেই এক ফুৎকারে হিট কমিয়ে দিতে পারবেন না। উনি ইতোমধ্যে বলেছেন- গত এক বছরে কি কি করছেন এবং কি কি করবেন। তারপরও আলোচনা থামছে না। আলোচনার কারণও আছে। প্রথমত তিনি নারী, দ্বিতীয়ত সুন্দরী, তৃতীয়ত বয়স কম, চতুর্থ তিনি একজন ক্ষমতাসীন মেয়রের কন্যা। এতগুলো ইস্যু থাকার পর তাকে নিয়ে আলোচনা না হয়ে পারে না। তাকে নিয়োগ দেবার সময়ই একপ্রস্থ মুখরোচক আলোচনা হয়েছিল। তিনি যদি আলাদিনের চেরাগের মতো এক বছরে একটা চমৎকার আবহাওয়া আমাদের উপহার দিতে পারতেন তারপরও বলা হতো ‘এতো ভালো ভালো না’। আসলে নারী হলে প্রথমেই ৫০ পার্সেন্ট মাইনাস হয়ে যায়। তারপর সুন্দরী হলে তো কথাই নেই।
একজন হিট অফিসারকে নিয়ে আসর গরম না করে আপনারা বরং যা যা করলে পরিবেশবান্ধব হয় সেদিকে নজর দিন। গাছকাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করুন, সুন্দরবনের অনেক ক্ষতি তো হয়েই গেছে তারপরও যেটুকু আছে বাঁচান পরিবেশখেকোর নজর থেকে। নদী দখল বন্ধ করুন। ভূমি দস্যুদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হন। রিয়েল স্টেটের নামে যেখানে সেখানে ১৫ -১৬ তলা নির্মাণ বন্ধে পদক্ষেপ নিন। নিজেরা সচেতন হয়ে পরিবেশের দিকে নজর দিন। নিজেদের আচরণ বদলান। আমরা এক হলে যে অনেক কিছু করতে পারি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ভাষা আন্দোলন আর মহান মুক্তিযুদ্ধ।
আর হ্যা, শুনেছি অতীতে গ্রামের নারীরা রাস্তার পাশে পাশে মাটির কলসিতে পানি রেখে দিতো পথচারীদের পান করার জন্য। রেস্টুরেন্ট মালিকদের বলছি, আপনাদের দোকানগুলোর সামনে সুপেয় পানির ব্যবস্থা রাখুন। রিক্সাচালক, ঠেলাওয়ালা, শ্রমজীবী মানুষের হাতে এক বোতল পানি ধরিয়ে দিন। বারান্দায় পাত্রে পানি রাখুন পাখিদের জন্য।
অন্তত এটুকু তো আমরা করতে পারি।
লেখক: কথাশিল্পী, গবেষক