top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

সংসদের 'হুইপ' ও 'হুইপিং' সম্পর্কে

সংসদের 'হুইপ' ও 'হুইপিং' সম্পর্কে
ফাইল ছবি

সংসদ পরিচালনায় ‘হুইপ’ ও ‘হুইপিং’- এই শব্দ দুটি অবিচ্ছেদ্য। ‘হুইপিং’ কী এবং কেন- বিষয়টি দেশের সকল স্তরের মানুষ হয়তো ভালোভাবে বোঝেন না। কিন্তু তাঁরা ‘চিফ হুইপ’ এবং 'হুইপ'দের চেনেন, জানেন। সাধারণ মানুষের কাছে হুইপ একজন সংসদ সদস্য, যিনি অন্যান্য সংসদ সদস্যের চেয়ে একটু বেশি স্ট্যাটাস নিয়ে সরকারি পতাকাসহ চলাচল করেন। অনেকে তাঁদের মন্ত্রীও মনে করেন, যদিও কথাটা একদিক থেকে সঠিক। চিফ হুইপ (প্রধান হুইপ) মন্ত্রী পদমর্যাদার একটি পদ এবং হুইপরা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করেন। ঢাকার বাইরে গেলে তাঁরা সরকারি প্রটোকলসহ পতাকা নিয়ে চলাচল করেন। তবে সংসদে হুইপদের কী কাজ, সংসদ পরিচালনায় তাঁদের কী ভূমিকা, সে বিষয়ে সাধারণ মানুষ খুব বেশি জানেন না।

আমি পঞ্চম সংসদে বিরোধীদলীয় হুইপ, সপ্তম সংসদে সরকারি দলের হুইপ এবং নবম সংসদে সংসদের চিফ হুইপ হিসেব দায়িত্ব পালন করি। যে কারণে ধরে নেওয়া যায়, এক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা একেবারে মন্দ নয়। জাতীয় সংসদে হুইপদের ভূমিকা এবং সেটি সংসদীয় গণতন্ত্রে কী ভূমিকা রাখে, তা নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা আপনাদের সামনে তুলে ধরাই এই লেখার মুখ্য উদ্দেশ্য।

জনসভা থেকে শুরু করে যে-কোনো সভ্য জনসমাগমে শৃঙ্খলা রক্ষা একটি বড় কাজ। এই শৃঙ্খলা কার্যকর করতে যেমন কিছু নিয়ম ও বিধির দরকার হয়, তেমনি সেগুলো কার্যকর করতে কিছু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রয়োজন হয়। সে কারণেই প্রতিটি সভা পরিচালনার করতে একজন সভাপতি মনোনীত হন, যাঁর হাতে পুরো সভার নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং আরো কিছু ব্যক্তি তাঁকে এই কাজে সহায়তা করে থাকেন।

সাধারণভাবে বলতে গেলে সংসদও একটি সমাবেশস্থল। তবে সেটি সাধারণ মানুষের নয়। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ৩০০ সংসদ সদস্য এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত সংরক্ষিত আসনের আরো ৫০ জন নারী সংসদ সদস্য মিলিয়ে এই ৩৫০ সংসদ সদস্যদের সমাবেশকে আমরা সংসদীয় ভাষায় অধিবেশন বলে থাকি। ইংরেজিতে ‘অ্যাসেম্বলি’ বলা হয়ে থাকে।

একটি অধিবেশনের মধ্যে নির্ধারিত-সংখ্যক কার্যদিবস থাকে। সংসদে প্রতিটি কার্যদিবসে আলাদা আলাদা কাজ থাকে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো আইন প্রণয়ন এবং নির্বাহী বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার যে কয়েকটি সংসদীয় বিধান রয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের জন্য প্রশ্নোত্তর, জরুরি জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে আলোচনা, সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব এবং বিভিন্ন বিধির আলোকে আলোচনাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম।

সংসদের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করতে এবং সংসদের সকল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একজন সভাপতি থাকেন, যিনি সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে পরিচিত। তিনি রাষ্ট্রের তৃতীয় ব্যক্তি। সংসদ সদস্যরা সংসদের অধিবেশনে ‘স্পিকার’ নির্বাচিত করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংসদ অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন স্পিকার। তাঁর অনুপস্থিতে সংসদ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার এবং তাঁকে সহায়তা করতে একজন ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত করেন সংসদ সদস্যরা। সভাপতিকে (স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার অথবা সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য) সংসদ অধিবেশন পরিচালনায় সহায়তার জন্য ক্ষমতাসীন দল অথবা জোট থেকে চিফ হুইপসহ হুইপদের নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। সাধারণত দেশের প্রতিটি বিভাগ থেকে একজন জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্যকে হুইপ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

