top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

পাকিস্তানের ক্ষমা ও সম্পদ ফেরত: প্রেক্ষাপট, প্রভাব ও দৃষ্টান্ত

পাকিস্তানের ক্ষমা ও সম্পদ ফেরত: প্রেক্ষাপট, প্রভাব ও  দৃষ্টান্ত

একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা ও ১৯৭১-পূর্ব সম্পদ ফেরত দেওয়ার কল্পনাপ্রসূত পরিস্থিতি একটি গভীর ঐতিহাসিক ও কূটনৈতিক মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রান্তিকীকরণ, ভাষাগত বৈষম্য (বাংলা বনাম উর্দু) ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা চেয়েছিল বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান)। পরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৯ মাস ধরে চলমান নৃশংস দমননীতি ব্যাপক হত্যা, বাস্তুচ্যুতি ও গণহত্যার ইতিহাস জন্ম দেয়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে ৩০ লাখ মানুষ নিহত এবং দুই থেকে চার লাখ নারী যৌন সহিংসতার শিকার হন। পাকিস্তানে অবশ্য এই সংখ্যাগুলো বিতর্কিত। পাকিস্তানের ঐতিহাসিক বর্ণনায় প্রায়ই মুক্তিযুদ্ধকালীন সহিংসতার মাত্রাকে খাটো করে দেখানো হয়।

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে এ ঘটনাগুলোকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতির পাশাপাশি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণ দাবি করে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধটিকে একটি রাজনৈতিক পতন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে পাকিস্তান, প্রক্রিয়াগত গণহত্যা হিসেবে নয়। কিছু পাকিস্তানি সুশীল সমাজের সদস্য ও রাজনীতিবিদ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার ‘অত্যধিকতা’ স্বীকার করলেও দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে কখনো ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়নি।

পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা নিয়ে বাংলাদেশের ‘সামষ্টিক মানসিক আঘাতকে (কালেকটিভ ট্রমা) বৈধতা দেবে, যুগপ্রাচীন মানসিক ক্ষতকে স্পর্শ করবে। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানির মতো সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের পথ প্রশস্ত করতে পারে। ১৯৭১-পূর্ব সম্পদ (যেমন— জমাকৃত তহবিল, সাংস্কৃতিক সম্পদ) ফেরত দেওয়া প্রতিকারমূলক ন্যায়বিচারের প্রতীক হবে, যদিও আইনি কাঠামো, মূল্যায়ন ইত্যাদি নিয়ে প্রায়োগিক চ্যালেঞ্জ থাকবে।

বিশ্বাস বৃদ্ধির মাধ্যমে বাণিজ্য, নিরাপত্তা সহযোগিতা ও সাংস্কৃতিক বন্ধন শক্তিশালী হতে পারে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়মান অর্থনীতির সাথে সংযুক্ত হতে পাকিস্তান আগ্রহী হতে পারে। পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীদের বিরোধিতার কারণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ব্যাহত হতে পারে। উভয় দেশের জাতীয় পরিচয়ে এই ইতিহাস গভীরভাবে প্রোথিত।

চলমান ইন্দো-পাকিস্তান উত্তেজনার কারণে পাকিস্তানের এই উদ্যোগকে সন্দেহের চোখে দেখতে পারে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি ও ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মিত্র ভারত। পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নতি দক্ষিণ এশীয় গতিশীলতায় পরিবর্তন আনতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন বা অর্থনৈতিক সমন্বয়ের মতো ইস্যুতে সহযোগিতা বাড়াতে পারে।

ভবিষ্যত বিবেচনায় তৃণমূল আন্দোলন তথা যৌথ ঐতিহাসিক কমিশন, সাংস্কৃতিক বিনিময় ইত্যাদি সুশীল সমাজের উদ্যোগ রুয়ান্ডা বা বলকানের মতো সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি, ডিজিটাল অগ্রগতি ইত্যাদি পাকিস্তানকে সম্পর্ক উন্নয়নে উৎসাহিত করতে পারে। প্রযুক্তি, জ্বালানি বা পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক চাপ বা জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের প্রস্তাব দায়বদ্ধতা বাড়াতে পারে। তবে সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণে প্রভাব সীমিত হবে।

