top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

‘দ্য টার্মিনাল’ ছবির নায়ক হতে চাই না

‘দ্য টার্মিনাল’ ছবির নায়ক হতে চাই না
আফরোজা পারভীন| ফাইল ছবি

চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক এসেছি কয়েক দিন। ডাক্তারের কাছে দৌড়াচ্ছি আর প্রতিদিনই ভাবছি, দেশের অবস্থা কেমন আছে। এর আগে দেশ নিয়ে এতটা ভাবিনি। ভাবিনি কারণ এত গুজব কখনো শুনিনি। গুজবগুলো এমনভাবে পরিবেশন করা হচ্ছে যে, সত্য না ভেবে উপায় নেই। একজন পরিবেশন করছেন, দশজন সেগুলো শেয়ার দিচ্ছেন, শতজন তা সমর্থন করছেন, হাজারজন লাইক কমেন্ট করছেন। মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সবকটি প্লাটফর্ম ছেয়ে যাচ্ছে গুজবে। তখন গুজবটাকেই সবচেয়ে বড় সত্য মনে হচ্ছে।

দেশ থেকে আসার আগেই শুরু হয়েছিল এসব। মহামান্য রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করছেন, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আমেরিকা থেকে ফিরলেই তিনি পদত্যাগ করবেন, তাঁর চিকিৎসা দরকার। তিনি চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যাবেন। প্রধান উপদেষ্টা হবেন রাষ্ট্রপতি এসব শুনতে শুনতেই প্রধান উপদেষ্টা ফিরে এলেন।

এখন চলছে সেনাপ্রধান আর প্রধান উপদেষ্টার মতবিরোধ, ধমক দিয়ে দুজন ছাত্র উপদেষ্টাকে সেনাবাহিনীর সদস্যদের বসিয়ে দেয়া, প্রধান উপদেষ্টার সাথে সেনাপ্রধানের মতবিরোধ, যমুনা ঘেরাও, পদ যায় যায়, আমেরিকা পর্যন্ত ফোন করে সহায়তা চাওয়া এমন অনেক কথা! সাত দিন ধরে একই লেখা দেখছি ফেসবুকে, হ্যাশট্যাগে স্টেপডাউন ইউনূস।

আবার এমন খবরও দেখলাম, এসব কিছুই হয়নি। যমুনা ঘেরাও হয়নি। সবই নাকি ঠিকঠাক। কোনটা বিশ্বাস করব! আর একদিকে রিসেটবাটন নিয়ে দেশ তোলপাড়। একজন তাপসী তাবাসসুম উর্মি স্টার হয়ে গেলেন প্রধান উপদেষ্টা সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে। তিনি যেটা করেছেন তা কন্ডাক্ট রুলের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাকে নিয়েও অনেক গুজব। তিনি নাকি প্রশ্নপত্র কিনে বিসিএস হয়েছেন। চুক্তির শর্তমতো আবেদ চাচার টাকা এখনও শোধ করেননি।

বাংলাদেশে কথা বলতে ট্যাক্স লাগে না। আমি মনে করি, বেঁফাস কথার উপর ট্যাক্স বসানো উচিত। উর্মি প্রধান উপদেষ্টা সম্পর্কে মানহানিকর মন্তব্য করেছে অবশ্যই, তাই বলে সে প্রশ্ন কিনেছে এটার প্রমাণ কী? যতদূর জেনেছি, সে ভালো ছাত্রী। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশুনা করেছে। হয়তো সে কারো প্ররোচনায় এ কাজ করেছে অথবা ভাইরাল হবার লোভে করেছে। যদি এর কোনটাই না করে থাকে, তাহলে বলব সে অপরিপক্ক।

উর্মিকে নিয়ে আরও অনেক কথা হচ্ছে। সে বিদেশে কেরিয়ার গড়তে চায়, বিদেশে যাবার জন্য এনওসি নিয়েছে। যদি এনওসি নিয়ে থাকে বা বিদেশে ক্যারিয়ার গড়তে চায় তাতে তার দোষ কী? ক্যারিয়ারের উন্নতি তো সবাই করতে চায়। কাদায় পড়লে কী শুধু লাথিই মারতে হবে। উর্মির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, প্রথমে ওএসডি তারপর বরখাস্ত করা হয়েছে। বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। তাকে গ্রেফতারের দাবিও উঠেছে। সে নাকি গা ঢাকা দিয়েছে। বলা হচ্ছে সে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে গেছে। এ কথার সূত্র কী, প্রমাণ কী জানি না। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে।

