top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের সুপারিশ কতটা বাস্তবসম্মত?

পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের সুপারিশ কতটা বাস্তবসম্মত?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৈকত (ছদ্মনাম), ৪৩ তম বিসিএস‌-এর শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হলেও, তার স্বপ্নের চাকরিটি অধরাই থেকে গিয়েছে। কারণ, পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় আটকে আছে তার নিয়োগ।

তার বাবার কোনো এক সময়ের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এবং মামলাভুক্ত আসামি হওয়ার ঘটনায় গ্যাজেটের সময় সৈকতের নাম বাদ পড়ে যায়। পরে তিনি পুনরায় ভেরিফিকেশনের জন্য আবেদন করলে আবার দফায় দফায় নানা জিজ্ঞাসাবাদ এবং হয়রানির মুখে পড়তে হয়।

সৈকতের ভাষায়, "এনএসআই, ডিজিএফআই এলাকার মানুষজনের থেকে তথ্য নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমি বিষয়গুলো যেভাবে বর্ণনা করেছি সেই তথ্যগুলো তারা রিপোর্টে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। এখন ভেরিফিকেশন শুনলেই আমার ভয় লাগে।"

সৈকতের অভিজ্ঞতা নতুন নয়। এর আগে ২৬তম সার্জেন্ট এবং ৪০তম পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) নিয়োগও আটকে দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রার্থীদের পরিবারের রাজনৈতিক পরিচিতির কারণে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া ঝুলে আছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

অথচ, বাংলাদেশ পুলিশের নীতিমালা অনুযায়ী, ভেরিফিকেশনে প্রার্থী নিজে কোনো ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত কি না তা যাচাইয়ের কথা। প্রার্থীর বা তার পরিবারের রাজনৈতিক পরিচিতি, রাজনৈতিক ইতিহাস এখানে অপ্রাসঙ্গিক।

পুলিশ ভ্যারিফিকেশনে এমন নানা হয়রানি ও দুর্নীতির কারণে সম্প্রতি পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতি তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। তবে ভেরিফিকেশন পুরোপুরি তুলে দিলে প্রার্থী বা আবেদনকারীর দেয়া তথ্যের স্বচ্ছতা ও সার্বিক নিরাপত্তা প্রশ্নবিত্ত হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

পুলিশ ভেরিফিকেশনে কোন কোন তথ্য যাচাই হয়

সাধারণত চাকরি, পাসপোর্ট, লাইসেন্স, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই) ব্যবহার বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আবেদনকারীর দেয়া তথ্য সঠিক আছে কি না তা যাচাই করার পাশাপাশি প্রার্থীর চারিত্রিক ও সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে তথ্য যাচাই করতে পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয়।

স্থানীয় থানার পুলিশ গোপনে বা প্রকাশ্যে প্রার্থীর উল্লিখিত ঠিকানায় সরজমিন তদন্ত করে থাকেন। পুলিশের তথ্য অনুসারে, ভেরিফিকেশনের সময় ২১টি বিষয় যাচাই করা হয়।

এরমধ্যে রয়েছে প্রার্থী ও তার বাবার পুরো নাম, জাতীয়তা, স্থায়ী ও অস্থায়ী ঠিকানা, বৈবাহিক অবস্থা, জন্ম তারিখ/জন্মস্থান, যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলেন, পূর্বের চাকরি।

সেইসাথে প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধার ছেলে/মেয়ে/নাতি/নাতনি কি না, অন্য কোনো কোটাধারী কি না, কোনো ধরনের প্রতিবন্ধীতা আছে কি না? নিকট আত্মীয়-স্বজন বাংলাদেশ সরকারের কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে চাকুরিরত থাকলে সেগুলোর তথ্য।

প্রার্থী কোনো মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বা নৈতিক স্খলনের রেকর্ড রয়েছে কি না, ইতোপূর্বে কোনো সরকারি চাকুরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন কি না, রাষ্ট্রদ্রোহী বা নাশকতামূলক কার্যকলাপে জড়িত আছেন/ছিলেন কি না, তিনি কোনো মামলায় অভিযুক্ত, গ্রেফতার, বা দণ্ডিত এবং নজরবন্দি কি না-এসবও দেখা হয়ে থাকে ভেরিফিকেশনে। সেইসাথে প্রার্থীর চারিত্রিক ও সামাজিক অবস্থানও যাচাই করা হয় ভেরিফিকেশনে।