এই কল্পনাপ্রসূত পরিস্থিতির বাস্তবায়ন ঘটলে তা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করবে। এর জন্য প্রয়োজন সাহসী নেতৃত্ব, গণসংলাপ ও বেদনাদায়ক সত্যের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছা। স্থায়ী প্রভাবের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার মতো প্রতীকী পদক্ষেপের পাশাপাশি শিক্ষা সংস্কার, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি বাস্তব কর্মসূচি প্রয়োজন, যেন ঐতিহাসিক স্মৃতি ভবিষ্যৎ সহযোগিতার পথ দেখায়। মৈত্রীর পথ কণ্টকাকীর্ণ, কিন্তু অসম্ভব নয়— যদি দুই রাষ্ট্রই সহানুভূতিকে প্রাধান্য দেয়।

পাকিস্তানের ১৯৭১ সালের গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা এবং ১৯৭১-পূর্ব সময়ের অধিকৃত সম্পদ ফেরত দেওয়ার সম্ভাবনায় এ ঘটনাসংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ, আন্তর্জাতিক নজির ও সম্ভাব্য রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করা হলো।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: সংখ্যা ও দলিল

১৯৭১-এর হত্যাযজ্ঞের পরিসংখ্যান

  • বাংলাদেশ সরকার ও গবেষকদের মতে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার-আলবদর বাহিনী ৯ মাসে প্রায় ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে, যা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ।
  • দুই থেকে চার লাখ নারী ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার শিকার হন, যাদের অনেককে ‘যুদ্ধবন্দি’ হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। (সূত্র: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ২০১৮)
  • এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে পালিয়ে যান, যা স্নায়ুযুদ্ধকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাস্তুচ্যুতি। (জাতিসংঘ, ১৯৭১)

পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ স্বীকারোক্তি

  • ১৯৭৪ সালের হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট (পাকিস্তানের গোপন তদন্ত) স্বীকার করে যে সেনাবাহিনী ‘অনিয়ন্ত্রিত হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে’ জড়িত ছিল। রিপোর্টটিতে ২৬ হাজার বেসামরিক মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হলেও গবেষকরা এটিকে ‘অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দেন।
  • ২০০২ সালে পাকিস্তানি সাংবাদিক আমির মির্জা লাহোর হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে ১৯৭১-এর ঘটনাকে ‘গণহত্যা’র স্বীকৃতি দাবি করেন, যা আদালত খারিজ করে দেন।

অর্থনৈতিক শোষণের তথ্য

  • ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের ৭০ শতাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়। (বাংলাদেশ: দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট, ড. রেহমান সোবহান, ১৯৭২)
  • যুদ্ধের পর পাকিস্তান ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার (১৯৭১ সালের মান) বাংলাদেশের কাছে ফেরত দেওয়া থেকে বিরত থাকে, যা বাংলাদেশ দাবি করে আসছে।

আন্তর্জাতিক নজির: ক্ষমা ও পুনর্মিলনের উদাহরণ

জার্মানি-ইসরায়েল (১৯৫২)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকস্টের দায় স্বীকার করে জার্মানি ইসরায়েলকে তিন বিলিয়ন মার্ক (বর্তমান মানে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার) ক্ষতিপূরণ দেয়। এর ভিত্তিতে দুই দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।

জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া (২০১৫)

যৌন দাসত্বে বাধ্য করা ‘কমফোর্ট উইমেন’দের জন্য জাপান এক বিলিয়ন ইয়েন (৯ মিলিয়ন ডলার) ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন করে। তবে সমালোচকরা এটিকে ‘পূর্ণ ক্ষমা’ বলে স্বীকার করেননি।

