top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

আইনের শাসনই রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার মেরুদণ্ড

আইনের শাসনই রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার মেরুদণ্ড

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আর একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তি আইনের শাসন। এই শাসন যদি কার্যকর না হয়, গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়ে। আইনের শাসন শুধু অপরাধ দমন বা শৃঙ্খলা রক্ষার উপায় নয়, এটি একটি জাতির ন্যায্যতা, ন্যায়বিচার ও নাগরিক স্বাধীনতার সুরক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। আজকের বাংলাদেশে আমরা যে নানাবিধ রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিচারহীনতা, দুর্নীতি, সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র দেখতে পাই, এর অন্যতম কারণ আইনের শাসনের অভাব।

আইনের শাসনের মৌলিক সংজ্ঞা ও তাৎপর্য

আইনের শাসন বলতে বোঝায় রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক— হোক না সে সাধারণ মানুষ বা শাসকগোষ্ঠীর কেউ— সবার জন্য একই আইন, একই বিচারপ্রক্রিয়া এবং সমান দায়বদ্ধতা থাকবে। এ ধারণা মূলত উঠে এসেছে প্রাচীন গ্রিস ও রোমান সভ্যতা থেকে। তবে আধুনিক ধারণাটি ব্রিটিশ চিন্তাবিদ এ ভি ডাইসির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। ডাইসি আইনের শাসনের তিনটি মূল উপাদান উল্লেখ করেছেন—

  • আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়;
  • ন্যায্য বিচারিক পদ্ধতির মাধ্যমে অধিকার নিশ্চিত করা; এবং
  • সাংবিধানিক নীতিমালার ভিত্তিতে শাসনপ্রক্রিয়া।

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭, ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদেও এই নীতির প্রতিফলন দেখা যায়।

বাস্তব প্রেক্ষাপট: আইনের শাসনের অভাব

বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একাধিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা, তদন্ত প্রক্রিয়ায় দুর্বলতা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন, রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতাসীনদের দায়মুক্তি— সব মিলিয়ে একটি গভীর সংকট তৈরি হয়েছে।

অনেক সময় দেখা যায়, অপরাধী প্রভাবশালী হলে তার বিচার হয় না, কিংবা হয় অনেক দেরিতে। আর সাধারণ কোনো নাগরিক হলে তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই দ্বৈত মানদণ্ডই আসলে আইনের শাসনের মূল বিরোধী শক্তি। বিচার না পাওয়ার প্রবণতা বা দীর্ঘসূত্রতা জনগণের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ ও অবিশ্বাস জন্ম দেয়। ফলে মানুষ বিচার চাইতে অনীহা বোধ করে, নিজের মতো করে প্রতিকার খোঁজে, যা কখনো কখনো নৈরাজ্য করে।

রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার স্বাধীনতা

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিরপেক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে এসব সংস্থা প্রায়শই রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিরোধী মতের কর্মীদের বিরুদ্ধে অহরহ মামলা, হয়রানি, গুম-খুনের অভিযোগ উঠেছে বারবার। পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও অনেকক্ষেত্রে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।

অন্যদিকে যারা জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের বেতন, প্রশিক্ষণ, কর্মপরিবেশ ও মনোবল উন্নয়নেও পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। সুশৃঙ্খল, দক্ষ ও নিরপেক্ষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়া একটি রাষ্ট্রে আইনের শাসন কার্যকর করা সম্ভব নয়।

বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা ও দক্ষতা

আইনের শাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগ যদি নির্বাহী বিভাগের দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাহলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, মামলার দীর্ঘসূত্রতা হ্রাস, ডিজিটাল বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং বিচারকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এই সমস্যাগুলোর সমাধানে কার্যকর হতে পারে।

একটি কার্যকর বিচার ব্যবস্থা গড়তে হলে মামলার নিষ্পত্তিতে সময়সীমা নির্ধারণ, সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতির (ADR) ব্যবহার বাড়াতে হবে। এতে জনগণ বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরে পাবে।

দুর্নীতি ও আইনের শাসন

বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বহু বছর ধরেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সূচকে নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। দুর্নীতি ও আইনের শাসন একে অপরের পরিপন্থি। দুর্নীতি তখনই বাড়ে যখন অপরাধীরা শাস্তি থেকে মুক্তি পায়। দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার হলেও যদি শাস্তি না হয়, তবে তা সমাজে ভুল বার্তা দেয়— ‘ক্ষমতা থাকলে সব চলে।’

দুর্নীতি দমনে কেবল আইন থাকলেই হয় না, দরকার কঠোর প্রয়োগ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। দুর্নীতিবিরোধী কমিশনের (দুদক) স্বাধীনতা, সংস্থাটির জনবল ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো অপরিহার্য।

নাগরিক সচেতনতা ও গণমাধ্যমের ভূমিকা

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি জনগণের সচেতনতাও অপরিহার্য। জনগণ যদি নিজের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শেখে, তবে রাষ্ট্রও বাধ্য হয় জবাবদিহি করতে। এই ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে উৎসাহ দেওয়া এবং তথ্য অধিকার নিশ্চিত করাও আইনের শাসনকে শক্তিশালী করতে পারে। তবে দুঃখজনকভাবে অনেক সময় গণমাধ্যমকেও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার সাংবাদিকদের ওপর হামলা, হুমকি ও হয়রানি বন্ধ না হলে গণতন্ত্র যেমন ব্যাহত হয়, তেমনি আইনের শাসনও দুর্বল হয়ে পড়ে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অত্যন্ত জরুরি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ যেসব আইন জনগণের কণ্ঠরোধ করে, তা আইনের শাসনের মূলনীতির পরিপন্থি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে জনগণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে না, গণতন্ত্রও বিকশিত হতে পারে না। এসব আইন প্রয়োগে সংযম ও ন্যায্যতা বজায় রাখা প্রয়োজন।

পথসমাধান: করণীয় কিছু দিক

  • সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে;
  • নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে;
  • রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া আইনের শাসন কার্যকর হয় না। তাই সব দলকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ন্যায্য ও শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা গড়ার জন্য সম্মত হতে হবে;
  • মানবাধিকার কমিশন, দুদক, নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সংস্থাগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে;
  • শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কে পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে;
  • আইনজীবী, বিচারক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে।

শেষ কিছু কথা

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা একটি সময়সাপেক্ষ কাজ। তবে এটি ছাড়া কোনো রাষ্ট্রই টেকসই উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পারে না। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবচেয়ে জরুরি হলো— একটি শক্তিশালী, কার্যকর ও নিরপেক্ষ আইনের শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

শুধু বক্তৃতা-বিবৃতিতে নয়, বাস্তব কর্মপরিকল্পনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই বাংলাদেশ সত্যিকারের একটি সুবিচারভিত্তিক, মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বিভাগ

[email protected]

r1 ad
top ad image