উর্মির মা একজন কলেজ শিক্ষক। তিনি বলেছেন চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে উর্মি ভুল করেছে। তার মাকে ভারতে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছেন, এ প্রশ্ন তাকে কেন। দেশে অনেক গোয়েন্দা সংস্থা আছে। একথা তো আগে তাদের জানার কথা। কথা সত্য। তার মা বলেছেন, উর্মি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। জুলাই আন্দোলনকালে উর্মি সরকারপক্ষে এবং আন্দোলনের বিপক্ষে অনেক পোস্ট দিয়েছে বলে জানা যায়। একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আমিও বলছি, উর্মি ভুল করেছে। কিন্তু এসব গুজব ছড়ানোও তো ভুল।

দুদিন ধরে শুনছি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ভারত ট্রাভেল ডকুমেন্টস দিয়েছে। সেগুলো নিয়ে তিনি জনমত গড়তে সুইজারল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশে ভ্রমণ করবেন অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে। এর আগেও শুনেছিলাম তিনি আজমান গেছেন, বেলারুশ গেছেন, দুবাই গেছেন এমন অনেক কথা। দুবাইতে গিয়ে ল্যান্ড করতে পারেননি এমনটাও শুনেছি। কোনটা সত্যি কোনটা গুজব জানি না। এমনও শুনেছিলাম তিনি বেশ আছেন, শপিং করছেন, লোদি পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মাঝে তার টেলিফোন কল ছড়িয়ে পড়েছিল। আবার এমনও শুনেছি তার কাছে টেলিফোনও নেই। কোনটা সত্যি বোঝার উপায় নেই।

দুর্গাপূজা উপলক্ষে শুরু হয়েছে নানান কাহিনি। অজস্র ফেক ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিকমাধ্যমে। মুসল্লিরা নাকি পূজামণ্ডপে গিয়ে ইসলামি গান গাইছেন। তাদের দৌরাত্ম্যে পুজারিরা নাকি পূজা করতে পারছে না। শেষাবধি জানা গেল, কবর জিয়ারতের ছবি এডিট করে বসিয়ে দিয়েছে পুজামণ্ডপের ছবির ওপর।

সরকারি চাকরিতে ঢোকা আর অবসরের বয়স বাড়ানো নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে একদল ছাত্র-ছাত্রী। যে দেশে চাকরির সুযোগই সীমিত, ক্ষেত্র কম, সে দেশে চাকরিতে ঢোকা এবং অবসরের বয়স বাড়ালে নতুন ছেলে-মেয়েরা চাকরি পাবে না। আমি নিশ্চিত বিদেশে পাড়ি দেয়ার হার আরও বাড়বে। কিন্তু এসব কথা বলার সাহস করবে কে? এদিকে শুরু হয়েছে ডাকাতি। আইনশৃঙখলা বাহিনীর পোশাক পরে ডাকাতি হচ্ছে। এক সাথে এত কিছু হলে সামলানো মুশকিল। স্পষ্ট বোঝা যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য এসব করা হচ্ছে। একের পর এক ওএসডি বদলি করেও প্রশাসনে গতি আনা যায়নি। সমস্যা লেগেই আছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সেন্ট মার্টিন নিয়েও চলছে নানান গুজব। আমি মনে করি, মাঝে মাঝে সরকারের লোকদের দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ব্রিফিং করা উচিত, আসল সত্য তুলে ধরা দরকার। এদিকে সমন্বয়কদের নিয়েও চলছে গুজবের পর গুজব। উপদেষ্টারা পালিয়ে গেছেন দিয়ে গুজব শুরু হয়। এরপর আসিফ মাহমুদ মজার ছলে ফেসবুকে লেখেন, ‘শুধু চেয়ারই না, প্রধান উপদেষ্টাসহ দেশ ছাড়লেন বাকি উপদেষ্টারাও। সোর্স: চালাইদেন’। তারপর নাটকীয় পোস্ট দেন হাসনাত আবদুল্লাহ, ‘শুনলাম আজ রাতে আসিফ মাহমুদের গায়েহলুদ, সারজিস আলমের বিয়ে আর নাহিদ ইসলামের মেজ ছেলের সুন্নতে খতনা’।

