বইমেলা হোক সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র

‘বইমেলা শুধুই বই কেনা-বেচার জন্য নয়, বইমেলা সবাইকে আকৃষ্ট করে ও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করবে।’ এই উক্তিটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করেছেন ১ ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।
সরকারপ্রধানের বক্তব্যে আরও উঠে এসেছে যে এই গ্রন্থমেলা অনেক নবীন লেখককে তাদের সাহিত্যচর্চার কর্মফল প্রকাশের সুযোগ করে দেয় এবং নতুন পাঠক তৈরিতে বিশেষ অবদান রাখে।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে নানা সংগ্রামের পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বিশ্বের মানুষের কাছেই এক মহাবিস্ময়কর ব্যাপার হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। আবেগময় এই ভাষণ থেকে বেরিয়ে আসে বাংলা ভাষাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম; যা ১৯৪৭-এর দেশ বিভক্তির পর থেকে শুরু হয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির চূড়ান্ত রূপ নেয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামসহ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা মূল চার নীতি যথাক্রমে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে।
একুশের ভাষা আন্দোলন আমাদের শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ; যা প্রতি বছর কালের বৈচিত্র্যে শীত-বসন্তে আমাদের কাছে উপস্থিত হয় বহুমাত্রিকতায়, যাকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘প্রাণের মেলা’।
এবারকার গ্রন্থমেলার পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে পাঁচ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিলে যেখানে সারা মাসব্যাপী অনুষ্ঠানের মধ্যে থাকবে সাংস্কৃতিক পারিবেশনা, সেমিনার, আলোচনা সভা ইত্যাদি।
আবার বইয়ের স্টলের সংখ্যাও বিগত বছরের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় দর্শনার্থীরা তাদের ইচ্ছেমতো ঘুরেফিরে বই ক্রয়ের আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের ১৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে এবার একুশে পদক ২০২৫ প্রদান করেছে সরকার। পদক প্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন গবেষণায় মঈদুল হাসান, ভাষা ও সাহিত্যে মরণোত্তর বিশিষ্ট সাহিত্যিক শহীদুল জহির (মো. শহীদুল হক) এবং কবি হেলাল হাফিজ, সংস্কৃতি ও শিক্ষায় ড. শহীদুল আলম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মেহেদী হাসান খান (অভ্র কী-বোর্ডের উদ্ভাবক), সাংবাদিকতায় সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ (মরণোত্তর), আর সাংবাদিকতা ও মানবাধিকারে মাহমুদুর রহমান, চলচ্চিত্রে মরণোত্তর খ্যাতিমান পরিচালক আজিজুর রহমান (ছুটির ঘণ্টা), সংগীতে উস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া (মরণোত্তর) এবং ফেরদৌস আরা, আলোকচিত্রে নাসির আলী মামুন, চিত্রকলায় রোকেয়া সুলতানা, শিক্ষায় ড. নিয়াজ জামান, সমাজসেবায় (মরণোত্তর মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী।
প্রধান উপদেষ্টার মতোই অনেক সাহিত্যিক মনে করেন বইমেলা শুধু কেনা-বেচা নয় এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, গণতন্ত্রের আন্দোলন, জাতীয়তাবাদীর চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই গ্রন্থমেলার সঙ্গে জড়িত আছে সংস্থা হিসেবে বাংলা একাডেমি, বই প্রকাশক সংস্থা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বই স্টলে, লেখক ও অগণিত পাঠক। এসব অংশীদারের নিজস্ব একটা ব্যবসায়িক দিক রয়েছে শিল্প সংস্কৃতি চর্চার অন্তরালে। বাংলা একাডেমি তাদের আয়োজনের অংশ হিসেবে যে স্টল বরাদ্দ দিয়ে থাকে সেখান থেকে একটি মোট অঙ্কের টাকা রাজস্ব আসে।
আবার যারা স্টল বরাদ্দ নিয়ে তাদের বই প্রদর্শনের আয়োজন করে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে যার মধ্যে রয়েছে পূর্বে আলোচিত প্রকাশক, লেখক, ব্যবসায়ী যাদেরও দিন শেষে আয়-ব্যয়ের একটি হিসাব রাখতে হয় এই মেলাকে ঘিরে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় পণ্য হিসাবে বই ক্রেতার বহুরূপিতা যেমন কেউ ছাত্র-ছাত্রী, কেউ গবেষক, কেউ শৌখিন ক্রেতা, কেউ আবার কবি সাহিত্যিক, কেউ আবার শিশু শ্রেণির এবং কেউ আবার প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধি যারা নিজের প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করার জন্য ক্রেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
একটি তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের বইমেলায় ১০০ কোটি টাকার উপরে বই বিক্রি হয়েছিল এবং বর্তমান বছরে এই অংকটি আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়; যা একটি সুখবর। বিশেষত আমাদের মতো বই পাঠের চর্চাবিমুখ মানুষের দেশে। সেই বইগুলো বইপ্রেমিক মানুষের বাসার সৌন্দর্য বর্ধনের উপকরণও বটে, যা বই মেলারই অবদান। কারণ বইয়ের চেয়ে সুন্দর কিছু আছে বলে মনে হয় না। যা প্রতিটি সৃজনশীল সংস্কৃতিমনা মানুষই বোঝেন।
