top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

সাক্ষাৎকার

তাজউদ্দীনকন্যা শারমিন আহমদের দৃষ্টিতে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব

তাজউদ্দীনকন্যা শারমিন আহমদের দৃষ্টিতে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব
শারমিন আহমদ

শারমিন আহমদ লেখক ও গবেষক। তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা। তার মায়ের নাম সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। মহান বিজয় দিবসকে সামনে রেখে সম্প্রতি তিনি মুুক্তিযুদ্ধ, জুলাই বিপ্লবসহ তার নানা কর্মউদ্যোগের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) মুখোমুখি হন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন সংস্থার বাংলা বিভাগের উপ-প্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আয়েশা পারভীন।

প্রশ্ন: সাম্প্রতিক জুলাই অভ্যুত্থানকে আপনি ‘জনঅভ্যুত্থান’ এবং মুক্তিযুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ’ বলছেন, কেন?

উত্তর: ৩৬ জুলাইকে জনঅভ্যুত্থান আবার জনবিপ্লবও মনে করছি। দুটোরই সমন্বয় ঘটেছে। ছাত্র-জনতার জনঅভ্যুত্থান বা মাস আপরাইজিংটা হয়েছে একটা নির্মম স্বৈরাচারী সিস্টেমের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে। যদি জনগণকে দমন-পীড়ন করা স্বৈরাচারী বাহিনী জিতে যেত তাহলে ঐ পরিবর্তনটা অভ্যুত্থানেই সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু এই গণ-অভ্যুত্থান, যার মধ্যে দিয়ে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে তা বিপ্লবের সূচনা ঘটায় এবং বিপ্লবের প্রথম ধাপে পৌঁছে যায়। কিন্তু বিপ্লবটা তখনই সফল ও সম্পূর্ণ হয় যখন অভ্যুত্থান পরবর্তী যে সরকারটা আসে সেটা জনগণের আশা আকাঙক্ষার প্রতিফলক হয় এবং রাষ্ট্র কাঠামোয় বিরাট বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা যায়, সেটা কিন্তু অনেক সময় সাপেক্ষ এবং তার বাস্তবায়ন নির্ভর করে সঠিক নেতৃত্বের ওপর।

ইতিহাসে দেখা যায়, জনবিপ্লব সাধারণত হয় আর্মড রেভ্যুলুশনের মাধ্যমে যেখানে অস্ত্র বিদ্যায়, অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত বাহিনী থাকে এবং একটা রাজনৈতিক সেন্ট্রাল লিডারশীপ থাকে, যেমন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বা রুশ বিপ্লবের সময়।

কিন্তু আবার দেখা গেছে যে, বিশ্বের অনেক জায়গায় যেমন পর্তুগালে, ফিলিপিনে, তিউনিশিয়ায়, মিশরে এসব জায়গায় জনবিপ্লব হয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে। জনগণ অস্ত্র ধরেনি কিন্তু স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে।

সেটার সাথে বাংলাদেশের ২০২৪ এর শান্তিপূর্ণ জনবিপ্লবের কিছু চরিত্র মিলে যায়। এ কারণে এটাকে আমি জনবিপ্লবও মনে করছি। ছাত্র-জনতারা নিরস্ত্রই ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র তার পুলিশ বাহিনীকে অবৈধভাবে ব্যবহার করেছে তাদেরই জনগণের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই বিপ্লবীরা প্রশিক্ষিত ছিল না এবং কোনো সেন্ট্রাল লিডারশীপও তাদের পরিচালিত করেনি। এটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান। কিন্তু তারা জীবন দিতে ভয় পায়নি। তারা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। এর ফলে স্বৈরাচার ব্যবস্থার এমন পতন ঘটেছে, এটা বৈপ্লবিক। গত ১৬ বছরে অনেক রাজনৈতিক দল অনেক কথা বলেছে, কিন্তু আমরা দেখিনি এ রকম কোন বিপ্লব তারা ঘটাতে পেরেছেন যা আমরা দেখলাম এই জুলাই-আগস্টে। সাধারণ জনগণ কিন্তু ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়াল। তাদের বিশ্বাস করল। তরুণদের ওপর ভরসা রাখল। এটা কিন্তু নোটিস করার মতো একটা বিষয়। এদের অধিকাংশই কিন্তু নির্দলীয়।

