মুক্তিযোদ্ধা কোটাই কী গলার কাঁটা?
সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে গত ৫ জুন হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের মূল অংশে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে কোটা কম বা বেশি করা যাবে। কোনো পাবলিক পরীক্ষায় যদি কোটা থেকে আবেদনকারী চাকরিপ্রার্থী না পাওয়া যায়, তবে সাধারণ মেধা তালিকায় থাকা প্রার্থীর মাধ্যমে তা পূরণ করার স্বাধীনতা থাকবে।
এতে আন্দোলনকারীদের কথা বলার বা কাঙ্খিত পথে এগিয়ে যাবার একটি অনবদ্য সুযোগ তৈরি হল। তারপরও কেন মাঠ সরগরম করছে শিক্ষার্থীরা? যেখানে স্বয়ং প্রধান বিচারপতি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, রাস্তায় শ্লোগান দিয়ে আদালতের রায় পরিবর্তন করা যায় না। আন্দোলনকারীদের তিনি নিজেদের সন্তান গণ্য করে শিক্ষার্থীরা ভুল বুঝে এটা করছে বলেও স্নেহময় মন্তব্য করেছেন। সর্বপরি প্রধান বিচারপতি আন্দোলনকারীদের প্রতি সংবেদনশীলতা প্রকাশ করে প্রতিবাদকারীদের আইনজীবীর মাধ্যমে তাদের বক্তব্য তুলে ধরারও সুযোগ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা যদি যৌক্তিকভাবে দেশের বিপুল সংখ্যক চাকরিপ্রার্থীর কল্যাণের কথা চিন্তা করে মাঠে নামে তবে তো এই সুযোগ লুফে নেওয়ার কথা! তা না করে পথ আটকে, ব্যারিকেড দিয়ে, বিক্ষোভ মিছিল সহযোগে পথের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপির নামে ২৪ ঘণ্টার সময়সীমা বেধে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি খারাপ দিকে নেওয়া হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধীতা!
যুক্তির খাতিরে বলতে হচ্ছে, ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করা হয়। সেখানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করা হয়। এর মানে দাঁড়ায়, রাষ্ট্র স্বয়ং মনে করে মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রের সবচেয়ে অবহেলিত অচ্ছুত একেবারেই সাধারণ আমজনতা। তাই যাদের ত্যাগে এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অর্জিত হলো তাদের মতই বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরাও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নাগরিক। এ কারণে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শুধু মাত্র পিওন চাপরাশির মত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে কোটা বহাল ছিল? যে বীর মুক্তিযোদ্ধা পিতারা অসীম ত্যাগে দুঃসাহসিকতায় এদেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করলো সেই বীরদের সন্তানেরা এদেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির যোগ্যতা রাখে না?
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সরকারি কর্ম কমিশন-‘পিএসসি’র প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় আবেদ আলীদের পিএসসির রমরমা ব্যবসার খবর যখন জাতীয় ইস্যু তখনোও আন্দোলনকারীরা কেন নিশ্চুপ? পিএসসির পরিচালক থেকে ড্রাইভার একটি দুর্নীতিপরায়ন কর্মকর্তা-কর্মচারী গোষ্ঠী প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িয়ে হাজার কোটি টাকা কামিয়েছে, দেশের লাখ লাখ তরুণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে তখনো মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিরোধীরা প্রতিবাদে স্বোচ্ছার নয় কেন? লাখো তরুণের ভাগ্যে সীমিত সংখ্যক সরকারি চাকরির সুষ্ঠ ও নায্য বণ্টনবিধিতে পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপ উত্তরণে দেশের সকলে যখন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পিএসসি’কে ভরসাস্থল গণ্য করে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে। পিএসসি’র কাছে ন্যায্যতা আশা করে। তখনো একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পিএসসি’র কর্মকর্তা, কর্মচারী, ড্রাইভারের মত নায়কেরা গ্রেফতার হয়, তরুণদের ভাগ্য অন্ধকার করা এতসব ঘটনা কেন বিচলিত করে না বা করছে না মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের।
পোষ্য কোটা কেন বৈষম্য নয়?
