top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সংস্কার

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সংস্কার

সংস্কারে গঠিত ছয় কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সুপারিশগুলো এরই মধ্যে নানামাত্রিক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এসব প্রস্তাবে এমন কিছু সুপারিশ আছে, যেগুলো নতুন কিছু নয়। অনেক আগে থেকেই এসবের কথা বলে আসছিল সচেতন মহল। এ দেশের পরতে পরতে দুর্নীতি ও অনিয়মের বাসা উপড়ে ফেলতে সুপারিশমালা বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

আবার অনেক সুপারিশ বাস্তবতা বিবর্জিত। সম্ভবের বাইরে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়— এমন অনেক কিছু আছে সুপারিশে। অনেক সুপারিশ আবার দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পারে। আইন ও বিচার বিভাগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অনেক কিছু স্থান পেয়েছে কমিশনগুলোর সুপারিশমালায়। সম্প্রতি তাই বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান একে সামালোচনা করে 'শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সংস্কার' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

নতুন বছর। চারিদিকে চৈত্রের দাবদাহ। এর মধ্যে রাজনীতির উত্তাপে ঘি ঢেলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সংস্কারের প্রসঙ্গ এনে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। হিমায়িত রুমে বসে এসব সংস্কারের সুপারিশ কতটা কাজে দেবে? এ কথা যেন তার উক্তি নয়, তা প্রকারান্তরে জনগনের প্রতিধ্বনিই হয়ে উঠেছে।

আমরা দেখছি, নাসার সঙ্গে চুক্তি করছে এই সরকার। স্টারলিংকের যাত্রা শুরু হয়েছে। মহাশূন্য ও ওপরের দিকের চিন্তাই বেশি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মাটির চিন্তা কোথায়? কৃষক বা ফসল উৎপাদনকারীদের সঙ্গে তো চুক্তি দেখছি না? ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন কমছে। এসব ক্ষেত্রে সংস্কার কোথায়? নাকি ফ্যাসিস্ট সরকারের মতো আমদানিনির্ভর খাদ্য স্বয়ংসম্পুর্ণতার পথেই হাঁটছি আমরা? জমিনের সমস্যার সমাধান না করে ওপরে ওপরে তাকিয়ে লাভ কী?

ঢাকা শহরে লাখো মানুষ প্রতিদিন রাতে রাস্তায় ফুটপাতে ঘুমায়। ভিক্ষুকের নগরী যেন রাজধানী। পশিশু, দরিদ্র ও অসহায় মানুষ তিন বেলা খেতে পায় না৷ এসব ক্ষেত্রে সংস্কার কোথায়? নাকি সবার সামনে সংস্কারের মূলা ঝুলিয়ে আবারও দেশবাসীকে বোকা বানানোর পাঁয়তারা চলছে? ফ্যাসিস্টদের বিচার ও তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত কী হবে— তা নিয়েও সংস্কারের কোনো অগ্রগতি নেই। মনে হচ্ছে এসব কিছু থমকে আছে।

আবার শুধু প্রাতিষ্ঠানিক, প্রশাসনিক ও কাঠামোগত সংস্কারে কি কোনো লাভ হবে? কারণ এসব সংস্কার বাস্তবায়নের পেছনে থাকেন রাজনীতিবিদ, আমলা, কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এদের মানসিকতা বা মাইন্ডসেটের সংস্কার কি জরুরি নয়? সংস্কারের মাধ্যমে দেশের খোলনলচেই তো পালটে ফেলা দরকার। এত দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় যাওয়া কি কোনো অ-রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে সম্ভব?

এই দেশ পরিবর্তনে দরকার ম্যাজিক। আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক লি কুয়ান ইউ অথবা মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদের মত কোনো নেতৃত্ব। জনগণ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসকে সেই জায়গায় দেখতে চায়। কিন্তু তিনি কি তা পারছেন? গেল সাত মাসে তিনি কি কোনো ম্যাজিক দেখাতে পারলেন?

