আজব এক দেশ!
আজব এক দেশ! পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের ঘের থেকে মাছ চুরির অভিযোগে গোপালগঞ্জে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে ১৭ কেজি রুই মাছ ও ১টি জাল জব্দ করা হয়েছে। মাছ চুরি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাঁদের ছুটির দিন শুক্রবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কী তড়িৎ গতিতে দারুণ আইনের শাসন বাংলাদেশে দেখেন!
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা এস এম শাহজাহান সিরাজ জানিয়েছেন, ওই ঘের থেকে মাছ ধরার কথা জানতে পেরে তিনি জেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে জানান। সেখান থেকে মাছ ধরা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশের সহযোগিতায় তিনজনকে আটক করেন। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে ১৭ কেজি রুই মাছ ও ১টি জাল জব্দ করা হয়। এই ঘটনায় উপজেলা মৎস্য কার্যালয়ের অফিস সহায়ক বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা করেন। পুলিশ আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠিয়েছে।
তড়িৎ গতিতে কী দারুণ ব্যবস্থা! একবার ভাবেন, শত শত কোটি টাকা দুর্নীতি লুটপাটের অভিযোগ যার বিরুদ্ধে সেই আইজিপির টিকিটাও ছুঁতে পারছে না কেউ। চিঠির পর চিঠি দিয়েও দুদক তাঁর খোঁজ পাচ্ছে না। অথচ তার পুকুরের মাছ চুরির অভিযোগে ছুটির দিনে তিনজনকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ।
না আমি এই গ্রেপ্তার নিয়ে আমার খুব বেশি কিছু বলার নেই। তবে ২৩ বছরের সাংবাদিকতা লেখালেখি এবং এই সমাজ রাষ্ট্র দেখার পর্যবেক্ষণ থেকে দেখেছি, এই দেশে চুনোপুঁটেদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যতটা তৎপর রাঘব বোয়ালরা ততোটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। ব্যাংকের কয়েক হাজার টাকা দিতে না পারায় এখানে সাধারণ মানুষ জেলে যায় কিন্তু হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লুট করলে কিছু হয় না।
এই যে দেখেন, সিআইডি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে পিএসসির উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালক, ডেসপখচ রাইডার, অফিস সহকারীসহ নানা পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু বড় কর্তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনকি জবাবদিহিতায় নেই।
চ্যানেল ২৪ তাদের প্রতিবেদনে বলছে, ৪৬ তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ফাঁস হয়েছে রেলওয়ের উপর সহকারী নিয়োগের প্রশ্নপত্র। দুটি পরীক্ষাই হয়েছে বর্তমান চেয়ারম্যানের আমলে যিনি পিএসসির ১৩ তম চেয়ারম্যান। আচ্ছা এসব ঘটনায় পিএসসির চেয়ারম্যান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভূমিকা কী? তাদের কোন দায় নেই?
দুদিন আগেই লিখেছি, নন ক্যাডারে বারবার প্রশ্নপত্র ফাঁস হতো বলে সা’দত স্যার বিসিএস থেকে নন ক্যাডারে নিয়োগের উদ্যোগ নেন। অথচ বর্তমান চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন সেই উদ্যোগকে সংকটে ফেলেছেন। এ কারণে তাঁর প্রতি আমার সন্দেহ।
এই পিএসসির চেয়ারম্যান যখন শিক্ষা সচিব তখন গণহারে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। কীসের ভিত্তিতে তাকে পিএসসির চেয়ারম্যান করা হলো? যে মানুষ প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতে পারে না যার সময়ে প্রায় সব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে তাকে কি করে পিএসসির মতো একটা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান করা হয়? আমার চোখে পিএসসির সবচেয়ে ব্যর্থ চেয়ারম্যান তিনি। এই যে এখন পিএসসির এতো এতো কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হচ্ছেন তিনি দায় এড়াবেন কী করে?