সব হুইপের ওপর রয়েছেন চিফ হুইপ, যিনি সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করে থাকেন। সংসদ নেতার নির্দেশক্রমে সংসদের অধিবেশন ও অধিবেশনের বাইরে এবং কখনো কখনো স্থায়ী কমিটির সভায় দলীয় সিদ্ধান্ত সম্পর্কে দলীয় সংসদ সদস্যদের কাজ তদারক করে থাকেন চিফ হুইপ। দলীয় যে-কোনো নির্দেশনা সংসদ সদস্যদের অবহিত করেন হুইপরা। প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ‘হুইপিং’। সরল কথায় বলতে গেলে হুইপিং হলো সংসদীয় কার্যক্রম সম্পর্কে দলীয় নির্দেশনা, যা কেবল সংসদ সদস্যরা পেয়ে থাকেন।

জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে স্পিকার সংসদ নেতার সঙ্গে পরামর্শক্রমে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন। প্রকৃতপক্ষে এসব বিষয়ে স্পিকারের পক্ষে চিফ হুইপের মাধ্যমে সংসদ নেতার সঙ্গে আলোচনা করা সুবিধাজনক। কারণ সংসদে সম্পাদনযোগ্য সরকারি কাজের পরিমাণ বা ওই সব কাজের অগ্রগতির মাত্রা সম্পর্কে চিফ হুইপ সবচেয়ে বেশি অবহিত থাকেন।

সংসদে কোনো বিষয় আলোচনার জন্য সময় নির্ধারণ, সরকারদলীয় সদস্যদের কোনো বিষয়ে বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দেওয়া বা বক্তব্য প্রদানের সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্পিকার প্রায়ই চিফ হুইপের পরামর্শ গ্রহণ করেন। সংসদকক্ষে সরকারদলীয় সদস্যদের আসন-ব্যবস্থাপনা চিফ হুইপের পরামর্শ অনুযায়ী স্পিকার নির্ধারণ করেন। এ ছাড়া চিফ হুইপ নিজের সংসদীয় দলের বৈঠক আহ্বান করেন।

একটানা ছয় বার সাংসদ সদস্য হিসেবে আমি বিরোধী সংসদ পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, হুইপিং শুধু যে ক্ষমতাসীন দলের জন্য প্রযোজ্য তা নয়, বিরোধী দলের জন্যও হুইপিংয়ের গুরুত্ব অনেক। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে একটি বিরাট উল্লেখযোগ্য ঘটনা বর্ণনা করতে চাই। এই ঘটনার সঙ্গে আমি সরাসরি জড়িত এবং সেটি সম্ভব হয়েছে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ হিসেবে আমার সঠিক সময়ে সঠিক হুইপিংয়ের কারণে। সেটি পঞ্চম সংসদের ঘটনা। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, বেসরকারি দিবস। বেসরকারি দিবসে সাধারণত কোনো সরকারি বিল উত্থাপন করা হয় না। ওই দিন বেশ কিছু সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব আলোচনার জন্য নির্ধারিত ছিল।

সংসদীয় রীতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত-প্রস্তাবগুলো সাধারণত পাশ হয় না। ক্ষমতাসীন দল না চাওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে এগুলো পাশ হয় না। আলোচনার সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সংসদে বিবৃতি দেন। মন্ত্রীর অনুরোধে একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত-প্রস্তাবগুলো প্রত্যাহার করে নেন উত্থাপনকারী সংসদ সদস্যরা। এ ধরনের আলোচনার মাধ্যমে সরকারের ওপর অনেকটা চাপ সৃষ্টি হয়। এটিই সংসদীয় রীতি ও সৌন্দর্য। তবে সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব যে পাশ হয় না, তা নয়। সরকার চাইলে পাশ হয়।

যাহোক, ফিরে আসি পঞ্চম সংসদের ঐতিহাসিক একটি ঘটনায়। ১৯৯২ সালের ৯ জানুয়ারি। বরগুনা থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মণি তাঁর উপকূলীয় নির্বাচনি এলাকা পাথরঘাটা ও আশপাশের অঞ্চলের জলদস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনগণের পক্ষে নৌ-পুলিশ নামক একটি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির জন্য একটি সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সেদিন ওই প্রস্তাবের ওপর চূড়ান্ত আলোচনা হচ্ছিল। সবারই ধারণা ছিল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত-প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নেবেন নুরুল ইসলাম মণি। কিন্তু তিনি সেটি প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতি জানান, যদিও তৎকালীন বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মতিন চৌধুরী বলেন যে জলদস্যু দমনে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।