কানাডা-ইনুইট সম্প্রদায় (২০২১)

কানাডা সরকার বিংশ শতাব্দীতে ইনুইট শিশুদের জোর করে খ্রিষ্টান স্কুলে পাঠানোর জন্য ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয় এবং আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চায়।

সম্ভাব্য প্রভাব: ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক

ইতিবাচক প্রভাব

  • মানবিক পুনর্মিলন: ক্ষমা প্রার্থনা বাংলাদেশের ৫২ বছর ধরে জমে থাকা ‘ঐতিহাসিক অপরাধবোধের সংস্কৃতি’ প্রশমিত করতে পারে। ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে ৮৯ শতাংশ বাংলাদেশি পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়াকে ‘জাতীয় সম্মান পুনরুদ্ধারের শর্ত’ বলে উল্লেখ করেন।
  • অর্থনৈতিক সুবিধা: সম্পদ ফেরত পেলে বাংলাদেশ তা জলবায়ু তহবিল বা শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে। পাকিস্তানও বাংলাদেশের ৪৬ বিলিয়ন ডলার তৈরি পোশাকের বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেতে পারে।
  • আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা: ১৯৭১-পরবর্তী প্রথম ৫০ বছরে দুই দেশের বাণিজ্য মাত্র এক বিলিয়ন ডলার। সম্পর্ক উন্নয়ন সার্কের অচলাবস্থা কাটাতে পারে।

নেতিবাচক চ্যালেঞ্জ

  • পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া: পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও ডানপন্থি গোষ্ঠী (যেমন— জামায়াত-ই-ইসলামি) ক্ষমা চাওয়াকে ‘জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে প্রচার করতে পারে। ২০২০ সালে ইমরান খান সরকার মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুতে নীরবতা পালন করলে সমালোচিত হয়।
  • ভারত-চীন প্রভাব: পাকিস্তানের এই উদ্যোগকে ভারত ভাবমূর্তি গড়ে তোলার প্রয়াস হিসেবে দেখতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন পাকিস্তানের জন্য চীনের কাছ থেকে ‘ঋণের ফাঁদ’ থেকে বের হওয়ার পথ সুগম করতে পারে।
  • আইনি জটিলতা: ১৯৭১-পূর্ব সম্পদের হিস্যা নির্ধারণে দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থাকলেও পাকিস্তান মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার ফেরত দেয়।

যেসব বিষয় বিবেচ্য

  • যৌথ ঐতিহাসিক কমিশন গঠন: বাংলাদেশ-পাকিস্তান যৌথ কমিশন গঠন করে ঘটনার তথ্য যাচাই করা যায়। যেমন— ১৯৯০ সালে চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভাকিয়ার মডেল।
  • সাংস্কৃতিক বিনিময়: পাকিস্তানের লাহোর মিউজিয়ামে রাখা বাঙালি সাহিত্যিকদের পাণ্ডুলিপি (যেমন— কাজী নজরুল ইসলামের রচনা) ফেরত নেওয়া যেতে পারে।
  • অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব: সিপিইসির (চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর) অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব আসতে পারে।

১৯৭১-এর ক্ষমা ও পুনর্মিলন কেবল একটি অনৈতিহাসিক ‘যদি’ নয়, বরং একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ, যার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া তার ঔপনিবেশিকোত্তর ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারে। জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের ১৯৭০ সালে ওয়ারস জেট্টোতে নতজানু হওয়ার মতো একটি প্রতীকী মুহূর্তই বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ককে পুনর্সংজ্ঞায়িত করতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সত্যের প্রতি অঙ্গীকার এবং অতীতের চেয়ে ভবিষ্যতকে বড় করে দেখা।

লেখক: কোম্পানি সেক্রেটারি, সিটি ব্যাংক পিএলসি

r1 ad
r1 ad
top ad image