সমার্থক এ অর্থে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময়েও মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল একটা নির্মম জনবিরোধী, অত্যাচারী ও স্বৈর-সামরিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের সরকার কায়েম করা। এটা জনযুদ্ধ এ কারণে যে, এখানে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, সামরিক, বেসামরিক সকলেই এ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে এক লাখ এক হাজার প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু বাকি যে সাড়ে সাত কোটি মানুষ তারাও তো ছিলেন যোদ্ধা। যে নারী ডাল-ভাত রান্না করে, আঁচলে সেই খাবার লুকিয়ে, খান সেনাদের চোখ এড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছেন তিনিও তো একজন জনযোদ্ধা। যে বাবা, যে মা, তার একমাত্র ছেলেকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন দেশ স্বাধীন করার জন্যে তিনিও তো জনযোদ্ধা। এভাবে সারা দেশের মানুষইতো আত্মিক দিক দিয়ে কখনও খাদ্য জুগিয়ে, ওষুধ জুগিয়ে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছিলেন। এ জন্যে এটা জনযুদ্ধ।

তবে ২০২৪ এর জনবিপ্লবের সাথে এর পার্থক্যটা হলো ১৯৭১ এর ওই যুদ্ধটা ছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ যা জাতির জীবনে একবারই ঘটে। স্বাধীনতার যুদ্ধ হলো আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরাধীন বা ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে নতুন রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করা। একটি রাষ্ট্র কাঠামো তৈরির জন্যে যে উপাদান দরকার জনগণ, ভূখণ্ড, সরকার, সার্বভৌমত্ব ও স্বীকৃতি এসব আমরা দেখি স্বাধীনতা যুদ্ধে। তার মানে স্বাধীনতা যুদ্ধের গর্ভ থেকে বাংলাদেশের সৃষ্টি। স্বাধীনতা যুদ্ধ না হলে আমরা বাংলাদেশ পেতাম না। এই যুদ্ধকে আমরা মুক্তিযুদ্ধও বলি কারণ দেশ স্বাধীন হবার পর নবজাত রাষ্ট্রে আপামর মানুষের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক মুক্তি মিলবে এই আকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বাসে জনগণ উদ্বুদ্ধ হয়েছিল।

আর ২০২৪ এসে যেটা হলো সেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যেই আরেকটা স্বৈরাচারী শাসক যারা এদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করছিলেন তার বিরুদ্ধে মানুষ লড়েছে। এ কারণে এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে।

আর মিল বা সাদৃশ্য হলো দুটোতেই জনগণ মনে করেছে আমরা আমাদের নাগরিক অধিকার হারাচ্ছি, ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধে জনগণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্যে দাঁড়িয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো ২০২৪ এসেও সেই একই বিষয়, সেই একই আকাঙ্ক্ষা। এভাবে দুটোই সমার্থক। মিলও আছে অমিলও আছে।

প্রশ্ন: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে আপনি কীভাবে দেখেন?

উত্তর: মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় অথবা মানুষ যখন একেবারে তলায় পড়ে যায়, তখন তার উপরে উঠতেই হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আর তো পেছাতে পারবে না, সামনে এগিয়ে যেতে হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে এবং মানুষের যখন আর হারাবার ভয় থাকে না তখন মানুষ মৃত্যুভয়কে অতিক্রম করে যায়, সে অবস্থাই ঘটেছে জুলাই বিপ্লবে। শতাব্দীতে একবার কিংবা দু’বার এরকম সময় আসে। আমাদের জীবনে এটা একবার এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়, আবার এসেছে এই গণ-অভ্যুত্থানের সময়। এই অদম্য স্পিরিটটা, এটা কিন্তু একটা পবিত্র স্পিরিট, যখন মানুষ তার সবচেয়ে প্রিয় জীবন, তাকে হারানোর ভয়টা অতিক্রম করে যায় তখনই কিন্তু ওই জাতি জেতে। এটা কিন্তু একটা বিরাট ব্যাপার। এই স্পিরিটটাকে আমাদের ধরে রাখতে হবে।

