উৎসব সবার জন্য নয়
ঈদ আসছে। সামনে ঈদুল আযহা। ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। দুই ঈদ, ঈদুর ফিতর আর ঈদুল আযহার তাৎপর্য ভিন্ন। দুটি উৎসব মুসলমানদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একইভাবে বিভিন্ন পূজা পার্বণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জীবনের অংশ। অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যও তাদের নিজস্ব উৎসব রয়েছে। কিছু উৎসব সর্বজনীন। সব ধর্ম বর্ণ গোত্র সম্প্রদায়ের। উৎসব মানে আনন্দ। কিন্তু উৎসব সব সময় সবার জীবনে আনন্দ বয়ে আনে না এটাই বাস্তবতা।
ছোট্ট করে বলি, মাসতিনেক আগে সবাইকে কাঁদিয়ে আমাদের অতি প্রিয় শিল্পী সাদি মহম্মদ চলে গেলেন। তার পরিবারে কী ঈদুল ফিতরে উৎসব হয়েছে এবার, ঈদুল আযহায় হবে? আমরাই তো আজও শিল্পীর জন্য কাঁদছি। রাতের পর রাত তার ইন্টারভিউ দেখছি। তার মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না! তার মতো বিনয়ী ভদ্র সুশীল শিক্ষিত আপাদমস্তক শিল্পী বিরল!
কিংবা অবন্তিকার পরিবারে ঈদ? কত মেধাবী ছাত্রী ছিল অবন্তিকা, সামনে ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ! আহা, তার মা কীভাবে কাটাচ্ছেন দিন রাত! এ বছর বেশ কয়েকটি শিশু সামান্য মুসলমানি করতে গিয়ে জীবন দিয়েছে। অথচ আগে মুসলমানি করত হাজামরা অনাধুনিক ছুরি কাঁচি দিয়ে। কই তখন তো একটাও মৃত্যুর খবর শুনিনি! তাদের পরিবারে?
এদের জীবনে এবারের ঈদ পুজো নববর্ষ এসেছে বিষাদের ডালি নিয়ে। সামনের উৎসবগুলোও আসবে একইভাবে।
এইত সেদিন কক্সবাজারের চকরিয়ায় বাবার অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করে ফিরছিলেন ভাইয়েরা। তরকারি বোঝাই ট্রাকে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলে জীবন দিলেন একসাথে চার ভাই। আর এক ভাই হাসপাতালে নেবার পর মারা গেলেন। এদের আরও দুই তিন ভাইবোন আছে এদের জীবনে পুজা পার্বণ আর কখনও আসবে না আনন্দের সাথে। টিলা ধ্বসে সিলেটে একসাথে মারা গেলেন বাবা মা আর শিশু। ওই ভদ্রলোকের বৃদ্ধা মা বেঁচে আছেন। তার জীবনে কী আর কখনও কোন উৎসব হবে! খোদ ঢাকা শহরে অপরিকল্পিত দালান ভেঙে পড়েছে একটা টিনের বাড়ির উপর। মা আর শিশু সন্তান শুয়ে ছিলেন ঘরে। সন্তানটি চলে গেছে ক্ষতবিক্ষত শরীরে জীবনের ওপারে। তার মার জীবনে উৎসবের কথা কী কল্পনায় আসে!