৫ আগস্টের পর নতুন করে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা ও ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়েছে । নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে উদ্যোগ কোথায়? অথচ আমাদের শূন্য দারিদ্র‍্য ও বেকারত্ব দূর করার স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। দারিদ্র‍্য, বৈষম্য ও ধনী-গরিবের ভেদাভেদ তো স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই তৈরি করে মানুষকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছেন। কোনো মানুষের পক্ষে কি তা শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব? নাকি মানুষকে শাসন করতে এসব ভেগ টার্ম হিসেবে ব্যবহার হয়?

সমাজের উচ্চ স্তরে রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের ঘেরাটোপে থেকে, এসির হিমঘরে বসে অনেক কথাই বলা যায়। চৈত্রের খাঁ খাঁ তপ্ত রোদে আধাপেটা, অভুক্ত মানুষ জানে জীবনের বাস্তবতা। তাদের জন্যে সংস্কার কোথায়?

সংস্কার কমিশনের সুপারিশে কোনো গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া এবং ভিন্ন মত-পথ ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অভিপ্রায়ে করা হয়েছে বলে মনে হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়াসহ সংস্কারে ৪৭টি সুপারিশ করেছে দুদক সংস্কার কমিশন। এখানে দেশের সব স্তর ও দুদকের ভেতরে দুর্নীতি রুখতে নানা সুপারিশ করা হয়েছে। তবে দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী চিন্তা করলে বাস্তবায়নযোগ্য নয়— এমন অনেক কিছুই সন্নিবেশিত হয়েছে।

দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের প্রথম ১০টি সুপারিশ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও আইনি সংস্কার বিষয়ে। এর মধ্যে সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদের অধীনে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা, বৈধ উৎসবিহীন আয়কে বৈধতা দানের যেকোনো রাষ্ট্রীয় চর্চা চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ করা, যথাযথ আইনি কাঠামোর মাধ্যমে কোম্পানি, ট্রাস্ট বা ফাউন্ডেশনের প্রকৃত বা চূড়ান্ত সুবিধাভোগীর পরিচয়-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাদি রেজিস্ট্রারভুক্ত করে জনস্বার্থে প্রকাশ নিশ্চিত করার মতো সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড কমে আসতে পারে।

দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে দুদকের মর্যাদা, গঠন, অভিযোগ ব্যবস্থাপনা, তদন্ত ও বিচারের ওপর যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, ততটাই অনুপস্থিত বাংলাদেশে দুর্নীতির কারণগুলো অনুসন্ধানের বিষয়টি। দুর্নীতির কারণগুলো শুধু প্রাতিষ্ঠানিক নয়, এগুলো প্রেক্ষাপটমূলকও বটে। কিন্তু দুদক সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো থেকে এটি প্রতীয়মান হওয়া অমূলক নয় যে দুর্নীতি মূলত প্রাতিষ্ঠানিক একটি প্রক্রিয়া, যেটি থেকে উত্তরণের জন্য প্রতিষ্ঠান ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মুক্ত করা গেলে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে। আইন থাকলে ও তার প্রয়োগ যথাযথভাবে হলেই দুর্নীতি রোধ করা যাবে– এমন ধারণা পোষণ করলে সেটি হবে সামাজিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করা।

এ দেশের পুলিশ রাজনীতির তল্পিবাহক ও হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত। এই বাহিনীর আপাদমস্তক সংস্কারের দাবি বহু পুরনো। কলোনিয়াল যুগ থেকে বারবার এই সংস্কারে কমিশন হয়েছে। ২০০৭ সালেও খসড়া পুলিশ অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছিল। সম্প্রতি ৩৬ জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশের নারকীয় ভুমিকার জন্যে এই বাহিনীর সংস্কারের বিষয় নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এর ধারাবাহিকতায় পুলিশ সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন দিয়েছে।

১১০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে পুলিশের ১৩টি বিষয়ে ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। এর সঙ্গে বাহিনীর সংস্কারের জন্য ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে কমিশন। সংস্কার প্রতিবেদনে পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য পুলিশ কমিশন গঠনের কথা বলা হলেও পুলিশ কমিশন কীভাবে প্রভাবমুক্ত থাকবে সেটি পরিষ্কার নয়। যে দেশে সংসদীয় কমিটিগুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়, বিচারিক ও আধাবিচারিক কমিটিগুলো পর্যন্ত রাজনৈতিক লেজুড়ভিত্তিতে চলে, সে দেশে পুলিশ কমিশনকে কীভাবে স্বাধীন রাখা যাবে, সেটি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে পুলিশ বরাবরের মতোই রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