এই অবস্থায় সিদ্ধান্ত-প্রস্তাবটি পাশ হবে, নাকি বাতিল হয়ে যাবে- সে বিষয়ে হাউজে কণ্ঠভোট দিতে হবে স্পিকারকে। স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী ঘোষণা করেন, “যাঁরা সিদ্ধান্ত-প্রস্তাবটি প্রত্যাহারের পক্ষে আছেন তাঁরা ‘হ্যাঁ’ বলুন। আর যাঁরা সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি প্রত্যাহারের বিপক্ষে আছেন তাঁরা ‘না’ বলুন।” স্পিকারের এই ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন বিএনপি জোটের সদস্যরা ‘হ্যাঁ’ বলেন চিৎকার করেন। আমরা আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী সদস্যরা ‘না’ বলে আরো জোরে চিৎকার করি। তার পরও স্পিকার ঘোষণা করলেন- ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে, অর্থাৎ সিদ্ধান্ত-প্রস্তাবটি প্রত্যাহার হয়ে গেল।

আমি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। গণনা করে রেখেছিলাম যে, বিএনপি-জামায়াতের ক্ষমতাসীন জোটের উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যা ছিল ৫৭। আমাদের উপস্থিত সদস্য ছিলেন ৬২ জন। এই অবস্থায় আমি বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ হিসেবে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিষয়টি অবহিত করে বললাম, আপনি উঠে দাঁড়িয়ে স্পিকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করুন। আপনি হাউজে ডিভিশন ভোট দাবি করুন। অর্থাৎ হাউজের দরজা বন্ধ করে গণনা করা হোক ক্ষমতাসীন দলের কতজন এবং বিরোধী দলের কতজন সংসদ সদস্য এই কণ্ঠভোটে অংশ নিয়েছেন। আমার সঙ্গে সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজও যোগ দেন।

শেখ হাসিনা আমাকে বললেন, 'তুমি ঠিকমতো গুনেছ তো?'

আমি বললাম, 'জি, গুনেছি।'

এরপর বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা স্পিকারকে ডিভিশন ভোটের অনুরোধ জানান। স্পিকার, তা-ই করলেন। হাউজের দরজা বন্ধ করার আদেশ দিলেন। এরপর গণনা করে দেখা গেল আমাদের কথাই সত্যি। ক্ষমতাসীন জোটের সদস্য ছিলেন ৫৭ জন এবং বিরোধীদলীয় সদস্য ছিলেন ৬২ জন। এর ফলে সরকার বা সরকারি দলের সদস্যদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নৌ-পুলিশ স্থাপনের ব্যাপারে আনীত সিদ্ধান্ত-প্রস্তাবটি পাশ হয়ে গেল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। এমনকি বিশ্বের অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক দেশেও এমন ঘটনা ঘটেনি।

ওই সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব পাশ হওয়ার পর সরকার ‘কোস্ট গার্ড আইন, ১৯৯৪’ পাশ করে। এই আইনের আলোকেই প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড ফোর্স, যা বর্তমানে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং বাংলাদেশের জলসীমা পাহারায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

সপ্তম সংসদের আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সদস্যরা হাউজে তুমুল হট্টগোল সৃষ্টি করছেন। তাঁরা ফাইল নিক্ষেপ করছেন, পেপারওয়েট নিক্ষেপ করছেন। তাতে হাউজের ভেতর অনিরাপদ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সার্জেন্ট-অ্যাট-আর্মস রয়েছেন। কিন্তু আমি ক্ষমতাসীন দলের হুইপ হিসেবে তৎকালীন চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর সঙ্গে তৎক্ষণাৎ পরামর্শ করলাম। আমরা সংসদ নেতাকে তাঁর আসন থেকে উঠতে নিষেধ করলাম; তাঁকে বসে থাকতে বললাম। আমাদের ভয় ছিল, ওরা যদি প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে ভারী পেপারওয়েট অথবা অন্য কিছু ছুড়ে মারে! তাঁকে নিরাপত্তা দিতে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে যাই। সেদিন সেই সিদ্ধান্তের কারণে আমরা বড় সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। দেশ রক্ষা পেয়েছে বড় বিপদ থেকে।

