top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

ফিলিস্তিনের কান্না ও মানবতার প্রশ্ন: ইতিহাসের আয়নায় একটি রক্তাক্ত অধ্যায়

ফিলিস্তিনের কান্না ও মানবতার প্রশ্ন: ইতিহাসের আয়নায় একটি রক্তাক্ত অধ্যায়

বর্তমানে বিশ্ব একটি গভীর মানবিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ফিলিস্তিনের আকাশে বারুদের ধোঁয়া, ভূমিতে রক্তের ছাপ এবং বাতাসে শিশুর কান্না প্রমাণ করে দেয়, মানবতা আজ নিদারুণভাবে পরাজিত। প্রতিদিন ফিলিস্তিনে যে নারকীয় হামলা চালানো হচ্ছে, তা শুধু একটি ভূখণ্ড দখলের বিষয় নয়; এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, পরিচয় ও অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার এক নির্লজ্জ প্রচেষ্টা। মানবতা আজ কলঙ্কিত, বিবেক আজ যেন ঘুমন্ত। সময় এসেছে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর, ইতিহাসের গভীরে ফিরে তাকানোর।

ফিলিস্তিনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য

ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চল। এটি মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি— তিনটি প্রধান ধর্মের জন্যই পবিত্র স্থান। ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে অবস্থিত জেরুজালেম বা আল-কুদস শহরটি মুসলিমদের তৃতীয় পবিত্র স্থান, যেখানে রয়েছে আল-আকসা মসজিদ। মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এখান থেকেই মিরাজের সফর শুরু করেন।

ইতিহাসে দেখা যায়, ইসলামিক খেলাফতের শাসনামলে ফিলিস্তিন ছিল শান্তিপূর্ণ এক অঞ্চল, যেখানে মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইহুদিরা সহাবস্থানে জীবনযাপন করত। উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসনামলে এখানে উন্নত সংস্কৃতি, সাহিত্য ও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটেছিল। ফিলিস্তিন শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, এটি একটি সভ্যতা, একটি সংস্কৃতি, একটি পরিচয়ের প্রতীক।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ও ইসরায়েলের জন্ম

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার বেলফোর ঘোষণা (Balfour Declaration) প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ‘ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় আবাসভূমি গঠনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হবে।’ ওই সময় ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ১৯২০ সালে ‘ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ফর প্যালেস্টাইন’ কার্যকর হয়।

ব্রিটিশ শাসনামলে বিপুলসংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে অভিবাসন শুরু করে। বিশেষ করে নাৎসি জার্মানির ইহুদি নিধনের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই স্থানান্তর ব্যাপক রূপ নেয়। ফিলিস্তিনিদের মতামত উপেক্ষা করে ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ একটি বিভাজন পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যেখানে ৫৫ শতাংশ জমি ইহুদি রাষ্ট্রকে ও ৪৫ শতাংশ জমি আরব রাষ্ট্রকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়।

ফিলিস্তিনিরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। কারণ এটি তাদের নিজেদের ভূমিতেই সংখ্যালঘু করে তোলে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল একতরফাভাবে রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। পরদিন আরব দেশগুলো যুদ্ধ শুরু করে, যা ‘আল-নাকবা’ (The Catastrophe) নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই যুদ্ধের ফলে প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থীতে পরিণত হয়। তাদের ভূমি, ঘরবাড়ি দখল হয়ে যায়, এবং শুরু হয় এক দীর্ঘ রক্তাক্ত অধ্যায়।

ইসরায়েল রাষ্ট্র: গঠনের নেপথ্য এবং নৃশংসতা

ইসরায়েলের জন্ম থেকেই এর ভিত্তি রাখা হয়েছিল সামরিক দখল ও গণচিন্তার বিরুদ্ধাচরণ করে। একটি ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার ওপর প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্র তাদের ‘মোক্ষভূমি’ দাবি করে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনকে। ইহুদি বসতি স্থাপন, সামরিক দখল ও ফিলিস্তিনিদের নিধন ছিল তাদের নীতির অংশ।

বিশ্ব সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের এই দখলদারিত্বকে নীরবে মেনে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলোর একচোখা নীতির ফলে ইসরায়েল পায় আন্তর্জাতিক মদত ও অস্ত্র সহায়তা। জাতিসংঘের বহু প্রস্তাবনাকে উপেক্ষা করে তারা একের পর এক অবৈধ বসতি গড়ে তোলে পশ্চিম তীরে, গাজা উপত্যকায় চালায় গণহত্যা, ভেঙে ফেলে ঘরবাড়ি, ধ্বংস করে হাসপাতাল ও স্কুল।

