শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে জনসম্মুখে বিচার করা উচিত : ড. ইউনূস
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের এক বার্তা সংস্থাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ন্যায় বিচারের জন্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন।
‘হ্যাঁ, তাঁকে (শেখ হাসিনা) ফিরিয়ে আনতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশের মানুষ শান্তিতে থাকবে না। তিনি যে ধরনের নৃশংসতা চালিয়েছেন, জনসম্মুখে তার বিচার হওয়া উচিত,’ ড. ইউনুস ভারতীয় বার্তা সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়াকে (পিটিআই) দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন।
তবে তাঁর সরকার শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য দিল্লিকে অনুরোধ করবে কি না, সে ব্যাপারে তিনি নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) পিটিআই নিউজের ওয়েবসাইটে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হয়।
সরকারবিরোধী নজিরবিহীন বিক্ষোভের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে যান শেখ হাসিনা। প্রায় ৪ সপ্তাহ ধরে ভারতে তাঁর উপস্থিতি বাংলাদেশে জল্পনা-কল্পনাকে উসকে দিচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে কেউই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না, কারণ ‘আমরা তাঁকে বিচারের জন্য আবার ফিরিয়ে আনতে চাই।’
‘তিনি ভারতে আছেন এবং মাঝে মাঝে কথা বলছেন, যা সমস্যার তৈরি করছে। তিনি যদি চুপ থাকতেন, তাহলে আমরা (বিষয়টি) ভুলে যেতাম; লোকজনও ভুলে যেতেন; কারণ তিনি নিজের জগতে থাকতেন। কিন্তু ভারতে বসে তিনি কথাবার্তা বলছেন ও নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন। কেউ এটা পছন্দ করছেন না,’ তিনি বলেন।
হাসিনার ‘চুপ থাকা উচিত’
ড. ইউনূস অভিযোগ করেন যে, শেখ হাসিনা ভারতে থেকে ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ দিচ্ছেন, যেটাকে তিনি ‘অবন্ধুত্বসুলভ ইঙ্গিত’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ঢাকা প্রত্যর্পণের অনুরোধ না করা পর্যন্ত উভয় দেশের অস্বস্তি এড়াতে হাসিনাকে নিরব থাকতে হবে।
‘বাংলাদেশ তাঁকে (শেখ হাসিনা) ফেরত না চাওয়া পর্যন্ত যদি ভারত তাঁকে রাখতে চায়, তবে শর্ত হলো তাঁকে চুপ থাকতে হবে,’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন। বাংলাদেশ ভারতকে তার অবস্থান জানিয়েছে কি না জানতে চাইলে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘মৌখিক ও বেশ দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছে, তার চুপ থাকা উচিত।’
‘সবাই এটা বোঝে। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছি, তাঁর চুপ থাকা উচিত। এটি আমাদের প্রতি একটি অবন্ধুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত। তাঁকে সেখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং তিনি সেখান থেকে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এমন নয় যে, তিনি স্বাভাবিক নিয়মেই সেখানে গিয়েছেন। গণঅভ্যুত্থান ও গণরোষের মুখে তিনি পালিয়ে গেছেন,’ ড. ইউনূস বলেন।
শেখ হাসিনা ভারত থেকে কী ধরনের বিবৃতি দিয়েছেন, তা তিনি সুনির্দিষ্ট করে বলেন নি। তবে গত ১৩ অগাস্ট হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াযেদ তাঁর ফেসবুকে ১৫ অগাস্ট শোক দিবস পালন করার আহ্বান জানানো একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন যেটা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বলে দাবী করা হয়।
ড. ইউনূস ভারত থেকে শেখ হাসিনার "প্রচারণা" চালানোর যে অভিযোগ সাক্ষাৎকারে তোলেন, সে ব্যাপারে কোন প্রমাণ দিয়েছিলেন কি না, সেটা সাক্ষাৎকার থেকে পরিষ্কার না।
তবে ১১ অগাস্ট ভারত এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়, যেখানে শেখ হাসিনা তাঁর পতনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন। কিন্তু সেদিনই, সজীব ওয়াজেদ তাঁর ফেসবুকে এক পোস্টে বলেন এই বিবৃতি তাঁর মা'র নয়। তিনি প্রকাশিত বিবৃতিকে "মিথ্যা ও বানোয়াট" বলে অভিহিত করেন।
শুধু আওয়ামী লীগ কেন?
সরকারি বাসভবনে পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ ইউনূস জোর দিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ যখন ভারতের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ককে মূল্য দেয়, তেমনি নয়াদিল্লিকেও অবশ্যই আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দলকে ইসলামপন্থী হিসেবে চিত্রিত করা এবং শেখ হাসিনা ছাড়া দেশ আফগানিস্তানে পরিণত হবে এমন বক্তব্য পরিহার করতে হবে।’
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের ইচ্ছা প্রকাশ করলেও জোর দিয়ে বলেন, দিল্লিকে অবশ্যই এই বক্তব্য পরিত্যাগ করতে হবে যে, কেবল হাসিনার নেতৃত্বই দেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।
‘ভারতকে এই আখ্যান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যে, সবাই ইসলামপন্থী। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ইসলামপন্থী, আর বাকি সবাই ইসলামপন্থী এবং তারা এই দেশকে আফগানিস্তান বানাবে। আর শেখ হাসিনার কাছেই বাংলাদেশ নিরাপদ। ভারত এই গল্পে মুগ্ধ। ভারতকে এই আখ্যান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্য যেকোনো দেশের মতো বাংলাদেশও আরেকটি প্রতিবেশী,’ তিনি বলেন।
সম্প্রতি দেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত হামলার ঘটনা এবং ভারত এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, এটি একটি অজুহাত মাত্র। তিনি বলেন, সংখ্যালঘুদের অবস্থা এত বড় আকারে তুলে ধরার চেষ্টা একটা অজুহাত মাত্র।
ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক এখন তলানিতে’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে আশা প্রকাশ করেছিলেন যে সহিংসতাপূর্ণ বাংলাদেশের পরিস্থিতি শিগগিরই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। তিনি বলেছিলেন, ভারত প্রতিবেশী দেশের হিন্দু ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
বর্তমান উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নে ভারত ও বাংলাদেশকে একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন ৮৪ বছর বয়সী ড. ইউনূস। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, উভয় দেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে এবং এটি বর্তমানে নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এই সম্পর্কের উন্নয়নে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যা এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে।’ ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ট্রানজিট ও আদানি চুক্তির মতো কিছু চুক্তি পুনর্বিবেচনার দাবি রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সবাই বলছে এটা দরকার। আমরা দেখব কাগজে-কলমে কী আছে এবং দ্বিতীয়ত, বাস্তবে কী ঘটছে। আমি এর নির্দিষ্ট উত্তর দিতে পারব না। রিভিউয়ের প্রয়োজন হলে আমরা প্রশ্ন তুলব।’