আবার প্রতিবেদনে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে যেগুলো খুবই অস্পষ্ট। যেমন— পুলিশের পদায়ন ও পদোন্নতির জন্য সততা ও নিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। অথচ এসবের মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়নি। এই অস্পষ্টতা নতুন করে দুর্নীতির পথ খুলে দিতে পারে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতা, রাষ্ট্রের সামর্থ্যসহ অনেক কিছু বিবেচনা করলে আটক বা গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ বিষয়ে অনেক সুপারিশ ভবিষ্যতে নতুন করে সমস্যা তৈরি করতে পারে। যেমন— প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদালতের আদেশ ছাড়া এফআইআর–বহির্ভূত অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় অনেক ক্ষেত্রে আদেশের জন্য অপেক্ষা করলে অভিযুক্ত যদি পালিয়ে যায়, তাহলে সামাজিকমাধ্যমে পুলিশকে দায় দিতে দেরি করবে না আমজনতা।

তবে পুলিশের প্রশিক্ষণ, কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট রাখা, অতিরিক্ত ডিউটির জন্য প্রণোদনা, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টে করার সুপারিশগুলো পুলিশের পেশাদারিত্ব বাড়াতে সাহায্য করবে। কিন্তু থানায় যে নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে সেটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক নিরাপত্তা কমিটি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিতর্ক ও প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে। সমালোচকদের ভাষ্য, কমিশন যেসব প্রস্তাব দিয়েছে তার অধিকাংশই বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এই সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে দুই শতাধিক সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে পুরনো চারটি বিভাগ নিয়ে আলাদা চারটি প্রদেশ এবং ঢাকা ও আশপাশের এলাকা নিয়ে ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট বা রাজধানী মহানগর সরকার' করতে বলেছে কমিশন। কিন্তু এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে প্রাদেশিক পরিষদ, অফিস-আদালতসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যে অর্থনৈতিক সামর্থ্য দরকার, তা বাংলাদেশের আদৌ আছে কি না, সে বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার।

ক্যাডারগুলো ভেঙে ছোট ছোট করার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেটি জনপ্রশাসনে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসে ঢুকতে এসইএস, উপসচিব পদে প্রশাসন ৫০ এবং অন্য ক্যাডার ৫০ পদোন্নতির যে সুপারিশ করা হয়েছে, তা কীভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেটির কোনো ব্যাখ্যা কমিশনের প্রতিবেদনে নেই। আবার একজন সরকারি চাকরিজীবী ১৫ বছর চাকরি করার পর সব সুবিধাসহ স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে পারার যে সুপারিশ করা হয়েছে তা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের মতো গরীব দেশের অর্থ অপচয়ের নতুন সুযোগ তৈরি করবে।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে মূলত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তবে এই কমিশনের কিছু সুপারিশ নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যেমন— হাইকোর্টের বিচারকদের অবসরের বয়স ৭০ করার প্রস্তাবটি বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য, যেখানে বেকারত্বের হার অনেক বেশি, সেখানে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আবার বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ করার প্রস্তাবটি আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে যেতে পারে। কারণ এ ধরনের প্রস্তাব এরই মধ্যে আদালত একবার বাতিল করে দিয়েছিলেন।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন মোট ১৬টি অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে দুই শতাধিক সুপারিশ দিয়েছে। নির্বাচনি ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য বেশ কিছু কার্যকর প্রস্তাব এই কমিশনের সুপারিশে তুলে ধরা হয়েছে। নির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলোকে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় আনার সুপারিশটি বাস্তবায়িত হলে রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহিতার সুযোগ অনেক বেড়ে যাবে।