পুলিশ ভেরিফিকেশনের অংশ হিসেবে স্থায়ী ঠিকানা যাচাই করতে গিয়ে অনেকের সরকারি চাকরির নিয়োগ আটকে যাওয়ার যেমন অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে তেমনি অনেকে পাসপোর্ট ভেরিফাই করতে গিয়ে নানা ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন।

ঢাকার বাসিন্দা সুমাইয়া জাহিদ পাসপোর্টের আবেদনে তার স্থায়ী ঠিকানা ছিল ঢাকার বাইরে আরেক জেলায়। পুলিশ ভেরিফিকশনে তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের কাউকে না পেয়ে এই ঠিকানার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। নানা হয়রানির পর একপর্যায়ে মোটা অংকের টাকা ঘুস দিয়ে বিষয়টি সুরাহা করেছেন মিজ জাহিদ।

অনেকেই বলছেন, পাসপোর্টের জন্য ভেরিফিকেশন করতে গেলে পুলিশকে পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা দেয়া একটা অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ কাগজে কলমে এ ধরনের টাকা দেয়ার কোনো বিধান নেই।

আবেদনকারীর তথ্যের সচ্ছতা নিশ্চিত করতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে নানা ধরনের ভোগান্তি, পক্ষপাতমূলক আচরণ ও ঘুস নেয়ার অভিযোগ এই পদ্ধতিকে কলুষিত করেছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

তবে পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতি পুরোপুরি বন্ধ করার সুপারিশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই যেমন মনে করছেন, এই প্রথা হয়রানি ও দুর্নীতি বন্ধ করবে আবার ভেরিফিকেশন সম্পূর্ণ বন্ধ করলে তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাবে না, যা নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে বলেও মত আছে।

কমিশন যা বলছে

গত ১৯শে নভেম্বর পুলিশ সংস্কার কমিশন চাকরি ও পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাই বন্ধ করার সুপারিশ করবে বলে জানিয়েছে। কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন বলেছেন, "ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি ও দুর্নীতি বন্ধ হওয়া জরুরি। প্রার্থীর বা তার পরিবারের রাজনৈতিক পরিচিতি বিচার করা অযৌক্তিক।"

সবশেষ গত ১৮ই ডিসেম্বর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতি পুরোপুরি তুলে দেওয়ার সুপারিশের কথা জানিয়েছে। কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সুপারিশ করেছি চাকরি কিংবা অন্য যেকোনো সেবার ক্ষেত্রে পুলিশের ভেরিফিকেশন আর বাধ্যতামূলক থাকছে না। এটি কোথাও আর থাকবে না।’

এই সুপারিশের কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘নাগরিক হিসেবে পাসপোর্ট পাওয়া সবার অধিকার। উন্নত দেশে যেমন পাসপোর্ট পোস্টের মাধ্যমে সরাসরি আবেদনকারীর ঠিকানায় পৌঁছে যায়। এখানেও তাই করতে হবে।’

‘ভেরিফিকেশন প্রয়োজন আছে’

তবে পুলিশ ভেরিফিকেশন পুরোপুরি তুলে দেয়ার সুপারিশ অযৌক্তিক বলে মত দিয়েছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা। তার মতে, নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য এর প্রয়োজন আছে।

তিনি বলেন, ‘আপনি যাকে প্রজাতন্ত্রের চাকরি দেবেন বা যাকে পাসপোর্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ নথি দেবেন তার ব্যাকগ্রাউন্ড জানা ভীষণ জরুরি। এক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। এটি তুলে দেয়া কোনো চিন্তাপ্রসূত সুপারিশ বলে আমি মনে করি না। কারণ কোনো অধিকার নিরঙ্কুশ না। আপনি ভালো হওয়া স্বাপেক্ষে অধিকার পাবেন।’

ভেরিফিকেশনের নামে আবেদনকারীদের সাথে যে হয়রানি হচ্ছে, দুর্নীতি হচ্ছে এবং দীর্ঘ সময় পাসপোর্ট প্রাপ্তি বা নিয়োগ ঝুলে আছে এই সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা যায় সেদিকে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

মি. হুদা বলেন, "সমস্যা হলো এখানে দুর্নীতি ঢুকে গেছে, হয়রানি হচ্ছে, প্রক্রিয়া ধীর হয়ে গিয়েছে। এটা প্রশাসন বা রাজনৈতিক পর্যায়ের গলদ, সিস্টেমের গলদ না। এখন মাথা ব্যথা থাকলে মাথা তো কেটে ফেলা তো সমাধান না।"

নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ভ্যারিফিকেশন সম্পন্ন করতে পারলে এবং দুর্নীতির ব্যাপারে জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি হলে এ ধরনের হয়রানি অনেকটাই দূর করা সম্ভব বলে জানান তিনি।

