top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

এই রাষ্ট্রের কজন জানি শহীদ সলিম উল্লাহর কথা?

এই রাষ্ট্রের কজন জানি শহীদ সলিম উল্লাহর কথা?
শহীদ সলিম উল্লাহ (বাঁদিকে), তাঁর দুই পুত্র শিল্পী সাদি ও শিবলী। ছবি : মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার সব সড়ক রাজা-বাদশাদের নামে। কিন্তু ‌‘শহীদ সলিমউল্লাহ সড়কটি’ শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সলিম উল্লাহর নামে? আমরা কজন জানি এই শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদের বাবা? কয়জন জানি আপনাদের বাড়িতে আগুন দিয়ে আপনার চোখের সামনে আপনার বাবাকে হত্যা করা হয়েছিল?

কয়জন জানি আপনার মা জীবন বাঁচাতে পাশের বাড়িতে লাফ দিয়েছিল সন্তানদের নিয়ে? কয়জন জানি ভাঙা পা নিয়ে তাঁর সংগ্রামের কথা যে সংগ্রাম চলেছে দেশ স্বাধীনের পরেও? কয়জন জানি আপনাদের সব ভাই এই দেশের সেবা করেছেন নানাভাবে?

সাদি ভাই আপনার এমন মৃত্যু ভীষণ বেদনার! আপনার হঠাৎ এমন মৃত্যু ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। আফসোস আপনাদের সংগ্রাম আর ত্যাগের কথা দেশের বেশিরভাগ মানুষ জানে না। জানে না তরুণ প্রজন্ম। এই রাষ্ট্র বা আমরা সেগুলো জানাতে পারিনি। আপনাদের যোগ্য সম্মান দিতে পারিনি! চলুন এই শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার সেই ইতিহাস জানাতে চলুন আপনাদের নিয়ে যাই একাত্তরে।

মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের সি-১২/১০ বাড়িটি ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার। মোহাম্মদপুরে সামাজিক নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা এবং মোহাম্মদপুর এলাকার সমন্বয় কমিটির প্রধান সলিম উল্লাহর বাড়ি এটি। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথেও এই বাড়ির সখ্য ছিল। শেখ কামাল আসতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সন্ধ্যায়ও এই বাড়িতে এসেছিলেন তৎকালীল ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নুরে আলম জিকু, শেখ কামালসহ অনেকে। সেদিন রাত ১২টার পর পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। টার্গেটে করা হয় এই বাড়িও। চলে গণহত্যা।

সাদি মহম্মদ বেঁচে থাকতে বিভিন্ন সময়ে এই স্মৃতিচারণ করেছেন। দিনটা ছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। সেদিন ছিল শুক্রবার। বাড়ির সামনেই মসজিদ, জুমার নামাজ থেকে কেবল ঘরে ফিরেছেন সলিম উল্লাহ।

সামি মহম্মদ বলেন, ‘মোহাম্মদপুরে সামাজিক নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আমার বাবা। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে ছিল সখ্য। ৭ই মার্চে বাবার সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম রেসকোর্স ময়দানে। আমি তখন রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে পড়ি। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। ২২ মার্চ রাতে আমাদের বাড়ির ছাদে বড় একটা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলাম। ২৩ মার্চ সকাল থেকেই দেখলাম, একটা হেলিকপ্টার আমাদের বাড়ির ওপরে কয়েকবার ঘুরছিল। তখন শানু ভাই বলছিল, ‘বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর জন্য আমাদেরকে ফলো করছে’।

‘২৫ মার্চ সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। এজন্য আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শেখ কামালসহ আরও অনেকে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন মাখন ভাইকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সলিম উল্লাহ সাহেবের বাড়িতে মোহাম্মদপুরের অবাঙালিদের নিয়ে এই বৈঠকটি করার জন্য, এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা তাদেরকে বোঝাতে। সেই বৈঠকে আমাদের বাড়ির আশেপাশের অবাঙালিদের আসতে বলা হলেও তারা কেউই আসেনি। বরং তারা সেই বৈঠকের খবর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে জানিয়েছিল।’

‘২৬ মার্চ জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছিলেন সলিম উল্লাহ। সেখানে গিয়ে টের পান পরিস্থিতি ভালো নয়। গুজব ছড়ানো হয় তাঁর বাড়ি থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে। তিনি নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে দ্রুত বাড়ি ফেরেন। এর কিছুক্ষণ পরই এই বাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়া শুরু হয়। বিকেলের দিকে একটা বোমা মারা হয় বাড়ির ছাদে। তারপর একে একে কয়েকটা বোমা। এরপর আগুন লাগানো হয়।’