বিশ্বের অনেক সংসদেই প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করা হয়েছে। পাকিস্তান আমলে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী সংসদের অভ্যন্তরে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান। এই ঘটনার পরই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাবিরোধী শক্তিরা বলতে থাকেন সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। কিছুদিন পরই পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১৯৯১ সালে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন গালফ ওয়ারে অর্থনৈতিক সাহায্য নিয়ে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে জুতাপেটা করেন সে দেশের পার্লামেন্ট সদস্যরা।

নবম সংসদে আমাকে চিফ হুইপের দায়িত্ব প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের আলোকে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন যে, একটি সর্বদলীয় কমিটির মাধ্যমে সংবিধানের প্রতিটি অনুচ্ছেদ আলোচনা করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন করা হবে। চিফ হুইপ হিসেবে আমি প্রধানমন্ত্রীকে কার্যপ্রণালি বিধির ২৬৬ বিধি অনুসারে সংসদের মাধ্যমে একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠনের কথা বলি। প্রধানমন্ত্রী সেটি গ্রহণ করে সেই অনুসারে সংসদে ঘোষণা দিয়ে ১৫ সদস্যের সংবিধান সংশোধন কমিটি গঠন করেন।

সময়মতো সঠিক হুইপিং না থাকলে অনেক সমস্যা হয়। যেমন, নবম সংসদে ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে হুইপিংয়ে সমন্বয়হীনতার জন্য এক দিনেই দুইটি সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়। বিষয়টির সূচনা হয় ঢাকা-২০ আসনের সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের একটি সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব আলোচনার সময়। সিদ্ধান্ত-প্রস্তাবটির বিষয়বস্তু ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যারা বাধাগ্রস্ত করে তাদের বিচারের আওতায় আনা। বেনজীর আহমেদ প্রস্তাবের পক্ষে তাঁর বক্তব্য প্রদান করার পর আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করতে বেনজীর আহমেদকে অনুরোধ জানান।

এমন অবস্থায় সাবেক ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া দাঁড়িয়ে উত্তেজিত হয়ে প্রস্তাবটি প্রত্যাহারের বিপক্ষে কথা বলতে থাকলে সব সংসদ সদস্য যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে এক হয়ে যান। তাঁরা এই সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব প্রত্যাহারের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যান। পাশ হয়ে যায় সেই সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব। এরপর একে একে আরো দুটি সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়। তবে, একটি কথা বলতে চাই যে, বেনজীর আহমেদের সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব পাশের ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু সেই বার্তাটি সঠিকভাবে সংসদ সদস্যদের কাছে পৌঁছানো যায়নি। যে কারণে সরকার বা মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত-প্রস্তাবটি পাশ হয়ে যায়। সুতরাং, বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংসদীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য হুইপিং অপরিহার্য একটি বিষয়। হুইপিং না থাকলে সংসদের কার্যক্রম অচল হয়ে যাবে।

সংসদে আইন প্রণয়ন একটি জটিল প্রক্রিয়া। সংসদ সদস্যদের মধ্যে সবাই আইন প্রণয়ন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখলেও কখনো কখনো বিলের সংশোধনীগুলো গ্রহণ অথবা বাতিল বিষয়ে কণ্ঠভোটের সময় অনেকেই সমস্যায় পড়ে যান। বিল পাশের সময় এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে পর্দার অন্তরালে থেকে সংসদ সদস্যদের সাহায্য করে থাকেন হুইপরা। সংসদ সদস্যরা যদি ‘হ্যাঁ’ না বলে ‘না’ বলেন তাহলেই বিপত্তি।

উপসংহারে এ কথা বলা যায়, সংসদীয় গণতন্ত্র রক্ষায় হুইপিং এবং হুইপদের অবদান অনস্বীকার্য। হুইপরা না থাকলে সংসদের অধিবেশন চলতে পারে না। সংসদে ন্যূনতম ভুল বোঝাবুঝি সংসদীয় কার্যক্রমে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, যার প্রভাব দেশের সার্বিক রাজনীতিতে পড়বে।

লেখক পরিচিতি : উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ। নবম জাতীয় সংদসের চিফ হুইপ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। অষ্টম জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ, সপ্তম জাতীয় সংসদে হুইপ এবং পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯১ সালে থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ আসন থেকে একটানা ছয় বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমান সংসদে তিনি অনুমিত হিসাব-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

লেখক: কৃষিমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

(লেখাটি এর আগে পার্লামেন্ট জার্নাল জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৩ সংখ্যায় ছাপা হয়েছে।)

r1 ad
r1 ad