খেয়াল করলে দেখবেন, এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে সাবেক এক গাড়ি চালককে নিয়ে যিনি প্রায় এক দশক আগে চাকরিচ্যুত। এসব আলোচনার মাধ্যমে কিন্তু শীর্ষ কর্মকর্তারা আড়াল হয়ে থাকছেন।
শুধু এই ঘটনা নয়, এদেশের বেশিরভাগ দুর্নীতি অনিয়মের ঘটনা অফিস সহকারী, ড্রাইভার বা নিচের দিকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের ওপর দিয়ে যায়। তাদের ছবি তাদের বাড়ি গাড়ি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময় শীর্ষ কর্মকর্তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। অথচ ওপরের দিকের কর্মকর্তারা জড়িত না হলে অফিস সহকারী, ডেসপাচ রাইডারদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস বা যে কোন দুর্নীতি অনিয়ম করা কঠিন।
আচ্ছা যে প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী বা গাড়িচালকরা দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা কামান সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা শীর্ষ কর্মকর্তারা কতো টাকা আয় করেন? কিংবা তারা আসলে কি ভূমিকা পালন করেন? আর শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসূত্র ছাড়া হয় কী করে? অথচ দেখবেন বেশিরভাগ সময় শীর্ষ কর্মকর্তারা দায় অস্বীকার করছেন।
আচ্ছা তর্কের খাতিরে যদি ধরি প্রতিষ্ঠান প্রধান বা শীর্ষ কর্মকর্তারা দুর্নীতি অনিয়ম করেন না কিন্তু প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে কর্মকর্তা কর্মচারীদের দুর্নীতি অনিয়মের দায় তারা এড়াবেন কী করে? বরং প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে দুর্নীতি অনিয়ম ঠেকাতে না পারাও প্রতিষ্ঠান প্রধানের বড় ব্যর্থতা। এসব কারনেই কোন ঘটনা ঘটলে ব্যর্থতার দায়ে সবার আগে প্রতিষ্ঠান প্রধানের জবাবদিহিতা জরুরী কিংবা তাঁর পদত্যাগ করা উচিত। আফসোস আমাদের দেশে তা হয় না।
আগেই বলেছি প্রশ্নপত্র ফাঁস আর নিয়োগ বাণিজ্য যেন না হয় সে কারণেই প্রয়াত চেয়ারম্যান সা'দত হুসাইন স্যার বিসিএস থেকে নন ক্যাডারে নিয়োগের দারুণ একটা পদ্ধতি চালু করেছিলেন চেয়ারম্যান হয়ে সেই পদ্ধতিটি ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন এই চেয়ারম্যান। এ ছাড়া সাদত স্যারের সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল তারা কীভাবে পিএসসিতে গতবছর আবার ফিরে আসলো?
জানি না প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের পর বর্তমান চেয়ারম্যান কীভাবে দায় এড়াবেন। ঘটনার পর চেয়ারম্যান কোথায় সাংবাদিকদের কাছে তথ্য প্রমাণ চাইবেন তা নয় বরং যেভাবে কথা বলেছেন কিংবা যেভাবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন তাতে মনে হয়েছে প্রশ্ন ফাঁস অনিয়ম সব হবে কিন্তু পিএসসি নিয়ে কথা বলা যাবে না। কথা বললে ষড়যন্ত্র।
অথচ আমি আমার ২২ বছরের পর্যবেক্ষণে দেখেছি, সব বিসিএসে প্রশ্নপত্র ফাঁস না হলেও কোন বিসিএসের নিয়োগ শতভাগ স্বচ্ছ ছিলো না। অধিকাংশ তরুণ নিজের মেধা যোগ্যতায় চাকরি পেলেও প্রায় সব বিসিএসে কোটার অপপ্রয়োগ, ভাইভায় স্বজনপ্রীতি থেকে শুরু করে কোন না কোন অনিয়ম বা ভুল হয়েছে।
ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। একজন পরীক্ষার্থী বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় সব বিষয়ে দারুন নম্বর পেয়েছে। কিন্তু ইংরেজিতে ২০০ এর মধ্যে মাত্র ২৭ পেয়েছে। আমাকে তিনি গতকাল তার নম্বরপত্র ইনবক্স করেছেন। এই ভুলের দায় কার? এমন অসংখ্য ঘটনা আছে। মৌখিক পরীক্ষায় কতো যে ছেলে মেয়ের সাথে অন্যায় করা হয়?
আমি দুদিন আগে ২৯ তম বিসিএসের একটা ঘটনা লিখেছি। ওই বিসিএসে প্রথম যিনি হয়েছিলেন তিনি কুমিল্লার একটা কলেজ থেকে পাস করা। তিনি পরে পুলিশ ক্যডারে নিয়োগ পান। তিনি কীভাবে প্রথম হয়েছিলেন সেটি আমার কাছে বিরাট প্রশ্ন।
এই ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি এমন কিছু ঘটনা জেনেছি যাতে মনে হয়েছে কেউ যদি কোটি টাকা খরচ করতে চান এবং পিএসসির কোন সদস্য বা শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিপুল পরিমান টাকা দেন তাহলে বিসিএসে প্রথম হওয়াও সম্ভব। কারণ পিএসসিতে অনেক ফাঁকফোকর আছে।