তারা বছরের এই ক্ষণটির দিকে তাকিয়ে থাকে কখন ফেব্রুয়ারি মাস আসবে আর প্রকাশনা সংস্থা তথা মুদ্রণ কর্মীরা তাদের বিনিদ্র রজনী কাটাবে মেলা শুরু হওয়ার আগে থেকেই নতুন বই মুদ্রণের প্রয়াসে যা প্রকাশনা শিল্পের জন্য একটি আলোকিত দিক। প্রতিদিনই মেলায় নতুন বই আসছে যা মেলার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে প্রচার করা হয়ে থাকে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মীরা তাদের বিধিবদ্ধ দায়িত্বের অংশ হিসাবে বিশেষ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তাদের নির্ধারিত চ্যানেলগুলোতে সংবাদের অংশ হিসাবে প্রচার করছে প্রতিনিয়ত। এই ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এবং ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতির মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি বৈদেশিক অঙ্গনে অনেক প্রসারিত হয়েছে।
এখন সাহিত্যের মানদণ্ডে আমরা যদি এই সময়টিকে ঘিরে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সৃষ্টির বিষয়গুলোকে মূল্যায়ন করি তা হলে দেখা যাবে কবিতা ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে একটা শূন্যতার আভাস অর্থাৎ সাহিত্যের অন্যান্য শাখার চেয়ে এই শাখা দুটোতে সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে সৃষ্টি কম। আবার অন্যান্য শাখায় লেখক থাকলেও মানসম্মত লেখার স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয় এই ফেব্রুয়ারি মাসকে ঘিরে। যারা সাহিত্য সমালোচক তারা বলছেন মানসম্মত সাহিত্য এবং সাহিত্যিকের সংখ্যা ক্রম অবনতিশীল বিধায় আগ্রহে ও পেশায় দুটোতেই কেমন একটা স্থবিরতা পরিলক্ষিত হয় সৃষ্টিশীল কাজে। বিষয়টি এমন যে সাহিত্য সৃষ্টি বা সাহিত্যিক হওয়া একটা ব্যক্তিগত আগ্রহের ব্যাপার যা একটি অনুকূল পরিবেশ পেলে প্রস্ফুটিত হয় যার ধারাবাহিকতা অনেকদিন পর্যন্ত চলে। এটি কোন অনুকরণের বিষয় কিংবা শৌখিন বিষয় নয়। এই জায়গাটিতেই সংকট রয়েছে।
কেউ যদি এটাকে পেশা হিসাবে নিতে চায় তবে আর্থিক দৈন্যতার সম্মুখীন হতে হবে এটাই বাস্তব বিশেষত প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতির যুগে যেখানে জ্ঞান চর্চার ফসলের বাজার সংগঠিত নয় আবার সামাজিক স্বীকৃতিও সহজই ধরা দেয় না। যার ফলশ্রুতিতে ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চাও ক্ষীণ হয়ে আসছে প্রজন্ম শূন্যতার কারণে। যারা চলে যাচ্ছে আর যারা আসছে তাদের মধ্যে গুণগত পার্থক্য আকাশ জমিন যা শুধু সাহিত্য বা ভাষার ক্ষেত্রেই নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে। ফলে মনের খোরাকের জন্য যে সাহিত্য প্রয়োজন সে জায়গাটিতে খাদ্য নিরাপত্তার অভাব রয়েছে যার ফলে অস্থিরতা বা অসন্তোষ বা অস্বস্তি এখন প্রায় সব পরিবারেই নিত্যদিনের সাথী যা মনের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। এই ধরনের একটি আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিতে সাহিত্যিক, উপন্যাসিক কিংবা কবি সৃষ্টি বিশেষত মাসজুড়ে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে কতটুকু অবদান রাখবে তা ভেবে দেখার বিষয় ।
যারা জনপ্রিয়তা চায় তাদের জন্য এই ধরনের মেলা সাহিত্য কেনা বেচার একটি ক্ষেত্র হতে পারে কিন্তু ভালো সাহিত্য বা সৃজনশীল সাহিত্যসৃষ্টি কতটুকু সম্ভব হবে তাও দেখার বিষয়। তবে আয়োজক সংস্থা বাংলা একাডেমি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও তাদেরকেও অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে এই মেলার আয়োজন করতে হয় বিশেষত দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে। কারণ অতীতের অনেক জীবনহানির ঘটনা এই মেলাকে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয়েছে; যা আমাদের একুশের চেতনাকে বিনষ্ট করেছে।
মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সৃজনশীলতা প্রকাশনার চর্চা, সৃজনশীল সাহিত্য ইত্যাদি অনেকক্ষেত্র এই মেলায় আগত কবি সাহিত্যিক দর্শনার্থীদের জীবনের ঝুঁকি যে বাড়িয়ে দেয় তা আমাদের মনে রাখতে হবে অতীতির ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। তাই আমাদের মতাদর্শগত বিরোধগুলো রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে, গ্রন্থমেলা কোনোভাবেই তার ক্ষেত্র হতে পারে না বা ক্ষেত্র হতে দেওয়া যায় না। তাহলে পূর্বে ঘোষিত প্রাণের মেলা কথাটির কোনো গুরুত্বই থাকে না যদিও এর মধ্যে অনেক আবেগ রয়েছে যা দিয়ে সত্যিকার অর্থে জীবন চলে না।
এখন যারা সাধারণ মানুষ কিংবা ছাত্র-ছাত্রী তাদের কাছে এই সকল কথার অর্থ নিরর্থক বলে মনে হতেই পারে। আমাদের দেশে যত বেশি লেখক তৈরি হবে তত বেশি পাঠকের সংখ্যা বাড়বে কারণ একজন লেখক একজন পাঠকও। আর লেখা বাড়লেও প্রকাশনা শিল্প আরও বেশি অবদান রাখবে অর্থনীতিতে যা আমাদের আশার আলো দেখাবে সামনের দিকে চলতে। তাই বইমেলা হোক সাহিত্য চর্চার কেন্দ্র ও তীর্থভূমি।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক