প্রতারণার দুই মুখ— হানি ট্র্যাপ ও মানি ট্র্যাপ

প্রেম, মোহ, কিংবা অর্থের লোভ— এসবের আড়ালে কীভাবে মানুষকে ফাঁদে ফেলা হয়, তারই দুটি চমকপ্রদ গল্পের নাম হানি ট্র্যাপ ও মানি ট্র্যাপ। নামে মিষ্টি হলেও এদের কাজ মোটেও সুখকর নয়। আসুন, জেনে নিই এই ফাঁদগুলোর আসল চেহারা।
হানি ট্র্যাপ: প্রেমের ছলনে জাল
পরিচয়: প্রেম বা যৌন আবেদনকে হাতিয়ার করে কোনো ব্যক্তিকে সংকটে ফেলাই হানি ট্র্যাপের মূল উদ্দেশ্য। গুপ্তচরবৃত্তি, ব্ল্যাকমেইল, বা কাউকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই কৌশল কাজে লাগে। কোথাও দেখা যায়, গুপ্তচরবৃত্তি-গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কূটনীতিক বা সরকারি কর্মকর্তাদের প্রলুব্ধ করে গোপন তথ্য আদায় করে। যেমন— প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মাতা হরি নামের এক নর্তকী গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতেন।
প্রতিযোগিতা বা রাজনীতি: কোম্পানি বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ গোপন তথ্য চুরি বা কাউকে বদনাম করার জন্য নাটকীয় সম্পর্ক তৈরি করে।
ব্যক্তিগত প্রতারণা: অনলাইনে ভুয়া প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করে টাকা বা গোপন তথ্য হাতানো। এটাকে ‘ক্যাটফিশিং’ বলা হয়।
কৌশল: আবেগ, বিশ্বাস বা ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে শত্রুকে দুর্বল অবস্থায় ফেলা।
উদাহরণ: আজও কোনো সেলিব্রিটির গোপন ভিডিও ফাঁস করে টাকা আদায়ের ঘটনা এই ফাঁদেরই অংশ।
মানি ট্র্যাপ: টাকার লোভে জড়ানো ফাঁস
পরিচয়: অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে কাউকে ঋণ, প্রতারণা বা জোরজবরদস্তির মুখে ঠেলে দেওয়াই হলো মানি ট্র্যাপ।
কোথায় দেখা যায়: বিনিয়োগের ফাঁদ কিংবা ‘রাতারাতি কোটিপতি’ হওয়ার লোভ দেখিয়ে পঞ্জি স্কিম চালানো। যেমন— বার্নি ম্যাডফের কেলেঙ্কারিতে হাজারও মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছিল।
শিকারী ঋণ: পেচেক লোনের মতো উচ্চ সুদের ঋণ দিয়ে মানুষকে ঋণের দুষ্টচক্রে আটকে রাখা।
ব্ল্যাকমেইল: হানি ট্র্যাপের শিকার ব্যক্তিকে পরে টাকা দাবি করা। যেমন— কাউকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে গোপন ছবি তুলে টাকা চাওয়া।
কৌশল: লোভ, হতাশা বা অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে আর্থিক শোষণ।
উদাহরণ: ‘নাইজেরিয়ান প্রিন্সে’র ইমেইল থেকে শুরু করে র্যানসমওয়্যার হামলা— সবই এই ফাঁদের আওতায় পড়ে।

মাতাহারি, যার বিরুদ্ধে জার্মান গুপ্তচর হিসেবে মিত্রবাহিনীর সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে তিনি গোপন তথ্য জেনে প্রতিপক্ষের কাছে পাচারের অভিযোগ ছিল। হানি ট্র্যাপের অন্যতম উদাহরণ মনে করা হয় তাকে। ছবি: সংগৃহীত
মূল পার্থক্য: দুই ফাঁদের চরিত্র
প্রলোভন: হানি ট্র্যাপে প্রেম-যৌনতা, মানি ট্র্যাপে টাকা।
লক্ষ্য: হানি ট্র্যাপে গোপন তথ্য বা সম্মতি আদায়, মানি ট্র্যাপে সরাসরি টাকা হাতানো।
মিশেল: কখনো হানি ট্র্যাপ শেষে মানি ট্র্যাপ শুরু হয়। যেমন— প্রেমের ফাঁদে ফেলে পরে টাকা দাবি করা।
বাংলাদেশে হানি ট্র্যাপ ও মানি ট্র্যাপ সম্পর্কিত আইনি কাঠামো
বাংলাদেশে ‘হানি ট্র্যাপ’ (প্রেম বা যৌন শোষণের ফাঁদ) বা ‘মানি ট্র্যাপ’ (আর্থিক প্রতারণা) প্রতিরোধে সরাসরি নামাঙ্কিত কোনো আইন নেই। তবে বিদ্যমান বিভিন্ন আইনের সমন্বয়ে এসব অপরাধ মোকাবিলা করা হয়। নিম্নে বিষয়ভিত্তিক আইনি বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হলো।
হানি ট্র্যাপ (প্রেম/যৌন শোষণের ফাঁদ): প্রেমের বিভ্রম বা যৌন সম্পর্কের ফাঁদ পেতে ব্যক্তিকে শোষণ, ব্ল্যাকমেইল বা গোপনীয়তা ভঙ্গের ঘটনাগুলো নিম্নোক্ত আইনে শাস্তিযোগ্য।
দণ্ডবিধি (১৮৬০)
ধারা ৩৮৪ (জবরদস্তি): হুমকি দিয়ে কারও কাছ থেকে সম্পদ বা মূল্যবান বস্তু আদায় করলে এ ধারায় শাস্তি।
ধারা ৪১৫-৪২০ (প্রতারণা): ব্যক্তিগত লাভের জন্য প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের বিধান।
ধারা ৫০৩ (অপরাধমূলক হুমকি): ব্যক্তির সম্মান বা শারীরিক ক্ষতির হুমকি দেওয়া।
ধারা ৫০৯ (লজ্জা ভঙ্গ): গোপনীয়তা বা মর্যাদাহানিকর আচরণের শাস্তি।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (২০০৬) ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (২০১৮)
ধারা ৬৬ (আইসিটি): অননুমোদিত তথ্য প্রবেশ, ডেটা চুরি বা সম্মতি ছাড়া যৌন কন্টেন্ট শেয়ার করলে প্রযোজ্য।
ধারা ১৭-৩৩ (ডিএসএ): সাইবার বুলিং, মানহানি ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো অপরাধ।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (২০০০): নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, শোষণ বা ব্ল্যাকমেইলের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান।
পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন (২০১২): সম্মতি ছাড়া যৌন কন্টেন্ট রেকর্ড বা প্রচার নিষিদ্ধ।
মানি ট্র্যাপ (আর্থিক প্রতারণা)
জালিয়াতি, জবরদস্তি বা বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে আর্থিক ক্ষতির ঘটনায় নিচের আইনের ধারাগুলো প্রযোজ্য হবে।
দণ্ডবিধি (১৮৬০)
ধারা ৪১৫-৪২০: আর্থিক লাভের জন্য প্রতারণা।
ধারা ৪০৫: আস্থার অবিশ্বাস ও আমানত করা সম্পদের অসদ্ব্যবহার।
ধারা ৪৬৩ (জালিয়াতি): জাল দলিল বা পরিচয় তৈরির শাস্তি।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন (২০১২): প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচার করলে শাস্তি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (২০১৮): ধারা ২৫ অনুযায়ী অনলাইন আর্থিক জালিয়াতি নিষিদ্ধ।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন (২০০৯): প্রতারণামূলক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড থেকে ভোক্তা সুরক্ষা।
গোপনীয়তা ও সাংবিধানিক সুরক্ষা
সংবিধানের ৪৩ ধারা: ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার নিশ্চিত করে। আইসিটি ও ডিএসএ-অননুমোদিত ডেটা শেয়ার বা নজরদারি বেআইনি।
চ্যালেঞ্জ ও বিবেচ্য বিষয়
প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা: সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব।
সামাজিক কুসংস্কার: হানি ট্র্যাপের শিকার নারীদের অভিযোগ করতে দ্বিধা।
আইনের অপব্যবহার: ডিএসএর কিছু ধারা বিতর্কিত, যা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে।
হানি ট্র্যাপ বা মানি ট্র্যাপের সরাসরি আইন না থাকলেও সাইবার অপরাধ, প্রতারণা ও নারী নির্যাতনবিরোধী আইনের মাধ্যমে এসব মামলা পরিচালিত হয়। আদালতের প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে বিচারিক ফলাফল। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জনই মূল চাবিকাঠি। মূল কথা, প্রেম হোক বা টাকা— প্রতারণার ফাঁদ সর্বত্র। নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে আবেগ ও লোভের ওপর নিয়ন্ত্রণ জরুরি। বিশ্বাসের সম্পর্ক বা আর্থিক সিদ্ধান্ত— যেকোনো ক্ষেত্রে সচেতনতাই হলো বুদ্ধিমানের অস্ত্র।
হানি ট্র্যাপ বা মানি ট্র্যাপ থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে সচেতনতা বাড়ানো, শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও আইন-কানুন প্রয়োগের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। এ ধরনের ফাঁদ থেকে রক্ষা পেতে ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে যেসব করণীয় করণীয়—
সচেতনতা বৃদ্ধি
- হানি ট্র্যাপ বা মানি ট্র্যাপের প্রকারভেদ, উদ্দেশ্য ও সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে গণমাধ্যমে প্রচার চালানো উচিত।
- স্কুল, কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাইবার নিরাপত্তা ও সামাজিক সচেতনতা নিয়ে কর্মশালা ও আলোচনা সভার আয়োজন করা যেতে পারে।
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতামূলক পোস্ট ও প্রচার চালানো যেতে পারে।
শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা
- অনলাইন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা, দ্বি-ধাপ প্রমাণীকরণ চালু করা এবং সন্দেহজনক বা অচেনা ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
- ওয়েবসাইটে ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা থেকে বিরত থাকা ও অনলাইন নিরাপত্তাবিষয়ক বিভিন্ন টিপস অনুসরণ করা যেতে পারে।
- হানি ট্র্যাপ বা মানি ট্র্যাপের শিকার হলে তাৎক্ষণিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা উচিত।
আইন-কানুন প্রয়োগ
- হানি ট্র্যাপ বা মানি ট্র্যাপের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন-কানুন তৈরি ও প্রয়োগ করতে হবে।
- সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে বিশেষ ইউনিট গঠন করা যেতে পারে।
- অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
অন্যান্য
- অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের অনলাইন নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
- জনসাধারণকে সন্দেহজনক কোনো কার্যকলাপ দেখলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
এই পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে সমাজকে হানি ট্র্যাপ বা মানি ট্র্যাপের মতো সামাজিক অপরাধ থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
লেখক: কোম্পানি সচিব, সিটি ব্যাংক পিএলসি