‘ভেরিফিকেশন তৈরি হয়েছে হয়রানির জন্য’

পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়রানি ও দুর্নীতির প্রতীক হয়ে ওঠায় এই পদ্ধতি বন্ধ করার সুপারিশ উপযুক্ত হয়েছে বলে মনে করেন সাবেক সচিক আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান।

তিনি বলেন, ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন উপনিবেশ আমলে তৈরি হয়েছিল মানুষকে হয়রানি করার জন্য। বাংলাদেশে ভেরিফিকেশনের নামে যেভাবে দুর্নীতি এবং বাপ দাদার রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করা হয়, তা অন্যায় অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক।’

উল্লেখ্য, পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রথা শুরু হয়েছিল ১৯২০-এর দশকে ব্রিটিশ আমলে। তখন এই প্রথার মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দমন করতে চাকরিপ্রার্থীদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাই করা।

সে সময় ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা নানা গুপ্ত বা প্রকাশ্য হামলার শিকার হতেন। তখন তারা চাকরির নিয়োগে 'পুলিশ ভেরিফিকেশন' চালু করেছিলেন যাতে নিশ্চিত হওয়া যায়, প্রার্থীর কোনও ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক বিশ্বাস নেই।

‘বিকল্প উপায়’

আবেদনকারীর দেয়া তথ্য যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। বিশেষ করে কোনো ব্যক্তির নামে ফৌজদারি মামলা আছে কি না, তার আচরণ কেমন সেটা জানা দরকার আছে বলে তারা মনে করেন।

এক্ষেত্রে তারা বিকল্প উপায় বিশেষ করে প্রযুক্তি নির্ভর যাচাই ব্যবস্থা চালু করার কথা বলেছেন যেন প্রার্থীরা হয়রানি থেকে মুক্তি পায় এবং দুর্নীতির পথও বন্ধ হয়। সাবেক সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বিকল্প উপায় হিসেবে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার বা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান থেকে চরিত্র সনদ সংগ্রহের কথা জানিয়েছেন।

এসব সনদে বলা থাকে, কমিশনার বা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ওই ব্যক্তিকে চেনেন এবং নিশ্চিত করেছেন তার চরিত্র ভালো এবং তিনি কোনো অপরাধমূলক বা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত নন।

তবে এই চরিত্র সনদ ঘুস দিয়ে বা নানা পরিচয়ের সূত্র ধরে সংগ্রহের অভিযোগ আছে। সেখানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি বলে তিনি জানান। ‘পুলিশের ডাটাবেসে যদি সব নাগরিকের অপরাধের তথ্য, মামলার তথ্য নথিভুক্ত থাকে তাহলে সহজেই তাহলে সহজেই তার বৃত্তান্ত জানা যাবে। এক্ষেত্রে হয়রানির কোনো সুযোগ থাকবে না,’ বলছিলেন মি. খান।

এছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ডাটাবেসের মাধ্যমে প্রার্থীর পরিচয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডাটাবেস থেকে শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য যাচাই করা যেতে পারে। তবে এই ডিজিটাল ডাটাবেস সফল বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় তথ্যভাণ্ডারকে আরও শক্তিশালী, নির্ভুল ও নিরাপদ করা জরুরি বলে মত দিয়েছেন সাবেক এই সচিব, যাতে নাগরিকদের তথ্যের কোনো অপব্যবহার না হয়।

পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান, অতিরিক্ত আইজি মো. গোলাম রসুলের মতে, এতো বছর ধরে যে পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছে তার মাধ্যমে দুই একটি ছাড়া স্বচ্ছতা নিশ্চিতের কাজ ভালোভাবেই হয়েছে।

‘বাইরের দেশে সাধারণত একটি কনফার্মিং ক্লজ থাকে যেখানে জানতে চাওয়া হয় আপনার কোনো অপরাধ সংশ্লিষ্টতা আছে কি না। যদি সেখানে আবেদনকারী 'না' লেখেন এবং পরবর্তীতে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয় তখন তার নিয়োগ বা আবেদন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে এই কনফার্মিং ক্লজ থাকলেও তা সেভাবে স্বীকৃত না। যে কারণে শত বছরের পুরোনো এই পুলিশ ভেরিফিকশন পদ্ধতিটি থেকে গেছে,’ বলছিলেন মি. রসুল।

তবে এই পদ্ধতি বাতিলের পক্ষে-বিপক্ষে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

r1 ad
r1 ad