সরকারি ক্যাডার, নন ক্যাডার, বেসরকারি ব্যাংক, বীমা, স্বায়ত্বশাসিত চাকরির স্বপ্ন তো দূরের কথা উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের পথ আটকে আছে পোষ্য কোটা। মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধীরা পোষ্য কোটা ইস্যুটি কি আমলে নেবেন? কারণ স্বপ্নের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে শূন্য দশমিক শূন্য নম্বর কম পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের ভতির্র সুযোগ বঞ্চিত করে। অথচ এমনও দৃষ্টান্ত আছে যে, ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থী নূন্যতম পাস নম্বর পেয়ে পোষ্য কোটায় ভালো বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীর সন্তানদের জন্য এই যে, পোষ্য কোটার ব্যবহার তা মেধার বৈষম্য নয় কি?
প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে এদেশের সংবিধানের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদ সবার জন্য সমান সুযোগের কথা বলছে। যদিও ২৯ নম্বরের উপ অনুচ্ছেদে পিছিয়ে থাকা সেই অনগ্রসর প্রতিবন্ধী ও বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর বিশেষ বিধান রেখেছে। কিন্তু সরকারি চাকরিজীবী যাদের বেতন-ভাতার সাথে হালের নানান উৎসব ভাতাও দিচ্ছে সরকার। উপরন্ত রয়েছে চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধা, সময়মত বেতন-বোনাসের পাশাপাশি চাকরি শেষে প্রভিডেন্ট ফান্ডের আওতায় এককালীন অর্থ প্রাপ্তি এবং পেনশন সুবিধা।
সরকারি চাকরি মানে-‘সোনার হরিণ’। সরকারি চাকরিজীবীরা কোন দিক থেকে সমাজের পশ্চাদপদ যে তাদের সন্তানদের জন্য পোষ্য কোটা বহাল রয়েছে? সরকারি পোষ্য কোটা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের বক্তব্য কি? বড্ড জানতে ইচ্ছা করে।
মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী আন্দোলনে কার লাভ?
রাজধানীর শাহবাগের রাজপথের চত্ত্বরে মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধীদের আন্দোলন, অবরোধ ও শ্লোগান নিছক স্বাধীনতা বিরোধীদের আস্ফালণে পরিণত হয়েছে। গত কদিনের অবস্থা বিশ্লেষন করে এই প্রশ্ন করাটা অসঙ্গত হবে কী? কারণ আদালতে মীমাংসার জন্য থাকা একটি ইস্যুতে উচ্চ আদালত একের পর এক উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রথমত: সরকারি চাকরিতে কোটা বহাল রেখে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর ১০ জুলাই এক মাসের জন্য স্থিতিবস্থা দিয়েছেন আপীল বিভাগ।
দ্বিতীয়ত: ১১ জুলাই সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে গত ৫ জুন হাইর্কোটের দেওয়া রায়ের মূল অংশ পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করেছেন উচ্চ আদালত। তারপরও কেন মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধীরা আন্দোলনে? উচ্চ আদালত কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের কোটা সংস্কারের পথে যেভাবে নানান কর্মতৎপর হয়ে উদ্যোগী হচ্ছেন আন্দোলনকারীদের সেই পথে এগিয়ে চলার কোনো উদ্যোম বা আগ্রহ দেখছি না? বরং আন্দোলন জিইয়ে একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা স্বাধীনতা বিরোধী মনোভাব পুঁজি করে তরুণদের আবেগ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন করতে চায়। আর এ কাজে দেশের বিরুদ্ধে দেশ জাগাতে তরুণদের আবেগের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। বরাবরের মতই একাত্তরের পরাজিত শক্তির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে স্পর্শকাতর স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বিষয়টি। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ শব্দগুলোকে নতুন প্রজন্মের কাছে ভুলভাবে উপস্থাপন করে ফায়দা লোটায় কী তাদের উদ্দেশ্য নয়?
ঠিক আজ থেকে ৬ বছর আগে ২০১৮ সালে এই কোটাবিরোধী আন্দোলন করে অনেকেই ফেইস ভ্যালু তৈরি করে লাইট লাইমে এসেছিলো। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে এদেরই একজন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-‘ডাকসু’র নেতা হন। আন্দোলন নেতা তৈরি করে। কিন্তু আজ যারা আন্দোলন করছেন তারা মুক্তিযুদ্ধ দিনের ভয়াবহতা দেখেনি। একাত্তরে স্বজন প্রিয়জন হারানো নির্মম বেদনাময় অভিজ্ঞতার কথা আজকের কতজন তরুণ প্রজন্ম জানে? সেই তরুণ প্রজন্মের আবেগ উস্কে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী চেতনা জাগিয়ে ভাগ্য উন্নয়নের শিকারে নেমেছে মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী অন্দোলনকারীর কেউ কেউ! আর নাদান মূল্যবোধহীন নাগরিক সুবিধা প্রাপ্ত তরুণদের ‘কান নিয়েছে চিলে’ এমন ধারায় পথে নামিয়েছে।
যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে নির্ভার হয়ে রাজপথে এক্কাদোক্কা খেলছে। এই দৃশ্য যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় তখন বলতেই হয় দেশের জন্য এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কিছু হতে পারে কী? ওই তরুণেরা নিজের ভাগ্য উন্নয়ন বহু দূরের, ভবিষ্যতে তারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কী অবদান রাখবে ভাবুন তো একবার?
