top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

১৬ ডিসেম্বর: আত্মপ্রতিষ্ঠার বিজয়

১৬ ডিসেম্বর: আত্মপ্রতিষ্ঠার বিজয়
ইফতেখার আহমেদ খান

ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। এই মাসটির ১৬ তারিখে সার্বভৌম সত্তা হিসাবে বাংলা ভাষার বাংলাদেশ বিশ্বসভ্যতায় তার উপস্থিতি ও অবস্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় একটি ভাষাভিত্তিক পরিক্রমা। নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে বাঙালি সত্তাটি একটি উপ-সংস্কৃতির অবস্থানে আছে। তেমনই পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙলা ছিল মূল জাতীয় সংস্কৃতির উপ-সংস্কৃতি।

পাকিস্তানি শাসন ছিন্ন করে বাংলা আজ এক স্বাধীন সার্বভৌম মূল সংস্কৃতি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মাস থেকে প্রথম বাঙালির শাসন বাঙালির হাতে আসে। বাঙালি জাতির বিকাশ অনুসন্ধানে হাজার বছরের বাস্তবতায় এর আগে কখনও বাঙালি বাংলার শাসক হয়নি। বলা প্রয়োজন সিরাজউদ্দৌলা, মুঘল, তুর্কি, পাকিস্তানি-এসব শাসকদের কেউই বাঙালি ছিলেন না।

একটি ভাষা তার অর্ন্তনিহীত শক্তিমূলে আর্বিভাব ঘটিয়েছে একটি রাষ্ট্রের, বাংলা ভাষার রাষ্ট্র বাংলাদেশ। দৃষ্টান্তটি বিশ্বসভ্যতায় বিরল। উপনিবেশ-উত্তর আমলে বাংলাদেশই একমাত্র ভূখন্ড যেটি নৃ-তাত্ত্বিক ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছিল।

এর আগে এশিয়া, আফ্রিকা কিংবা সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকাতেও এই ধরনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি হতে পারেনি। বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র, জাতিরাষ্ট্র নির্মাণ আধুনিকতার সূত্রে সমর্থিত, সারা ইউরোপ তার দৃষ্টান্ত।

উনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে নবাব আবদুল লতিফ বলেছিলেন- বাঙালি মুসলমানের মার্তৃভাষা হচ্ছে উর্দু। ছোটলোকদের ভাষা বাংলা। এদের ধীরে ধীরে উর্দুতে কনভার্ট করতে হবে। এই ভয়াবহ রকমের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিতর দিয়ে বাঙালিসমাজ বিকশিত হয়েছে।

ইতিহাসের সামান্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় মুসলিম লীগের তত্ত্বাবধানে যেসব মুসলমান নের্তৃস্থানীয় পর্যায়ে ছিলেন, তারা সকলেই ছিলেন উর্দুওয়ালা। তারা উর্দুভাষী মুসলমান। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলেনে নের্তৃস্থানীয় কেউ বাঙালি মুসলমান ছিলেন না। বাঙালি মুসলমানরা সেই সময় উর্দুওয়ালা মুসলমান নের্তৃত্বের আজ্ঞাবহী শ্রেণি হিসাবে ভূমিকা নিয়েছে হিন্দুর প্রতি বিদ্বেষের কারণে।

উল্লেখ্য, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের বিষয়ে আমাদের বাংলার বাঘ কিছুই জানতেন না। তিনি কেবল সেই প্রস্তাব উথ্থাপনকারী ছিলেন। ধর্মভীরু, কুসংস্কারচ্ছন্ন, রক্ষণশীল ইত্যাদি কারণে এবং ইংরেজদের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়া হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষের কারণে এ দেশের বাঙালি মুসলমান মুসলীম লীগের ছায়াতলে আসে। বাঙালি একটি জাতি, রাষ্ট্র হলো সেই জাতির রাজনৈতিক অভিপ্রকাশ।

আমাদের বিজয় দিবসের তাৎপর্য বুঝতে হলে জাতি হিসাবে বাঙালির বিকাশ প্রক্রিয়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি দেখা দরকার। প্রথমেই প্রশ্ন আসে জাতি কী? আমরা প্রায়ই জাতি এবং সম্প্রদায় এই দুটি বিষয় গুলিয়ে ফেলি। মনে রাখা দরকার জাতি আর সম্প্রদায় এক নয়। সম্প্রদায় জাতির একটি অংশ। যেমন, বাঙালি একটি জাতি। হিন্দু বাঙালিজাতির একটি সম্প্রদায়, মুসলমান তেমনি আরেকটি সম্প্রদায়। একদল জনগোষ্ঠী যাদের মধ্যে কিছু উপাদানের অভিন্নতা দেখা যায় এবং যেসব উপাদানের সমষ্ঠিতে অভিন্ন জীবনব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সেই একদল জনসমষ্ঠি হলো একটি জাতি।

এর উপাদানগুলো হলো: ভাষা, অর্থনীতি, উৎপাদন পদ্ধতি, খাদ্য, পোশাক, আচার-আচরণ, চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ, সঙ্গীত, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, প্রথা সর্বোপরি সামগ্রিক জীবনধারা। এইসব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে একদল মানুষকে একটি জাতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়, যেমন, বাঙালি একটি জাতি।

বাঙালি জাতির এসব উপাদান ব্যখ্যা করলে দেখা যায় উপাদানে অর্ন্তভুক্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বড় মাপের কোনো ভিন্নতা নেই । যেমন ,বাঙালির ভাষা বাংলা, অর্থনীতি কৃষি, পোশাক পরিচ্ছেদ, খাদ্য, সঙ্গীত, চিন্তা, চেতনা সার্বিক জীবনাচরণ ইত্যাদি একই রকম। অর্থাৎ জাতিগঠনের অপরিহার্য উপাদানের ভিত্তিতে বাঙালি একটি জাতি।