অথবা ধরুন গত ১২ মার্চ মোজাম্বিকের মাপুতো থেকে কয়লা নিয়ে আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে যাওয়ার পথে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের পরিবার যতদিন বন্দি ছিলেন ততদিন তাদের পরিবারে? ওই জাহাজে ২৩ জন বাংলাদেশি নাবিক ছিলেন। সোমালিয়ান উপকূল থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে জলদস্যুদের ডেরায় বন্দি ছিলেন তারা। মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু যখন বন্দি ছিলেন তখন প্রিয়জনদের জলদস্যুদের কাছে জিম্মি রেখে কিভাবে ঈদ করেছেন তাদের পরিবার? কীভাবে কিনেছেন ঈদের পোশাক? কীভাবে মুখে তুলেছেন ঈদের খাবার? কোনটাই তারা করেননি। চোখে জল নিয়ে আপেক্ষা করেছেন প্রিয়জনদের ফিরে পাবার। তাদের জীবনে ঈদ, নববর্ষ আসেনি। এই ২৩ পরিবারের কেউই এবার ঈদ করেননি।
শরীরে ক্ষত হলে শুকিয়ে যায়। কিন্তু মনের ক্ষত কখনই শুকায় না। তবে সেটা দেখা যায় না। বা অনেকে দেখাতেও চায় না। এদেশের বড় বড় ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যাকা-, জেল হত্যা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, বিডিআর বিদ্রোহ. একাধিক প্লেন দুর্ঘটনা, হলি আটিজনে সন্ত্রাসী হামলাসহ আরো কয়েকটি ঘটনা। বিভিন্ন কারণে যারা অসময়ে চলে গেছেন তাদের পরিবার কখনই এই অকাল মৃত্যুগুলো মেনে নিতে পারেনি। মৃত্যু অমোঘ এবং অনিশ্চিত। কখন আসবে জানা নেই। আসলেই জানা নেই কোথায় কখন ওৎ পেতে আছে। কিন্তু তারপরও মোটামুটি একটা গড়পড়তা হিসেব মানুষ করে। যেমন যে আগে এসেছে, সে আগে যাবে। যখন সেই হিসেবটা ওলোট পালোট হয়ে যায়, পিতা-মাতার চোখের সামনে সন্তান, বড় ভাই-বোনের চোখের সামনে ছোট ভাইবোন, স্বামীর আগে স্ত্রী এমন মৃত্যু ঘটে, যখন সদ্যজাত বা শিশুরা চলে যায় তখন সব হিসেবই গড়মিল হয়ে যায়। এসব মৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন। যেসব পরিবারে এমন মৃত্যু ঘটে তাদের জীবনে উৎসব কখনই সহজভাবে আসে না।
বঙ্গবন্ধু জীবনের অর্ধেক সময় জেলে কাটিয়েছেন । তাঁর কন্যা শেখ রেহানা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘যখন আব্বা জেলের বাইরে থাকতেন তখন হতো আমাদের ডবল ঈদ’। পরিবারের সবাইকে একসাথে হারিয়ে এখন দু’বোনের জীবনে কীভাবে ঈদ আসে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কথা ভেবে তাদের হাসিমুখে থাকতে হয়! তাদের হাসিতে হাসি মেলাতে হয়। জেল হত্যাকান্ডের পরিবারগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় যারা চলে গেছেন, যারা শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে আজও ধুঁকে ধুঁকে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের জীবনে ঈদ, নববর্ষ আসেনি। বিমান ক্রাসে আমার পরিচিত এক স্যারের ছেলে মারা গিয়েছিলেন। স্যার ছিলেন বাঘের মতো তেজি। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছেন। অসম্ভব রকম সৎ মানুষ। সৎ মানুষেরা সাহসী আর তেজস্বী হয়ে থাকেন। তিনিও তাই ছিলেন। তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে সাহস হতো না। অথচ তিনি ছিলেন বন্ধুবৎসল। কখনও কাউকে কটু কথা বলেননি। কিন্তু ছেলে চলে যাবার পর কোনদিন তাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেখিনি। বিডিআর বিদ্রোহের সময় আমি হোম মিনিস্ট্রিতে বিডিআর দেখতাম। কাজেই অনেক খবরই জানতাম। কিলিং-এ একজন অফিসার মারা গিয়েছিলেন। অত্যন্ত অমায়িক ছিলেন তিনি। এই ঘটনার দিন কয়েক আগে আমার দেবর হাসপাতালে মারা যায়।
আমি খবর পেয়ে সচিবালয় থেকে বেরিয়ে যখন গাড়ির জন্য ছটফট করছি উনি এসে নামলেন। জানতে চাইলেন, কোথায় যাচ্ছি। চলতে চলতে ঘটনাটা বললাম। ভদ্রলোক আমার পেছন পেছন ছুটে এলেন। আমার সাথে গাড়ি নেই জেনে জোর করে গাড়ি দিলেন। বললেন, আমি যেন যতক্ষণ লাগে গাড়ি রাখি একটুও না ভেবে, একটুও হেজিটেট না করে। প্রয়োজনে যেন টাঙ্গাইল গাড়ি নিয়ে যাই। উনি ব্যবস্থা করবেন। আমি অবশ্য টাঙ্গাইল পর্যন্ত গাড়ি নিইনি। হাসপাতালে পৌঁছেই গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু কথাটা মনে রয়ে গেছে। এর মাত্র দিন কয়েক পর ভদ্রলোক চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে চলে গেলেন। তার স্ত্রী অন্ত:সত্তা ছিলেন। আমি জানি না, ওই ভদ্রলোকের স্ত্রী কেমন আছেন, কিভাবে আছেন। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই অজস্র সমস্যা। ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময় খবর রাখা সম্ভব হয় না। অথবা আমরা সেভাবে চাইও না। কষ্ট হয় ভাবলে! ওই পরিবারে কী ঈদ আসে? আসা সম্ভব? ওনার কী হয়েছে,ছেলে না মেয়ে?