আমি এই স্পিরিটটাকে একটা অসীম সাহসিকতাপূর্ণ শক্তি হিসেবে দেখি। এটা মৃত্যুঞ্জয়ী ও সম্ভাবনার একটা স্পিরিট। জুলাই বিপ্লবের পরে শহীদদের স্মরণে ঢাকায় আমি অনেক সেমিনারে, সভায় অংশ নিয়েছি। সেখানে দেখেছি যারা শহীদ হয়েছেন তাদের অনেকেই বাবা মাকে লিখে রেখে আন্দোলনে গেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, আমি চলে যাচ্ছি। আমি শহিদ হলে প্রচার কর। সবাইকে বলো যেন সবাই অনুপ্রাণিত হয়। এর মানে সে শেয়ার করছে তার আত্মত্যাগটা। এর জন্যে সে প্রাউড ফিল করছে। তার মধ্যে একটা আশা, যে কারণে সে আত্মত্যাগ করেছে সেটা বাস্তবায়ন হবে। এ কারণে এ বিপ্লবকে আমি একটা আশার স্পিরিট, সম্ভাবনার স্পিরিট হিসেবেও দেখি। এটা একটা ভীষণ পবিত্র স্পিরিট। এটা নিষ্কলুষ। কারণ সকল দ্বেষ, হিংসা সবকিছুর ঊর্ধ্বে তারা একতাবদ্ধ হয়েছিল। পুরো জাতি, জনগণ একতাবদ্ধ হয়েছিল।

প্রশ্ন: জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়কে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

উত্তর: মাত্র তো চার মাস হলো নতুন সরকারের। চার মাস খুব অল্প সময় বলার জন্যে। তবে কিছু কিছু ইন্ডিকেটর তো পাওয়া যায়। এখনো সার্বিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। আরও বছরখানেক গেলে বলা যাবে। তবে কি মর্নিং শোজ দ্য ডে। আমি মনে করি না এই অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটটাকে ইফেক্টিভলি প্রতিফলিত করতে পারছে। এ বিপ্লবটা সফল হতো না এত শহীদের আত্মদান ছাড়া। আমাদের ২০ হাজারেরও উপরে মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। এর ফিফটি পার্সেন্ট দৃষ্টি হারিয়েছে। তাদের দৃষ্টির বিনিময়ে আমাদের নতুন দৃষ্টি দিয়েছে। একটা নতুন বাংলাদেশকে আমরা দেখতে পারছি। কিন্তু তাদের দেখভাল কি আমরা ঠিকমতো করতে পারছি? তারা হচ্ছেন আমাদের রাষ্ট্রের ভিভিআইপি। আহত ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসন দরকার। সরকার করছে, কিন্তু খুবই ধীর গতিতে। কিন্তু এখানে আমাদের খুব স্পিডে কাজ করতে হবে। জুলাই স্পিরিট নিয়ে আমাদের মন্ত্রণালয়গুলোকে কাজ করতে হবে।

বাজার অসহনীয় হয়ে আছে। বিপ্লব সফল হওয়ার প্রথম দুই সপ্তাহ কিন্তু বাজার সহনীয় ছিল। রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ছিল। সে সময়ে ছাত্ররা এসব নিয়ন্ত্রণ করেছিল। এই শিশু-কিশোররা যদি তা করতে পারে তাহলে আমাদের প্রশিক্ষিত রাষ্ট্রযন্ত্র, তারা কী করছে? যানজট, দ্রব্যমূল্য, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট এসব নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে পারছে না কেন? শিশু কিশোর, তরুণরা তো পেরেছে।