বাঙালি জাতির একটি সুপ্রাচীন ইাতহাস রয়েছে। ভারতবর্ষ একটি প্রাচীন সভ্যতা। এখানে হাজার বছর ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী পরস্পর বসবাস করে আসছে। যেমন, বাঙালি, বিহারি, সিন্ধি,তামিল, গুজরাটি আরও অনেক। এখানে বাঙালি জাতিও এথনিক অবস্থা হতে বিকশিত হতে হতে এই অবস্থায় এসেছে। জাতিগঠনের সবকয়টি উপাদানের উপস্থিতি এখানে লক্ষ করা যায় তার মধ্যে ভাষা অন্যতম।

বাঙালির রাষ্ট্র গঠনের প্রেক্ষাপটে ১৯৫২ এবং তার পরবর্তী ঘটনাসমূহ জাতীয়তাবাদ বিকাশের আধুনিক পর্যায় বলা যেতে পেরে। প্রাচীন বাংলায় বাঙালি জনগণ বাংলা ভূ-খন্ডের বিভিন্নস্থানে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করত। মধ্যযুগে অন্য জাতিগোষ্ঠীর মতো বাঙালিরা তাদের স্বাভাবিক বিকাশ প্রক্রিয়ার পথেই ছিল।

১৯৪৭ সালের দেশভাগ বাঙালি জনগগোষ্ঠী পূর্ববাংলা এবং পশ্চিমবাংলা এই দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এতে পশ্চিমবাংলা হয়ে যায় ভারতের সহ-সংস্কৃতি পূর্ববাংলা হয় পাকিস্তানের সহ-সংস্কৃতি। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে বাঙালি জাতিগোষ্ঠী নানাভাবে বৈষম্যের স্বীকার হয়। ক্ষমতা কাঠামোর বিন্যাসটি গড়ে ওঠে অসমভাবে যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রীক। বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক নের্তৃত্ব থেকে শুরু করে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকায় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালিরা।

ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর প্রথম থেকেই স্বার্থগত বিষয়কে কেন্দ্র করে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। এমন অবস্থায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে থাকে। এই অগ্রসরমান জীবনবোধে জাতি প্রত্যক্ষ করে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বৈষম্যসমূহ। যার ফলে বাঙালি জাতির মধ্যে বোধের জন্ম হয় এবং নিজস্ব জাতিসত্তা বিকাশের প্রশ্নটি ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিষয়টি সামনে এসে দাঁড়ায়। গড়ে ওঠে বিভিন্নমুখী আন্দোলন।

১৯৪৭ সালের পর থেকে নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি আলাদা ভূখন্ডে স্বাধীনতা অর্জন করে। এসব ঘটনাগুলো বাঙালির রাষ্ট্রগঠনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। ভারতীয় সভ্যতায় অন্যান্য এথনিক গ্রুপের মধ্যে বাঙালি এথনিক গ্রুপ আজ একটি স্বীকৃত জাতি।

বর্তমানে এপার বাংলা ওপার বাংলায় ত্রিশ কোটিরও অধিক বাঙালি রয়েছে। শুরুতে এই সংখ্যা এতো ছিল না। সংখ্যায় আরও কম ছিল। তখন তারা প্রাচীন জনপদ যেমন গৌর, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল, বরেন্দ্র ইত্যাদি স্থানে বসবাস করত।

মিশ্র রক্তে গড়ে উঠা বাঙালির আদিরূপ বা প্রাথমিক অবস্থাকে বলা হয় এথনিক। বাঙালি জাতি এই অবস্থা হতে বিকাশ লাভ করে আজ এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। আজ বাঙালি রাষ্ট্র গঠন করেছে। এর মধ্যে পার হয়েছে হাজার বছর।

যখন একটি জনগোষ্ঠী বিভিন্ন উপাদানের ভিত্তিতে নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে তখন তারা একটি জাতিতে পরিণত হয়। আর এই জাতীয়তার অনুভূতি হলো জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তার ভিত্তিতে উদ্বুদ্ধ জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রগঠনের জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এটাই এথনিক গ্রুপের বিকাশের ধরন: জাত → জাতি→ জাতীয়→ জাতীয়তা→ জাতীয়তাবাদ → রাষ্ট্র (জাতীয়তাবাদের পরিণাম)।

এই সময়গুলো অতিক্রমের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি নির্মাণ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র। রাষ্ট্র গঠনের যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তার পুরোটার নেতৃত্ব এসেছে শেখ মুজিবের কাছ থেকে। শেখ মুজিব সাতকোটি জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বাঙালির রাষ্ট্র বাংলাদেশ গঠন করেন।

বাঙালির হাজার বৎসরের যে ইতিহাস তাতে শেখ মুজিবই প্রথম ব্যক্তি যিনি বাঙালি জনগোষ্ঠীকে সার্বভৌম ক্ষমতা এনে দেন । এজন্য তাকে বলা হয় হাজার বৎসরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে নোবেল পেয়ে বাংলাভাষাকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করেছেন । শেখ মুজিব ১৯৭১ সালে সাত কোটি বাঙালি নিয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটিয়েছেন।

সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগে কখনওই বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অর্জন করেনি। জাতি জীবন্তসত্তা আর রাষ্ট্র বিমূর্ত বিষয়। বাঙালিরা আগে পরিণত জাতি হয়েছে তার পর গঠন করেছে রাষ্ট্র। জাতিত্বই কোন্ও জাতির মৌলিক পরিচয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সেই ঐতিহাসিক দিন যেদিন সার্বভৌম সত্তা হিসাবে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।

ইফতেখার আহমেদ খান: উন্নয়নকর্মী ও লেখক

r1 ad
r1 ad