সাদি মহম্মদ সেই স্মৃতিচারণে বলেছেন, ‘আমাদের বাড়িটা ছিল তখন মোহাম্মদপুরের একমাত্র চারতলা বাড়ি। ওপর থেকে আমরা সবই দেখতে পাচ্ছিলাম। বোমা মারার পর বাড়ির নিচতলায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। আমি আর আব্বা একটা রুমের জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিলাম। এমন সময় এয়ারফোর্সের এক অফিসার এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আব্বাকে পেছন থেকে ছোরা বসিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি তখন আব্বাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বাইরে এলাম। তখন দেখলাম একসঙ্গে অনেকগুলো অবাঙালি দৌড়ে আসছে। আব্বা আমাকে বললেন- ‘তুই পালা, আমাকে মেরে ফেলুক’।

সাদি মহম্মদ বলেছিলেন, ‘আমি যাব না। কিন্তু আব্বা তখন একটা ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিলেন।’ সাদি মহম্মদ বলেন, ‘আমি দৌড়ে একটা বাঙালি বাড়িতে গিয়ে ঢুকতে চাইলাম, তারা ভয়ে ঢুকতে দিতে চাইছিল না। পরে আমি ধাক্কা দিয়েই ভেতরে গিয়ে কলের কাছে বসে থাকলাম। পানি দিয়ে রক্তটা ধুয়ে নিলাম। পরে জেনেছিলাম, রাত ৯টা পর্যন্ত আব্বা বেঁচেছিলেন। সেদিন আমার চাচা সুরুজ, খালাতো ভাই চিনুকেও মেরে ফেলা হয়েছিল। চিনুকে ওরা বেঁধে পুরো মোহাম্মদপুরে টেনে-হেঁচড়ে ঘুরিয়ে এনে আমাদের বাড়ির সামনের মাঠে জবাই করেছিল। তাদের মরদেহ মোহাম্মদপুর কবরস্থানের পাশে কুয়ার মতো একটা জায়গায় পুঁতে ফেলা হয়।’

মোহাম্মদ সলিম উল্লাহসহ ও তাঁর পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্যসহ সেদিন অন্তত ২৫ জনকে হত্যা করা হয়। তাদেরকে কবরও দেওয়া হয়নি। একটা কুয়ার মতো জায়গায় পুঁতে ফেলা হয়েছিল। কথাগুলো পড়তে পড়তে ভাবছিলাম চোখের সামনে নিজের বাবাকে হত্যা করতে দেখা কতোটা কষ্টের।

জেনে অবাক হবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা আর রাজারবাগ ছাড়া যেখানে হামলা হয়েছিল সেটি সলিম উল্লাহর বাড়ি। প্রথম কোনো নাগরিকের বাড়ি। অথচ এই পরিবারটিকে আমরা যথাযথ মর্যাদা দিতে পারলাম না।

না বর্বরতা এখানেই শেষ নয়। যুদ্ধতো মাত্র শুরু হলো। ২৬ মার্চে বাড়িতে আক্রমণের পর সন্তানদের নিয়ে দোতলা থেকে লাফ দিতে গিয়ে দুটো পা ভেঙে গিয়েছিল শহীদ সলিম উল্লাহর স্ত্রী জেবুন্নেছার। এরপর সেই ভাঙা পা নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস সন্তানদের নিয়ে লড়াই করেছেন তাঁর মা।

১৯৭৩ সালে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন সাদি মহম্মদ। তবে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মন বসাতে পারেননি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালীন ১৯৭৫ সালে স্কলারশিপ নিয়ে শান্তিনিকেতনে সংগীত নিয়ে পড়তে যান। বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রসংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। সেই থেকে শুরু পথচলা। এই দেশের বরেণ্য একজন শিল্পী ও শিক্ষক তিনি। ভেতরে ভেতরে যে কষ্ট তারা পুষে রেখেছেন, যে পরিস্থিতি তারা পাড়ি দিয়েছেন বিষণ্নতা স্বাভাবিক। আফসোস এই দেশ তাদের যথাযথ সম্মান দিতে পারেনি।

আফসোসের আরেকটা ঘটনা বলি। পাকিস্তান আমলে বর্তমান শহীদ সলিমউল্লাহ রোডের নাম ছিল ‘কায়েদে আজম’ রোড। ১৯৭২ সালে ওই নাম পরিবর্তন করে শহীদ সলিমউল্লাহ নামকরণ করা হয়। তবে মোহাম্মদপুরে বেশিরভাগ সড়কের নামই রাজা-বাদশার নামে। তাই শহীদ সলিমউল্লাহ সড়ককে ভুল ভেবে ঢাকার নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর নাম ভেবে থাকেন অনেকে। আমরা পারিনি শহীদ সলিম উল্লাহ সম্পর্কে দুটো লাইন লিখতে।

সাদি মহম্মদের মুখেই শুনুন। তিনি বলছিলেন, ‘এই সড়কের মুখে একটা নামফলক ছিল, সেখানেও লেখা ছিল ‘স্যার সলিমুল্লাহ সড়ক’। এ নিয়ে আমি আর আমার ভাই শিবলী মহম্মদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেও বলেছি, এটা স্যার সলিমুল্লাহ সড়ক নয়, এটা আমার বাবা শহীদ সলিম উল্লাহ সড়ক। কিন্তু তখন তিনি তেমন পাত্তা দেননি। এরপর আমরা দুজনই টেলিভিশন-মিডিয়াতে এটা নিয়ে যখন বলা শুরু করেছি, তখন সেটি পরিবর্তন করে ‘শহীদ সলিমউল্লাহ সড়ক’ করা হয়েছে।’

সাদি মহম্মদ বলেন, ‘আমরা ১০ ভাই-বোন ছিলাম। বাবাকে ও ভাইকে যখন মেরে ফেলা হলো, পরিবারের বাকি সদস্যদের নিয়ে মা বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারের একটি গ্রামে চলে গেলেন। সেখান থেকে চাঁদপুরে। তখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর যখন ঢাকায় ফিরে এলেন তখন মাকে আরেক যুদ্ধ করতে হয়েছে আমাদের বড় করার জন্য। আমি তখন গানের টিউশন করেছি। আমার ভাই শিবলী নাচের টিউশন করেছে। মা তখন সেলাইয়ের কাজ করেছেন। আমার মা বাকি জীবন সেই ভয়াল স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচেছেন।’

মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের মতো স্বাধীন বাংলাদেশে ৫২ বছরে শহীদজায়াদের যে সংগ্রামী জীবন, সেটা আরেক যুদ্ধ। গত বছরের ৮ জুলাই সাদি মহম্মদের মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ (৯৬) বার্ধক্যজনিত রোগে মারা যান। মা মারা যাওয়ার পর থেকে বিষণ্নতায় ভুগছিলেন শিল্পী সাদি মহম্মদ। না কোনো পুরস্কার বা পদক নয় সবমিলিয়ে বিষণ্নতা কাটাতে পারেননি তিনি। নানা ধরনের বিষণ্নতা থেকেই হয়তো এই আত্মহত্যা! এভাবে চলে যাওয়া!

জানি না কথাগুলো আপনাদের পড়তে কেমন লেগেছে। কিন্তু লিখতে লিখতে আমার চোখ ভিজে গেছে। আমি আজকে ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম। সাদি ভাইয়ের ছোট ভাই শোয়েব ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলো। এই পরিবারের সদস্যরা আজীবন এই দেশের জন্য করেছেন।

একাত্তরে তাদের যে চারতলা বাড়ি, এখনো বাড়িটি সেভাবেই আছে। অথচ চারপাশে বহু অট্টালিকা। আফসোস আমরা সাদি ভাইদের যোগ্য সম্মান দিতে পারিনি। তাদের সংগ্রামের গল্পগুলো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ছড়িয়ে দিতে পারিনি সারাদেশে। পারিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক বাংলাদেশ গড়তে।

ভীষণ আফসোস লাগে! আমি সব সময় বলি এই রাষ্ট্রের প্রত্যেকটা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পাশে দাঁড়ানো উচিত। বেঁচে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধারা বা তাদের সন্তানরা যেমন সুযোগ-সুবিধা পায় তার চেয়ে বেশি সুযোগসুবিধা প্রয়োজন ছিল শহীদ পরিবারগুলোর।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারগুলোর সংগ্রামের কথা লিখিত থাকা উচিত। এগুলো নিয়ে সিনেমা হওয়া উচিত। পুরো জাতিকে জানানো উচিত। আর সবচেয়ে জরুরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়া। আফসোস সেগুলো হচ্ছে না। আফসোস নিয়েই তাই শ্রদ্ধা জানাই শহীদ সলিম উল্লাহকে। শ্রদ্ধা তাঁর স্ত্রী জেবুন্নেছার সংগ্রামকে।‌ শ্রদ্ধা সাদি মহম্মদসহ এই পরিবারের সবাইকে।‌ আপনাদের স্যালুট। [লেখকের ফেসবুক থেকে]

শরিফুল হাসান : কলামিস্ট, অভিবাসনবিশেষজ্ঞ।

r1 ad
r1 ad