নির্বাচনী বছরে রাজনৈতিক চাপ, হুমকিতে সাংবাদিকতা
চলতি বছর বিশ্বের প্রায় অর্ধেক দেশেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে নির্বাচন। ২০২৪ সালকে তাই বলা হচ্ছেগুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী বছর।
যদিও গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) উদ্বেগের সঙ্গে জানাচ্ছে যে, সাংবাদিকতা এবং জনসাধারণের জানার অধিকার এখন হুমকিরমুখে। রাজনৈতিক চাপ এর জন্য দায়ী।
বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, তার ওপর ভিত্তি করেআরএসএফ সূচক প্রকাশ করে । অর্থনীতি, আইনি সুরক্ষা, সামাজিক ও নিরাপত্তার পাশাপাশিঅন্য যে বিষয়টির ওপর ভিত্তি করে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক তৈরি করা হয়, তা হলোরাজনীতি।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক ২০২৪ বলছে, বিশ্ব জুড়েই রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি লক্ষ্যনীয়, যা গড়ে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। আরএসএফ এর সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে মাত্র একচতুর্থাংশে সাংবাদিকতা চর্চার পরিবেশ সন্তোষজনক।
আরএসএফের সম্পাদকীয় পরিচালক অ্যান বুকোদি বলেন, “সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষায়রাষ্ট্র এবং অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ভূমিকা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। সত্তা ক্ষয়িষ্ণুভূমিকা পালন করছে।”
তিনি আরো বলেন, “গণমাধ্যমকে ক্ষমতাহীন করে ফেলা সাংবাদিকদের প্রতি বৈরী আচরণেরমাধ্যমে তাদের ভূমিকাকে গৌণ করে ফেলার সমার্থক। ক্ষমতাহীন করে ফেললে, গণমাধ্যমহয়রানি বা বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার হাতিয়ারে পরিণত হয় । অথচ যে কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাএবং রাজনীতিতে স্বাধীনতা চর্চার জন্য প্রকৃত সাংবাদিকতার বিকল্প নেই।”
সংবাদমাধ্যম কতটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তা বুঝতে গাজার চেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ আর হতেপারে না। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের ক্রমাগত বোমাবর্ষণ এবংইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গাজা দখলের ফলে গত ছয় মাসে প্রায় ১০০ জন গণমাধ্যম কর্মীনিহত হয়েছেন, যাঁদের প্রায় সবাই ফিলিস্তিনি।
মনোযোগের কেন্দ্রে নির্বাচন
খুব সম্ভবত, বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নির্বাচনী বছর হলো এই ২০২৪। তবে আরএসএফেরসূচকে যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয় তা হলো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনীতিকেরা ক্রমশকর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করার সবরকম উদ্যোগনিয়েছেন।
এই প্রেক্ষাপটে আর্জেন্টিনার নতুন রাষ্ট্রপতি হ্যাভিয়ার মিলেই এর কথা বলা যায়। প্রথমেই তিনিদেশটির বৃহত্তম সংবাদ সংস্থা বন্ধ করে দিয়েছেন। এরপর মিলেই প্রশাসন সাংবাদিকদের প্রকাশ্যবিরোধিতা শুরু করে। ফলে গত বছরের তুলনায় দেশটি স্বাধীন গণমাধ্যমসূচকে ২৬ ধাপ (৪০তম থেকে ৬৬ তম) নিচে নেমেছে।
বছরের শেষ দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যে নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণবলে বিবেচিত হচ্ছে। বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রও র্যাঙ্কিং এ ১০ ধাপ নেমে ৫৫তমস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
কেননা স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের পথে যে কাঠামোগত বাধা, যুক্তরাষ্ট্রে এখনও সেই বাধাগুলো রয়েগেছে।
তবে দেশটির আইনসভা থেকে ফেডারেল মিডিয়া শিল্ড আইন পাস করার একটা সম্ভাবনারয়েছে। এই আইন সংবাদমাধ্যমের জন্য ইতিবাচক হবে।
সূচকে মেক্সিকোর অবস্থান ১২১ তম। এই দেশটিতে জুনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে অনিরাপদ হয়ে ওঠা দেশগুলোর একটি হলো এই মেক্সিকো।
সম্প্রতি আফ্রিকার নাইজেরিয়া এবং ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে নির্বাচন হয়ে গেল।সূচকে দেশ দুটির অবস্থান যথাক্রমে ১১২তম এবং ১২৩ তম। সেখানেও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেসহিংসতার বৃদ্ধি লক্ষণীয়।
এদিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের পুনঃনির্বাচিত হওয়া দেশটিরসংবাদপত্রের জন্য অন্ধকার সময়কে আরো দীর্ঘায়িত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ বছরতুরস্কের অবস্থান ১৫৮তম।
ইতালিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম সংবাদ সংস্থার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়ামেলোনির সংসদীয় জোট। পদক্ষেপটি দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাব বলয়েআনার চলমান প্রবণতার একটি অংশ। সূচকে ইতালির অবস্থান ৪৬ তম।
২০২৪ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বিভিন্ন দেশের অবস্থান। ছবি: রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসেরসৌজন্যে
মিডিয়া সেন্সরশিপ বেড়েছে ও তালিকার তলানিতে জায়গা করে নেওয়া নতুন দেশ
এবারের সূচকে রাশিয়ায় অবস্থান ১৬২তম।দেশটিতে চূড়ান্ত মিডিয়া সেন্সরশিপচলছে।
ধারণা করা হয়, রাশিয়ার প্রভাবে গোটা অঞ্চলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বড় হুমকিতে পড়েছে।দেখা যাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় বেলারুশ, জর্জিয়া, কিরগিজস্তান এবং আজারবাইজানেরঅবস্থানের আরও অবনতি ঘটেছে। তারাও ব্যবহার করছে রাশিয়ার নিপীড়ন কৌশল বা“বিদেশী এজেন্ট” আইনের মতো হাতিয়ার।
সূচকে ইউক্রেনের অবস্থান ৬১তম। রাশিয়ার আক্রমণের মধ্যেও ২০২৩ সালের তুলনায় সূচকে১৮ ধাপ এগিয়েছে দেশটি। যদিও শারীরিক নিরাপত্তা ঝুঁকি, মিডিয়াতে গুপ্তচরবৃত্তির পাশাপাশিইউক্রেনীয় সরকারের স্বচ্ছতার অভাবের মতো বিষয়গুলো রয়েই গেছে।
দীর্ঘদিন ধরে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাজে অবস্থানের জন্য পরিচিত চীন, ভিয়েতনাম, ইরান এবংউত্তর কোরিয়া যথাক্রমে ১৭২তম, ১৭৪তম, ১৭৬তম এবং ১৭৭তম স্থানে রয়েছে।
গত বছরের তুলনায় এবারও তাদের অবস্থানের তেমন কোনো উন্নতি ঘটেনি। কেবল তাদেরজায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে সশস্ত্র সংঘাতে আক্রান্ত তিন দেশ। মুক্ত গণমাধ্যম সূচকেরশেষ তিনে এখন আফগানিস্তান (১৭৮ তম), সিরিয়া (১৭৯ তম) এবং ইরিত্রিয়া (১৮০তম)।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দেশই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংক্রান্ত“কঠিন” বা “খুব গুরুতর” পরিস্থিতি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। একইভাবে, মাগরেব (উত্তরআফ্রিকার) ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল সূচকে সবচেয়ে উদ্বেগজনক অবস্থানে আছে।
আগে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দেশের পরিস্থিতি “কঠিন” বা “খুব গুরুতর” হিসাবে আখ্যায়িত করাহলেও উদ্বেগজনকভাবে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫ শতাংশ।
অন্ধকারে কিছু আশার আলো
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “যেসব দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ‘ভালো’ অবস্থানে রয়েছে, তারসবগুলোই ইউরোপের। বিশেষভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে যে দেশগুলোর অবস্থান তারাপ্রথম সংবাদপত্রে স্বাধীনতা আইন (ইএমএফএ) প্রবর্তন করেছে।” ২০২৩ সালেরধারাবাহিকতায় সূচকে প্রথম আটটি দেশের মধ্যে এবারও শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে নরওয়ে।
আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ এগিয়ে “সন্তোষজনক” অবস্থানে রয়েছে পর্তুগাল (৭ম)। যদিওছয় ধাপ নেমে এবার ১৩তম অবস্থানে লিথুয়ানিয়া, তারপরও ইউরোপের এ দেশগুলো সংবাদমাধ্যমে স্বাধীনতার সবচেয়ে সন্তোষজনক পরিবেশ বজায় থাকার ইঙ্গিত দেয়।
আমেরিকার মধ্যে ১৪ তম দেশ হিসেবে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে কানাডা। যেখানে ১৯তমঅবস্থান নিয়ে এশিয়া-প্যাসিফিকের শীর্ষে রয়েছে নিউজিল্যান্ড। এদিকে ৩৩ তম অবস্থান নিয়েআফ্রিকা অঞ্চলের মধ্য থেকে শীর্ষে রয়েছে মৌরিতানিয়া।
লেখাটি গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের সৌজন্যে পুনঃপ্রকাশিত। ১৬ মে ২০২৪