আমার মাকে সারাজীবন ঈদের দিন চোখের পানি ফেলতে দেখেছি। আমাদেরও চোখে ভরা ছিল পানি। মা আর সন্তানদের চোখের পানি একাকার হয়ে আমাদের বোধ গভীর হয়েছে। আমরা কোনোদিনই আনন্দে ঈদ করতে পারিনি। আমরা চোখে জল নিয়ে অজস্র স্মৃতিতে ভাসতে ভাসতে ঈদ করেছি। সারাটা দিন জুড়ে থেকেছে বড় দা। কী খেতে ভালবাসত, কেমনভাবে আদর করত, কেমন জামা আনত এসবই আজও আমাদের ঈদের আলোচনা। মা-আব্বা-আপা চলে গেছেন। আমরা স্মৃতির বোঝা বয়ে চলেছি। আমাদের স্মরণ থেকে এক দিনের জন্যও দূরে যায়নি শহীদ বড় ভাইটি। একাত্তরের ত্রিশ লাখ শহিদ পরিবারের তো একই কাহিনী। কোনও কোনও সন্তান তার বাবাকে চোখে দেখেনি পর্যন্ত। তারা বাবার ছবি খুঁজে ফেরে। সে ছবিও অনেক মা দেখাতে পারেননি। কারণ সর্বস্ব লুট হয়ে গেছে কিংবা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানিরা। এদেশের কোন নেতা, কোন হর্তাকর্তা কিন্তু কখনই তাদের খোঁজ নিতে যায়নি। ঈদে, স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসে নানা অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ডাকা হলেও শহীদ পরিবারের কোন প্রতিনিধিকে ডাকা হয় না। আর বাংলাদেশের জনযুদ্ধের শহীদদের ক’জনের ইতিহাস বা তাদের পরিবারের খবর নথিভুক্ত আছে সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ।
ঈদ ফিতর, নববর্ষ দুটোই চলে গেছে। সামনে ঈদুল আযহা। বছর ঘুরে আবারও ঈদ, নববর্ষ, পুজো, পার্বণ আসবে। কত হই চই হবে। কত রঙ-বেরংয়ের পোশাক আর নিত্য নতুন ডিজাইনের কাপড়ে সয়লাব হবে রাজপথ। কত পশু কোরবানি হবে। কর্পোরেট বাণিজ্য ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এখন আর উৎসব একটা জামা দিয়ে হয় না। অনেকগুলো লাগে। সকালে একরকম দুপুরে অন্য, সন্ধ্যায় একরকম রাতে অন্য।
কোরবানিতেও চলে প্রতিযোগিতা। কে, কত বেশি টাকা দামে গরু কিনতে পারে সেটার পাল্লা। এক শ্রেণির মানুষের হাতে অঢেল টাকা। দেখানোতেই তাদের আনন্দ! পয়লা বৈশাখ কবে পান্তা ইলিশ খাবার উৎসব ছিল? সেই ইলিশ কেন খেতে হবে যা গরিবের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে! যার গোটা তো দূরের কথা, এক টুকরো কেনার সামর্থ্য অনেকেরই নেই! যা সবাই খেতে পারে না, সেই জিনিস কী উৎসবের অনুষঙ্গ হতে পারে না হওয়া উচিত? সবার কী কোরবানি করার সামর্থ্য আছে? সবাই কী ঈদে খেতে পারবে গরু ছাগলের মাংস, বিলি বন্টন তো পরের কথা। সর্বত্র বাণিজ্য। আর এই বাণিজ্যিক উপাদানের তোড়ে ভেসে গেল আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য- সংস্কৃতি। লাঠিখেলা, গাজির গান, পুঁথি পাঠ, গ্রামীণ মেলা, যাত্রা, পুতুল নাচ, তেলে ভাজা পাপড় আর প্রিয় হালখাতা। কষ্ট হয়, ভীষণ কষ্ট! হালখাতার জন্য প্রাণ কাঁদে! প্রাণ কাঁদে তাদের জন্য যারা বড়লোকের লাখ টাকার গরু তাকিয়ে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে! গরিব কৃষক, শ্রমজীবী আর বিত্তহীন মানুষকে বাদ দিয়ে উৎসব হয় না, হতে পারে না। এই বোধ কী কোনদিন আমাদের জন্মাবে না!
লেখক: কথাশিল্পী, গবেষক।