তবে এই কমিশন এমন কিছু সুপারিশ করেছে যেগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতায় মনে হতে পারে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যেমন— বিচারিক আদালত ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার দিন থেকেই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ঘোষণার সুপারিশ করেছে এই কমিশন। এটি সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নির্বাচনে প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা সংবিধানের মাধ্যম নির্ধারিত হওয়ার কথা।

আবার নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন কেন গণভোটের সুপারিশ করবে, সেটি কোনোভাবে বোধগম্য নয়। এই কমিশনের কোনো কোনো সুপারিশ দেখে মনে হতে পারে, বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে। যেমন— সুপারিশ করা হয়েছে, বেসরকারি সংস্থার কার্যনির্বাহী পদে আসীন ব্যক্তিদের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে ওই পদ থেকে তিন বছর আগে অবসর গ্রহণ সংক্রান্ত আরপিও ধারা বাতিল করা। আবার নারীদের ঘুর্ণায়মান পদ্ধতিতে নির্বাচনের যে প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে সেটি অযৌক্তিকই শুধু নয়, অবৈজ্ঞানিকও বটে।

পাঁচ খণ্ডের বিশাল প্রতিবেদন দিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই কমিশন সাতটি মূল সুপারিশ করেছে। কমিশন সংবিধানের ৭(ক), ৭(খ), ৮, ৯, ১০, ১২, ১৪১(খ), ১৪১(গ) ও ১৫০(২) অনুচ্ছেদ বিলুপ্তি এবং এই সংশ্লিষ্ট পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তফশিল সংবিধানে না রাখার সুপারিশ করেছে। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষে আসন থাকবে ৪০০। নির্বাচন হবে বর্তমান পদ্ধতিতে, সরাসরি ভোটে। এর মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তারাও নির্বাচিত হবেন সরাসরি ভোটে। আর উচ্চকক্ষে আসন থাকবে ১০৫টি। এর মধ্যে ১০০ জন নির্বাচিত হবেন আনুপাতিক পদ্ধতিতে। এই আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের প্রস্তাবটি এরই মধ্যে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি করেছে। অনেকের অভিযোগ, কিছু ক্ষয়িষ্ণু ও কম জনপ্রিয় দলকে বিশেষ সুবিধা দিতে এ ধরনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ' পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ' করার সুপারিশ জমা দিয়েছে কমিশন। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘রিপাবলিক' ও ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ' শব্দগুলো থাকছে। সেক্ষেত্রে ‘পিপলস রিপাবলিক'-এর বাংলা ‘‘জনগণতন্ত্রী' কীভাবে হচ্ছে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। সংবিধান সংস্কার কমিটি ‘রিপাবলিকের' বাংলা করতে চায় ‘নাগরিকতন্ত্র'। তাহলে সে হিসেবে ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ' নাম হতে হবে ‘জননাগরিকতন্ত্রী বাংলাদেশ'।

আরও কিছু অদ্ভুত জটিলতা আছে এই সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে। যেমন— দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার স্পিকার ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সেগুলো অনাবশ্যক জটিলতা ও সমস্যা তৈরি করবে।

বর্তমানে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার যে চার মূলনীতি রয়েছে সেগুলো হলো— জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চার মূলনীতির মধ্যে শুধু গণতন্ত্রকে প্রস্তাবিত নতুন পাঁচ মূলনীতির একটি হিসেবে রাখা হয়েছে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ করা নতুন চারটি মূলনীতি হলো— সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও বহুত্ববাদ। আগের চারটির চেয়ে এই পাঁচটির মধ্যে কী এমন তুমুল পার্থক্য তা কমিশনের বিশাল পাঁচটি খণ্ড পড়ে বোঝা দায়।

সবচেয়ে বিস্ময়কর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে দেওয়ার প্রস্তাবটি। তার চেয়ে হাস্যকর মনে হতে পারে বাহাত্তরের সংবিধানকে ফ্যাসিবাদের বীজ হিসেবে আখ্যায়িত করা। অতীতের সবকিছু খারাপ, আমি যা করবে তা সবই ভালো– এমন ধারণা নতুন ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়।