বিসিএসে এমন অনেক ঘটনা আছে। নন ক্যাডারেও আছে। আর কর্মচারী নিয়োগে তো অনিয়মের শেষ নেই। পিএসসি সবসময় এই সবকিছু লুকিয়ে রাখতে চায়। অথচ ফাঁস হওয়া প্রতিটি পরীক্ষা বাতিল থেকে শুরু করে অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি চাকরি পাওয়া প্রত্যেককে খুঁজে বের করে তাদের বরখাস্ত করা উচিত। আর শুধু প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ নয় বিসিএসের নিয়োগ পরীক্ষা শতভাগ স্বচ্ছ করা প্রয়োজন। পিএসসি'র জবাবদিহিতা ভীষণ জরুরী। আমি সারা জীবন আমার সাংবাদিকতায় সেই কাজটাই করার চেষ্টা করেছি।
আমি মনে করি স্বচ্ছতার জন্য প্রিলিমিনারিতে কাটমার্কসহ সবার নম্বর প্রকাশ করা উচিত। একইভাবে লিখিত ভাইভাসহ সবকিছুর মার্ক ও মেধাতালিকা প্রকাশ করা। ভাইভাতে ২০০ নম্বর কমানো উচিত। কারণ মৌখিকে একেকটা বোর্ড একেক রকম নাম্বার দেন এবং এখানে স্বজনপ্রীতির বড় সুযোগ আছে। ২৭ ও ৩৪ তম বিসিএস এর বড় উদাহরণ। বিসিএস থেকে নন ক্যাডারে মেধা তালিকা প্রকাশ করে ধারাবাহিকভাবে নিয়োগ দেওয়া উচিত।
সবমিলিয়ে কোটার মত আমি পুরো পিএসসি ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার সংস্কার চাই। এজন্য চাকরিপ্রার্থী থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ নাগরিক সমাজ সবাইকে নিয়ে পিএসসির জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আরেকটা কথা। এই যে তরুণরা সব চাকরির জন্য রাজপথে নামছে তাদের মতো আমিও কোটার সংস্কার চাই। শুধু কর্মকর্তা নয় কর্মচারী থেকে শুরু করে প্রাইমারি নিয়োগে কোটার সংস্কার চাই। তবে এই যে তরুণরা চাকরির জন্য আন্দোলন করছে এই তরুণদের অনেকেই কিন্তু পরে সরকারি চাকরিতে গিয়ে দুর্নীতি লুটপাট করে। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধেও তরুণদের সোচ্চার হওয়া উচিত।
খেয়াল করলে দেখবেন, এই দেশের সরকারি চাকরি শুরু হয় ২০ তম গ্রেডে ৮২৫০ টাকার স্কেলে। আর সর্বোচ্চ বেতন স্কেল ৭৮ হাজার টাকা। এই বেতন স্কেলে এই দেশে চাকরি করে যেখানে বেশিরভাগ মানুষের জীবন চালানো অসম্ভব সেখানে কোন এক জাদুবলে একদল লোক সরকারি চাকরি করে সম্পদের পাহাড় গড়ে।
আচ্ছা একজন গাড়ি চালক বা অফিসে সহকারী যদি কোটি কোটি টাকার মালিক হন তাদের বড় কর্তাদের কতো টাকা থাকে? আচ্ছা এত কম বেতন কাঠামো জেনেও কেন একজন মানুষ এই দেশে সরকারি দপ্তরের অফিস সহকারী কিংবা ড্রাইভার হতে চায়? ১০ হাজার টাকার বেতনের চাকরির জন্য কেন ১০ লাখ টাকা ঘুষ দেয়? কারণ এই দুর্নীতি। তিনি জানেন এই টাকা তুলে আনতে পারবেন।
কোন সন্দেহ নেই এদেশের সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী খারাপ নয় অনেক সৎ মানুষ আছে। কিন্তু তারপরও বলেন তো এত কম বেতন কাঠামো জেনেও কেন মানুষ সরকারি চাকরিতে আগ্রহী হয়? শুধুই সামাজিক মর্যাদা নাকি দুর্নীতির সুযোগ একটা বড় কারণ? এই দুর্নীতির ছায়া গিয়ে পড়ে পিএসসিতেও। সেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে শুরু করে নানা নিয়োগ বানিজ্য হয়।
এসব কারণেই আমি চাই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের তালিকা হোক। এই দুর্নীতিবাজ ও তাদের পরিবারের সব সম্পদ রাষ্ট্র বাজেয়াপ্ত করুক এই রাষ্ট্র। এমনকি দুর্নীতি প্রমাণিত হলেও অবসরের পরেও সম্পদ বাজেয়াপ্ত হোক। আমি তো মনে করি শুধু পুকুরের মাছ কেন বেনজির মতিউরদের মতো দুর্নীতিবাজদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে জনগণের মাঝে বিলিয়ে দেয়া উচিত।
আমি বলবো, এই রাষ্ট্রের প্রতিটি ফ্ল্যাট গাড়ি বাড়ির মালিক কারা রাষ্ট্র খোঁজ নিক। সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে বেনামে হলে সেই সম্পদের উৎস খোঁজা হোক। অবৈধ আয়ে হলে সেই সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং দুর্নীতিবাজদের তৎক্ষণাৎ চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হোক। এমন কঠিন ব্যবস্থা নেয়া হোক যাতে দুর্নীতি করার সাহস কেউ না পান। আর নিয়োগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিএসসিকে সবার আগে দুর্নীতি অনিয়ম মুক্ত করতে হবে। একইভাবে আমাদের সব প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও সুশাসন খুব জরুরি।
শরিফুল হাসান : কলামিস্ট, অভিবাসনবিশেষজ্ঞ।