তবে একটি বিষয় ইতিবাচক যে, অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমবারের মতো ভারতের সাথে কথা বলেছে চোখে চোখ রেখে। সমতার ভিত্তিতে। এই স্পিরিটের সাথে ১৯৭১ সালের স্পিরিটের একটা মিল পাচ্ছি আমি। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার ১০ এপ্রিলের প্রথম বেতার ভাষণে এবং পরেও বারবার বলেছেন এবং কাজে প্রমাণ করেছেন ভারতসহ অন্য সকল রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক হবে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে।

প্রশ্ন: অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে সফল করতে কি করণীয় বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর: আসলে একটা ভিশন দরকার। ভিশনটা হলো আগামীর বাংলাদেশকে গড়তে হলে আমাদের শিক্ষা থেকে বিচার, আইন-কানুন সবখানে বিপ্লবের স্পিরিট প্রবাহিত করতে হবে যা হবে রক্ত শিরার মত, এটা ছড়িয়ে যাবে শাখা প্রশাখায়। বিপ্লবের স্পিরিটটাকে রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ সংগঠনেও ছড়িয়ে দিতে হবে। এ জন্যে বিপ্লবের স্পিরিট ধারন করে এ ধরনের মানুষ সিলেক্ট করতে হবে। এখানে বয়সটা বড়ো কথা নয়।

সিঙ্গাপুরের একটা উদাহরণ দেই, সিঙ্গাপুর যখন স্বাধীন হয়, ১৯৬৫ সালের দিকে তখন ওরা খুব গরিব। চারিদিকে দারিদ্র্য। শিশুরা তখন ছিল অভুক্ত। কিন্তু এখন কি সে কথা চিন্তা করা যায়? সিঙ্গাপুর কোথায় আজকে? স্বাধীনতার পর তাদের যে ভিশন ছিল তাতে তিনটা জিনিস ছিল। মেধা, প্রায়োগিকতা বা বাস্তববাদী চিন্তা এবং সততা।

আমাদের বিপ্লবের দর্শনটাকেও প্রত্যেকটা জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে সেরকম নেতৃত্ব দরকার। আর এ নেতৃত্ব এমনি এমনি গড়ে ওঠে না। যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাজউদ্দীন আহমদ, নজরুল ইসলামের হাতে যখন নেতৃত্বটা পড়ে, তখন উনারা কিন্তু রেডি ছিলেন। তাজউদ্দিন আহমদের জীবনী যদি পড়েন তাহলে দেখবেন ছোটবেলা থেকেই তিনি নিজেকে তিলতিল করে তৈরি করেছেন শিক্ষা-দীক্ষায়, মেধা-মননে, সততায় ও মমতায়, অনেকটা সাধকের মতোই।

তাই এ বিপ্লবকে সফল করতে হলে বিপ্লবের স্পিরিট যারা ধারণ করছেন তাদেরকেই নিয়ে আসতে হবে। বিপ্লবের চেতনা প্রবাহিত করতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এটা কোনো সাধারণ সরকার নয় যে, কেবল তাদের কাজ দাপ্তরিক কাজে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।

প্রশ্ন: আপনার লেখা ‘তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা’ বইটি বেশ সাড়া জাগিয়েছে। প্রকাশকাল বিবেচনায় একে কি আপনি দুঃসাহসিক কাজ বলে মনে করেন? যদি তাই হয়, তাহলে কোন অনুপ্রেরণা এর পেছনে কাজ করেছে?

উত্তর: এটা লেখার একটা তাগাদা ছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধটা অনেক বড়। এটা কোনো নেগোশিয়েটেড বিষয় ছিল না। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ একটা নেগোশিয়েটেড বিষয়। বৃটিশদের সাথে নেগোশিয়েনের মাধ্যমে এ বন্দোবস্তটা হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আইনগত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধটা ছিল একটা আপোসহীন সংগ্রাম। এর মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন সম্পর্কে বলতে গেলে বাচ্চারা কিছুই জানে না। যেমন ৩০ মার্চ ১৯৭১, এ দিনটি আমাদের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকার কথা। ওইদিন তাজউদ্দীন আহমদ বিপ্লবী সরকার গঠন করা এবং এ সরকারের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কথা ভেবেছিলেন। এটা খুব দূরদর্শী চিন্তা ছিল। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের কথাও তেমনভাবে প্রচার হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক চিত্র বাচ্চাদের কাছে তুলে ধরা হয়নি। এই যুদ্ধ যে সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বের একটা অভূতপূর্ব মিলন তাও কিন্তু সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি। এসব বিবেচনায় বইটির কাজে আমি হাত দেই।