মুক্তিযোদ্ধা কোটাই কী একমাত্র গলার কাঁটা?
স্বাধীনতার মাত্র ৫৩ বছর, যদিও অধিকাংশ বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত হয়েছেন। আবার ১৯৭১’র ভয়াল অভিজ্ঞতা স্বচক্ষে দেখেছেন তাদেরও একটি বড় অংশ আজ বেঁচে নেই। তারপরও এটাও তো সত্য, সংখ্যায় অল্প হলেও এখনো জীবিত আছেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। এমনকি যুদ্ধ দিনের ভয়াবহতা দেখেছেন সেই একাত্তরের ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী বেঁচে আছেন। এছাড়াও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম তো সেই দাদা, নানা, মামা, চাচার কোলে বসে যুদ্ধ দিনের সব হারানো বেদনার গল্প শুনেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী নানান উত্থান দেখা একাত্তরের পরাজিত শক্তির বিরোধীতার মুখে টিকে থাকা সেই পরের প্রজন্ম তো মরে নাই! তাদের অনেকেই বিজয় ও স্বাধীনতা দিবসে নিজ বাড়িতে বীর মুক্তিযোদ্ধা পিতাকে লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করা, পতাকাকে স্যালুট জানিয়ে প্রিয় পিতাকে কাঁদতে দেখে বড় হয়েছেন। এতোসব ঐতিহাসিক সাক্ষীদের জীবিতাবস্থায় স্বাধীন দেশে একাত্তরের পরাজিত শক্তির উত্থান থেমে নেই। এর দায় কমবেশি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রশাসন এবং রাজনীতিকদের রয়েছে। আর এরই সুযোগ নিয়েছে দেশি-ভিনদেশি নানান অপশক্তি আর একাত্তরের পরাজিত পক্ষ। স্বাধীনতা অর্জনে কোনো অবদান না রেখেও বরং বিরোধীতা করে আজ স্বাধীনতার সুফল ভোগী ভিরু ও পরাজিত শক্তির প্রতিভূরা বার বার জিতবে তা তো হতে পারে না।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা যখন গলার কাটা তখন সরকারিভাবে রাজউকের প্লট কিংবা ফ্ল্যাট বরাদ্দে সরকারি চাকরিজীবী, আমলা, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি, চিকিৎসক, শিল্পী, লেখক সাহিত্যিক, সাংবাদিক এতোসব কোটা বহাল কেন?
সরকারি চাকরিজীবীসহ সুবিধাপ্রাপ্ত উল্লেখিত শ্রেণী কোন বিবেচনায় পশ্চাৎপদ যে তাদের জন্য কোটার আওতায় ফ্ল্যাট ও প্লট বরাদ্দ পাবেন? কোটায় প্লট ফ্ল্যাট বরাদ্দ করা কি সমাজে রাষ্ট্রে বৈষম্য নয়? জেলা শহরে বিভাগীয় পর্যায়ে প্লট-ফ্ল্যাট বরাদ্দে কোটা প্রথা বাতিল করুন, না হয় সংযুক্ত করুন স্বাধীন দেশে সংখ্যগরিষ্ঠ সেই কৃষক ও শ্রমজীবী কোটা।
সর্বপরি রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা অভাব-অভিযোগ এমনকি চাকরিতে বদলি ও পদোন্নতির ন্যায় নানান নীতি নির্ধারণীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়-সচিবালয়ে প্রবেশে ভিআইপি, সিআইপি, চিকিৎসকসহ নানান পেশাজীবীদের জন্য বরাদ্দ অ্যাক্রিডেশন সুযোগ দিন সাধারণ শ্রমজীবী ও কৃষকদেরও।
জান্নাতুল বাকেয়া কেকা, সিনিয়র সাংবাদিক