এমন খবরও আমরা দেখেছি যে, হাসনাত আর সার্জিস নাকি বিয়ে করেছে। এটা নাকি এ দেশের প্রথম সমকামী বিয়ে। শেষাবধি জানা গেল, সার্জিস আলম আর আসিফের বিয়ের হুজুগ তুললেও বিয়ে করেছেন হাসনাত। এ বিয়ে উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন সার্জিস, ‘আল্লাহ পৃথিবীতে আমাদের জন্য যা দিয়েছেন তার সবই নেয়ামত। এর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম নেয়ামত হচ্ছে একজন নেককার স্ত্রী। আজ থেকে তুমি তেমনই একজন স্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছ। দাম্পত্য জীবন সুখের হোক। আল্লাহ তোমাদের জীবনকে বরকতময় করে তুলুন’। তবে হাসনাতের বউ সারজিস দেখেননি। হাসনাত আবদুল্লাহও নিজের বিয়ে সম্পর্কে কোনো বক্তব্য দেননি। কাজেই এ বিয়েটাও যে কতটা সত্যি কে জানে।

এটাও জানলাম, বিয়ে করতে গিয়ে দ্রব্যমূল্য দেখে হাসনাত হতাশ। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বিষয়ে একটা পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে দ্রব্যমূল্য নিয়ে লিখেছেন। তার এই লেখা নিয়েও লেখালিখি হচ্ছে। তিনি লিখেছেন ‘দ্রব্যমূল্যের দাম’। মূল্য আর দাম একই কথা। তাই তাকে নিয়ে এই লেখালিখি। কারণ তারা নিজেদের মেধাবী বলেন। বোঝাই যায় তাকে কটাক্ষ করে এ লেখা হচ্ছে। দেশে কতরকম কত সমস্যা। সে সব বাদ দিয়ে আর মানুষ লিখছে এসব! হাসনাত লিখেছেন, ‘বাজার সংস্কার করা দরকার। গুজব যাই হোক আর যতটাই হোক, সত্য এটাই যে জিনিসপত্র ধরলে হাতে ছ্যাকা লাগে। কোনো জিনিসই গরিব আর মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে নেই।’

মৎস্য উপদেষ্টা বলেছেন, ডিমের দাম বেড়েছে চাঁদাবাজির জন্য। এটা তো আমাদের জানা কেচ্ছা। চাঁদাবাজি হবে না, সিন্ডিকেট থাকবে না এই আশাতেই এত এত ছাত্র -জনতা জীবন দিলেন। এখনো কেন আমরা একই কথা শুনব, অর কতদিন শুনব? জনগণের তো নাভিশ্বাস।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি চরমে। মানুষ ভয়ে আছে। ভয়ে আছে যেমন আমলারা তেমনি সবশ্রেণির মানুষ। কোন মন্তব্য করলে বা মত প্রকাশ করলে যে সাজা হবে না এখন আর মানুষ এটা বিশ্বাস করতে পারছে না। মন খুলে কথা বলতে পারছে না কেউ। উর্মি সরকারি কর্মকর্তা, তিনি সব কথা বলতে পারেন না, তিনি কন্ডাক্ট রুলে বাধা কিন্তু দেশের আপামর জনসাধারণ তো তা নয়। তাদের অধিকার আছে সত্য কথা শোভন ভাবে বলার। কিন্তু বলতে ভয় পাচ্ছে।

আর গুজবের ভারে প্রতিদিনই মনে হচ্ছে দেশ ফিরতে পারব তো। আমার দেশটা থাকবে তো। নাকি ‘দ্য টার্মিনাল’ ছবির সেই নায়কের মতো আমার জীবন কাটবে এয়ারপোর্টের টার্মিনালে কে জানে!

লেখক: কথাশিল্পী, গবেষক

r1 ad
r1 ad