আন্দোলনের নেতৃত্বে বুশরা বিবি
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবি। আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়ে উঠেছেন তিনি।
অনেকেই বুশরা বিবি নামটি গুগলে অনুসন্ধান করছেন। জানতে চাইছেন ৪০-এর কোঠায় থাকা ‘রহস্যময়’ এই নারী সম্পর্কে।
দুর্নীতির দায়ে ইমরান কারাগারে বন্দী। বুশরাও কারাগারে ছিলেন। গত মাসে মুক্তি পান। এর পরপরই রাজধানী ইসলামাবাদে শুরু হয় তুমুল আন্দোলন।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ডাকা ‘চূড়ান্ত বিক্ষোভ’ কর্মসূচি ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় ইমরান ও তাঁ স্ত্রীসহ দলটির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে আটটি মামলা হয়েছে। ইসলামাবাদ পুলিশের পক্ষে গত বুধবার এ মামলা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ দেশকে আন্দোলনের রাজনীতি থেকে মুক্ত করতে এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানানোর কয়েক ঘণ্টা পরই পুলিশ মামলার পদক্ষেপ নেয়।
তিনদিনের আন্দোলনে সেখানে সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। যদিও পিটিআই বলেছে, গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যা প্রায় চার হাজার।
ইসলামাবাদের আন্দোলনটা ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে। এই আন্দোলনে যোগ দিতে গত সোমবার রাতে ইসলামাবাদের ডি-চক এলাকায় পৌঁছান ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পিটিআই-এর প্রায় ১০ হাজার কর্মী-সমর্থক। এ সময় দুই পক্ষের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন বুশরাও। তিনি জনসমক্ষে এসেছেন, এর আগে এমন ঘটনা বিরল।
এ বিষয়ে লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসমা ফাইজ বলেন, “মনে করা হতো বুশরা একজন অরাজনৈতিক মানুষ। সে জন্য (বিরোধীরা) তাঁকে হুমকি বলে মনে করতেন না। তবে গত কয়েক দিনে আমরা বুশরার ভিন্ন রূপ দেখতে পেয়েছি।”
ইসলামাবাদে আন্দোলনের আগে পিটিআই–সমর্থকদের সঙ্গে প্রথমবারের মতো দেখা করেছিলেন বুশরা বিবি। ইমরান খানকে রক্ষার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপর ইসলামাবাদে যখন আন্দোলনকারী ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল, তখন হঠাৎই একটি ট্রাকের ওপর দেখা যায় তাঁকে।
পিটিআই সদস্যদের উদ্দেশে চিৎকার করে বুশরা বিবি বলেন, ‘আজ আপনাদের একটি প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। সেটি হলো ইমরান খান এখানে না আসা পর্যন্ত আপনারা চলে যাবেন না।’
ইসলামাবাদে আন্দোলন ঘিরে সংঘাতের জন্য বুশরার এ বক্তব্যকে দুষছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নাকভি। তিনি বলেছেন, ‘এর জন্য শুধু বুশরা বিবিই দায়ী।’
রাজনৈতিক যাত্রাপথে আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনার জন্য বুশরা বিবির কাছে গিয়েছিলেন ইমরান খান। সে সূত্রে তাঁরা ঘনিষ্ঠ হন। এরপর ২০১৮ সালে বিয়ে করেন। পাকিস্তানের রাজনীতিকে পরিবারতন্ত্র থেকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে বছরই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন ইমরান।
২০২২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান। এরপর চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনের কয়েক দিন আগে তাঁর তৃতীয় স্ত্রী বুশরা বিবিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ইসলামি আইন ভঙ্গ করে ইমরান খানকে বিয়ের অভিযোগ আনে পাকিস্তান সরকার।
বুশরার আগে ইমরানের জীবনে ছিলেন দুজন স্ত্রী। প্রথমজন ব্রিটিশ সমাজকর্মী জেমিমা গোল্ডস্মিথ। এরপর পাকিস্তানি সাংবাদিক রেহাম খান। দুজনই গ্ল্যামারাস। বিভিন্ন সময় সাময়িকীর প্রচ্ছদে ও টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেছে জেমিমা আর রেহামকে। এর ঠিক উল্টো বুশরা।
বুশরা সুফি সাধনার সঙ্গে যুক্ত। ইমরান জানিয়েছেন, সুফিবাদে আত্ম-অনুসন্ধানের প্রতি তার তিন দশকের বেশি সময় ধরে আগ্রহ রয়েছে।
বুশরা বিবি সাধারণত নিজেকে ঢিলেঢালা কালো বা সাদা আবায়ায় (বোরখা ধরনের) আবৃত করে এবং মুখ ঢেকে প্রকাশ্যে আসেন। তিনি ফারিদউদ্দিন মাসুদ গঞ্জশাকরের (পীরবাবা ফারিদ) একনিষ্ঠ অনুসারী। যার মাজার তার প্রথম স্বামীর শহর পাকপত্তনে অবস্থিত।
ইমরান খানের সঙ্গে বুশরা বিবির পরিচয়ের সময় বা পরিস্থিতি তেমনভাবে স্পষ্ট নয়। তবে সাবেক সহযোগী আউন চৌধুরীর মতে, ইমরান খান তার (বুশরা বিবি) আধ্যাত্মিকতায় মুগ্ধ ছিলেন।
২০১৮ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গর্ব করে ইমরান বলেছিলেন, বিয়ের আগে তিনি বুশরার মুখও দেখেননি। ইমরানের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বুশরার সাবেক স্বামী খাওয়ার মানেকা।
পাকিস্তানে অনেক নারীই হঠাৎ রাজনীতিতে পা রেখেছেন। যেমন বলা চলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর কথা। বাবার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের সময় থেকে তিনি রাজনীতি শুরু করেন।
এই ধারায় রয়েছেন মারিয়াম নওয়াজ শরিফও। তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের ভাতিজি। বাবা নওয়াজ শরিফ কারাবন্দী হওয়ার পর তিনি রাজনীতিতে নাম লেখান।
এই দুজনের সঙ্গে বুশরা বিবিকে মিলিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পাকিস্তানের এক বাসিন্দা লিখেছেন, ‘যখন দাবার সৈনিকেরা পরাজিত হয়, তখন রাজাকে রক্ষা করতে রানি এগিয়ে আসেন।’
এখন দেখার বিষয়, রাজনীতিতে ভুট্টো ও শরিফ পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলা ইমরান খানও বুশরার ঘাড়ে ভর দিয়ে একই পথে হাঁটেন কি না।
ওয়াশিংটনভিত্তিক নীতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান এএফপিকে বলেন, ইমরান খানের সঙ্গে বুশরার সম্পর্কের কারণেই বিক্ষোভকারীদের কাছে তিনি ইতিমধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছেন।