top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

মাওলানা ভাসানীর রাজনীতির পথেই হাঁটছে বিএনপি

মাওলানা ভাসানীর রাজনীতির পথেই হাঁটছে বিএনপি
বিএনপি লোগো

১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার কারণে মাওলানা ভাসানীর রাজনীতিতে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। একজন ত্যাগী জননেতা হয়েও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি স্থান করে নিতে পারেননি। তাইতো অনুসারীরা তার অবর্তমানে স্বৈরাচার সামরিক সরকারের সাথে বিলীন হয়ে যায়।

ভাসানীর মতো তার অনুসারীরা আজও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেন। এটা করে তারা ভাসানীর দল ও আদর্শের রাজনীতির কবর রচনা করেছেন।

অবশ্য আমার মতে, বড় মাপের নেতা হলেও কোনও আর্দশতেই মাওলানা ভাসানী স্থির ছিলেন না। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ওনার রাজনৈতিক জীবন ছিল স্ববিরোধীতাপূর্ণ।

আইয়ুব খান ও জিয়াউর রহমানসহ সামরিক শাসকদের তিনি সমর্থন করেছেন। খুনি মোশতাক তার সমর্থন পেয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ভাসানী সব সময় ফাঁপা বুলি আওড়াতেন। তার বক্তব্যের সঙ্গে এখনকার বিএনপির অনেক নেতার বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়।

কারা মাওলানা ভাসানীকে বামচিন্তা ধারার মোড়কে ব্যাবহার করার চেষ্টা করেছিলেন-তা পরিষ্কার হয়ে যায় মাওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর। মাওলানা ভাসানী নির্বাচনের রাজনীতি ও ক্ষমতার রাজনীতির চেয়ে সামরিক-বেসামরিক আমলা প্রভাবিত পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরোধিতায় মনোযোগী ছিলেন। কিন্তু স্বাধীন দেশে তাঁর রাজনৈতিক গুরুত্ব অবশিষ্ট ছিল না।

এ প্রসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে চলে আসে। তিনি কি বঙ্গবন্ধুর শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন? ১৯৭৩ এর নির্বাচনে তাঁর দলের প্রতীক ‘ধানের শীষ’ কি সাড়া জাগাতে পেরেছিল? বঙ্গবন্ধু খুনের পর তাঁর ভূমিকা কী ছিল? তিনি ও তাঁর দল বঙ্গবন্ধু খুনের প্রতিবাদে কেন অংশ নেননি?

১৯৭৬ সালে ১৭ মে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘ফারাক্কা লং মার্চ’ করতে পারলেন, আর বঙ্গবন্ধু খুনের প্রতিবাদ তিনি করতে কেনো পারলেন না? অসাংবিধানিক খুনি সামরিক বাহিনী প্রভাবিত সরকারের বিরুদ্ধে একটি বাক্য তিনি ব্যয় করেছিলেন কি?

মাওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর তাঁর দল সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের ফ্রন্টে যোগ দিয়েছিল। মশিউর রহমান যাদু মিয়া রেল যোগাযোগমন্ত্রীর দয়িত্ব নিয়েছিলেন। যাদু মিয়ার মৃত্যুর পর ন্যাপ (ভাসানী) সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দলে অনেকটাই বিলীন হয়ে যায়। সেই দলই আবার সামরিক-বেসামরিক আমলা প্রভাবিত রাজনীতির সূচনা করেছিল, গ্রহণ করেছিল ভাসানীর ধানের শীষ প্রতীক।

ভাসানী আওয়ামী লীগ ছেড়েছেন, ন্যাপ ছেড়েছেন। তার সর্বশেষ রাজনৈতিক দলের নাম ‘খোদা-ই-খিদমতগার’। তার অগনিত অনুসারী আছে, কিন্তু ‘খোদা-ই- খিদমতগার’ দলের কোনও কর্মী কোথাও দেখি না। কেউ এই দলটি সমর্থন করে না। আর এই দলটির কথা কাউকে বলতেও শুনি না, এটাই সত্য।

মাওলানা ভাসানীকে কখনো ধর্মীয় নেতা, কখনো লালন সমর্থক, শ্রমিকের পক্ষের কন্ঠ আবার কখনও সামরিক শাসনের পক্ষে কাজ করতে দেখা গেছে। তিনি বহুরূপ ও বহু মতের একজন মানুষ।

১৯৭২ সালে বাংদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময়, সেক্যুলার নয় ‘কোরআন সুন্নাহর আলোকে’ সংবিধান প্রনয়নের দাবি তুলেছিলেন মাওলানা ভাসানী। এই কথা কেউ এখন আর বলেন না। তবে এটাই সত্য। বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধা করতেন মাওলানা ভাসানীকে, আর তিনি বঙ্গবন্ধু খুনের পর খুনিদের ‘সুর্য সম্তান’ বলে আখ্যা দেন। এই কথাটাও কেউ আর বলে না, তবে এটাই সত্য।

আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হচ্ছে, বড় মাপের নেতা হলেও তিনি নিজের ভালো বুঝতেন না। অনেকক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আত্মঘাতী। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশে (১৯৭২-৭৫) সালে কেউ স্লোগান দিয়েছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র আর কেউ স্লোগন দিয়েছিল ইসলামী সমাজতন্ত্র। জনগণ দেখল বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ (১৯৭৫-১৯৯০) পর্যন্ত একদলীয় সামরিক শাসন। আসলে মানুষের প্রায় সব অধিকার হরণ করার নাম হচ্ছে সামরিক শাসন। আর আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় ভণ্ডামি এবং ধান্দাবাজি শব্দ হচ্ছে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ও ইসলামী সমাজতন্ত্র।

বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে রক্ষী বাহিনী আর সেনাবাহিনীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিল। রক্ষী বাহিনীতে সবাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া যোদ্ধা। কোনও পাকিস্তান ফেরত সেনা সদস্য রক্ষী বাহিনীতে ছিল না। অপর পক্ষে সব পাকিস্তান ফেরত সেনা সদস্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। পাকিস্তান ফেরত ও পাকিস্তানপন্থিরা রক্ষী বাহিনীর ওপর মিথ্যা প্রচারণার কলঙ্ক লেপন করেছিল। এটা আজও তারা অহরহ বলে বেড়ায়, এদের অনেকেই আবার ‘পাকি প্রেমিক’ বলে পরিচিত।

আপনি আপনার আত্মীয়-স্বজনসহ বিভিন্ন মানুষকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, কোন এলাকায়, কাকে রক্ষী বাহিনী অত্যাচার করেছে? আপনার এলাকায় খবর নিলেই বুঝতে পারবেন এর সত্যতা নেই। তবে হ্যাঁ, রক্ষী বাহিনী যদি কাউকে অত্যাচার করে থাকে, তারা ছিল অত্যাচারী, লুণ্ঠনকারী, সর্বোপরি পাকিস্তানপন্থি। অপপ্রচারের তুলনায় এসব ঘটনা ছিল খুবই নগণ্য।

সামরিক শাসক জিয়ার দায়িত্ব ছিল রক্ষী বাহিনীর বিচার করা। কিন্তু তা না করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যকে কোর্ট মার্শাল দিয়ে বিনা বিচারে হত্যা করেন তিনি। এটাও কেউ বলে না, তবে এটাই সত্য।

আজ ক্ষমতার রাজনীতিতে ড. কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে মিশে গেলেন। এমনকি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলতেও কারও কারও মুখে আটকায়নি। তারা জিয়ার মাজারে মোনাজাত করে রাজনীতিকে নীতিহীন চর্চাকেন্দ্র বানিয়েছেন। ১৫ আগস্টে যারা বেগম খালেদা জিয়ার নকল জন্মদিন পালন করতে পৈশাচিক উল্লাসে মেতে ওঠেন, সেই বিএনপির সঙ্গে তারা হাত মেলান কীভাবে?

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কিন্তু ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের সম্পর্কে ধারণা সবার কাছে পরিষ্কার।

সেই বিএনপির হাল ধরেছেন মাওলানা ভাসানীর কমরেড মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ভাসানীর অনুসারীদের মধ্যে আব্দুল্লাহ আল নোমান, নজরুল ইসলাম খান, শামসুজ্জামান দুদু, জহির উদ্দিন স্বপন, আসাদুজ্জামান রিপন প্রমুখ দলটির শীর্ষ নেতা। তাদের মধ্যে মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক আদর্শ হয়তো এখনও প্রবাহমান।

ভাসানীর আদর্শ ও অনুসারীদের কারণেই কী বিএনপি নির্বাচনবিমুখ রাজনৈতিক দল হয়ে উঠছে? তা হয়ে থাকলে পরিণতি জনপ্রিয় নেতা মাওলানা ভাসানীর মতো হতে পারে। যে দলের প্রচুর সমর্থক থাকলেও নেতৃত্বের ভুলে, নির্বাচনবিমুখ রাজনীতির কারণে বা হতাশাগ্রস্থ হয়ে কর্মীবাহিনী থাকবে না। আর ত্যাগী নেতা বা কর্মীছাড়া একটি রাজনৈতিক দল রাজপথে বা ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব রাখতে পারবে-এই চিন্তা যারা করেন তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রশ্নবিদ্ধ।

জেমী হাফিজ, সমাজকর্মী

r1 ad
r1 ad