গাজা: এক বন্দিশালার নাম

গাজা উপত্যকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ও অবরুদ্ধ অঞ্চল। এখানে প্রায় ২৩ লাখ মানুষের বসবাস, যাদের ৮০ শতাংশ শরণার্থী। ইসরায়েল ২০০৭ সাল থেকে গাজা পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে রেখেছে। সেখানে পানির সরবরাহ, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা, খাদ্য, এমনকি শিক্ষাও চরমভাবে বাধাগ্রস্ত।

প্রতিবার গাজায় হামলা চালানোর সময় ইসরায়েল দাবি করে তারা ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে’ রয়েছে। অথচ তাদের অভিযানে নিহতের মধ্যে অধিকাংশই সাধারণ মানুষ—নারী, শিশু, বৃদ্ধ। ২০২৩-২০২৪ সাল থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক হামলাগুলোতে দেখা গেছে, হাসপাতাল, স্কুল থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যমের অফিসকেও হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে।

মানবতা কোথায়?

বিশ্বের বিবেক আজ প্রশ্নবিদ্ধ। ফিলিস্তিনের শিশুদের চোখের জল, মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ, ধ্বংসস্তূপে কাতরাচ্ছে যে নবজাতক, তার কী অপরাধ? আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসংঘ, ইসলামি বিশ্ব— সবাই কেবল বিবৃতি দেয়, কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।

পশ্চিমা বিশ্ব যেখানে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে সোচ্চার, মানবাধিকারের বুলি আওড়ায়, সেখানে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে তারা নিশ্চুপ! এ দ্বিচারিতা মানবতার ইতিহাসে এক গ্লানিকর অধ্যায় হয়ে থাকবে।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলন

ফিলিস্তিনের সংগ্রাম শুধু একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য নয়, বরং এটি অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন। ১৯৬৪ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে ফিলিস্তিনি জনগণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।

১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদা (Intifada)— জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়। এরপর ২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা এবং নানা সময়ে হামাস ও অন্যান্য সংগঠনের প্রতিরোধ চালু থাকে। ফিলিস্তিনের জনগণ রক্তের বিনিময়ে প্রমাণ করে চলেছে যে, তারা পরাধীনতা মেনে নেয়নি, নিবে না।

একটি প্রশ্ন— দুই জাতি সমাধান কি সম্ভব?

বর্তমানে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ (টু স্টেট সল্যুশন) আলোচিত হলেও বাস্তবে ইসরায়েলের আগ্রাসন ও বসতি স্থাপনের কারণে এ সমাধান এখন প্রায় অচল। পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার অনেকটাই কল্পনার মতো হয়ে গেছে। তবুও শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায়— একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন, যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম।

ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফিলিস্তিন

ফিলিস্তিন বিশেষত আল-কুদস বা জেরুজালেম মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র স্থান। ইসলামের ইতিহাসে এটি প্রথম কেবলা, মিরাজের গন্তব্যস্থল এবং বহু নবীর পদচিহ্নে পরিপূর্ণ ভূমি। এই ভূমির পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষায় মুসলিম উম্মাহর নৈতিক, ধর্মীয় ও মানবিক দায়িত্ব রয়েছে।

হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি মজলুমের সাহায্যে এগিয়ে আসে না, আল্লাহ তাকে কেয়ামতের দিন সাহায্য করবেন না।’ এ বার্তা শুধু মুসলিমের জন্য নয়, মানবতার জন্যও প্রযোজ্য।

বিশ্ব বিবেকের প্রতি আহ্বান

আজ ফিলিস্তিনের বুকে রক্ত ঝরছে, আগুন জ্বলছে, শিশু অনাহারে কাতরাচ্ছে, মা বুক চাপড়ে কাঁদছে। এই মানবতা কোথায়? আমরা কি কেবল বিবৃতি দিয়ে চুপ থাকব?

এখন সময় এসেছে, মুসলিম উম্মাহ, মানবতাবাদী বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একসঙ্গে দাঁড়ানোর। আমাদের কণ্ঠ হতে হবে উচ্চকিত, বিবেক হতে হবে জাগ্রত, হাত বাড়াতে হবে সহানুভূতির।

মানবতা যেন আর ভূলুণ্ঠিত না হয়। ফিলিস্তিন যেন আবার হাসে, বাঁচে, গড়ে ওঠে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: মহাপরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, [email protected]

r1 ad
r1 ad
top ad image