ছয়টির মধ্যে বেশিরভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন কিছু সাধারণ দোষে দুষ্ট। প্রথমত, প্রায় সবগুলো সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গত ১৫ বছরের শাসনামলের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন— দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে সবশেষ আওয়াম লীগ সরকারকে চোরতান্ত্রিক সরকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে এমন কোনো সরকার পাওয়া যাবে যার আমলে চোরতান্ত্রিকতার চর্চা হয়নি। আওয়ামী লীগের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে চোরতান্ত্রিকতা নতুন নতুন মডেল আবিষ্কৃত ও চর্চিত হয়েছে বটে, কিন্তু অতীতেও এ ধরনের চর্চা ছিল। সেদিক থেকে অতীতে মডেলগুলোকে ধর্তব্যের মধ্যে না নিলে ভবিষ্যতের জন্য সংস্কারের একটি সামগ্রিক রূপরেখা পাওয়া নাও যেতে পারে। ড. ইউনূসের সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদনগুলোর এটি বড় একটি দুর্বলতা।

বাংলাদেশে যতবারই রাজনৈতিকব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে ততবরাই অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার নতুন নতুন মডেলের প্রয়োগ ঘটেছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের কোনো সরকারের আমলকে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের দোষে দুষ্ট না করে উপায় নেই।

একইভাবে নির্বাচন কমিশন সংষ্কার প্রস্তাবেও বাংলাদেশে ত্রুটিপূর্ণ ও পাতানো নির্বাচন বলতে বিগত তিনটি নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে এ পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে ১২টি। তার মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে চারটি। অন্য আটটি নির্বাচন হয়েছে রাজনৈতিক সরকারের অধনে। এই আটটি নির্বাচনই কোনো না কোনো মাত্রায় প্রশ্নবিদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্য। প্রকৃত অর্থে এগুলোতে জনগণ তাদের মতের প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। সেখানে শুধু তিনটি নির্বাচনের কথা তুলে ধরার অর্থ হলো সংস্কার কমিশন রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের যাত্রাই শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালের পর থেকে।

অনেক কমিশনই নিজেদের কর্মপরিধির বাইরে বেশকিছু প্রস্তাব করেছে, যেগুলো নিয়ে এরই মধ্যে সমালোচনা হচ্ছে। যেমন— জেলা পরিষদ বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। অথচ এটি স্থানীয় সরকারের বিষয়। আবার নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন দাবি করেছে, তারা নির্বাচন কমিশনের আইনের একটি খসড়া প্রণয়ন করেছে, যেটিকে কমিশন সমন্বিত আইন বলে দাবি করেছে। কিন্তু কমিশনের যে কার্যপরিধি ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল, সেখানে কোথাও আইন প্রণয়নের কথা বলা নেই।

আবার এই কমিশনের যে আটজন সদস্য তাদের কেউই আইন বিশেষজ্ঞ নন। অন্যদিকে কমিশন নিজেই জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলেছে, বর্তমানে নির্বাচনি আইনকানুন পরিবর্তনের জন্য নির্বাচন কমিশন আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীল। নির্বাচন কমিশন আইন পরিবর্তন স্পিকারের নেতৃত্বে সংসদের উচ্চকক্ষের একটি সর্বদলীয় কমিটির মাধ্যমে হওয়া উচিত। আইনের খসড়া তৈরি করার মধ্য দিয়ে কমিশন নিজের প্রস্তাব প্রকান্তারে নিজেই লঙ্ঘন করল।

সমালোচনা যা-ই থাকুক, সংস্কার যে প্রয়োজন সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু যেটি সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সেটি হলো রাজনৈতিক ইচ্ছা। অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এই সংকট আরও বাড়তে পারে। যদি তা হয়, তাহলে সংস্কার কমিটিগুলোর সুপারিশ হবে গ্রন্থগত বিদ্যা পরহস্তে ধনের মতো। তাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে সংস্কারের বদলে সংক্ষিপ্ত সময়ে বাস্তবমুখী সংস্কার শেষ করে দ্রুত নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষমতা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেওয়াই শ্রেয়।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

r1 ad
top ad image