আমার মা খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি নিজেও আমাকে বহু তথ্য দিয়েছিলেন। কিন্তু বইটির প্রকাশ উনি দেখে যেতে পারেননি। ১৯১৩ সালের মার্চ ঐতিহ্য প্রকাশনী ঘোষণা করেছিল বইটি বাজারে আসছে। সে বছর ডিসেম্বরে মা মারা গেলেন। বইটি প্রকাশিত হলো ২০১৪ সালে। তখন অনেকেই একে দুঃসাহসিক কাজ বলেছেন। কারণ সে সময়ে যিনি ক্ষমতায় ছিলেন মানে শেখ হাসিনার জন্যে তা ছিল খুবই অস্বস্তিকর। কারণ আমার বইটা তাদের প্রচারিত ন্যারেটিভটাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। কিন্তু আমি পিছু হটিনি। নেলসন ম্যান্ডেলার একটা কথায় আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। সেটা হলো, ‘ভালো কাজ করার সময় এখনই, সত্য বলার সময় এখনই।’ এ ছাড়া মধ্যযুগের সাধক ব্রুনোর কথাও মাথায় ছিল। যাকে সত্য বলার জন্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বেঁচে রইলেন ঐ সত্যের মধ্যেই। তবে বইটি ছাপা হওয়ার পরে আমাকে অনেক হেনস্তার শিকার হতে হয়েছিল। এনএসআইয়ের অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল। তবু আমি বইটি নিয়ে কথা বলা বন্ধ করিনি।

প্রশ্ন: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের বিষয়টিকে একজন মুক্তিযোদ্ধার কন্যা হিসেবে আপনি কীভাবে দেখেন? এর কি ধরনের প্রভাব মুক্তিযুদ্ধের ওপর পড়েছিল বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর: উনি (শেখ মুজিব) আমার বাবা ও অন্য সতীর্থদের সাথে আত্মগোপনে যাবেন ওটাইতো আলোচনা করে ঠিক হয়েছিল। এটা আমার একার ভাবনা না, জাতি যদি ইতিহাসটা জানে তারাও তো খুব আশ্চর্য হবে। ধরুন আপনি একজন দলের বা সংগঠনের প্রধান। আপনি ঠিক করলেন, আমরা সবাই মিলে এ কাজটা করব। তারপর হঠাৎ বললেন, আপনি এ কাজটি করবেন না। তোমরা যেভাবে পারো করে ফেলো। এতে নিশ্চয়ই দল কিংবা ওই সংগঠনের ওপর বিরাট একটা প্রতিক্রিয়া হবে। আর এটাতো দেশ, দেশের জনগণ, সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভাগ্যের কথা বলছি। এতে তো দেশের বড় ক্ষতি হলো।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ক্র্যাকডাউনের কথা অনেকেই জেনে গিয়েছিল। আমার বাবাও জানতেন ভয়াবহ এ ক্র্যাকডাউনের কথা। সেদিন রাতে আব্বু স্বাধীনতার ঘোষণায় শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাক্ষর আনতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়েছিলেন। কথা ছিল স্বাক্ষরের পর একজন ছাত্রকে (গোপন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যাকে সিলেক্ট করা হয়েছিল) দেওয়া হবে। যার দায়িত্ব ছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনালে সকল বিদেশি সাংবাদিকের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু শেখ মুজিব স্বাক্ষর না করায় তিনি মন খারাপ করে ফিরে আসেন। তিনি বললেন, ‘মুজিব ভাই আমাদের ২৩ বছরের সংগ্রাম নষ্ট করে দিলেন। তিনি স্বাক্ষরও করবেন না, বাড়ি ছেড়ে যাবেনও না।’ সে সময়ে আব্বু আরও বললেন, স্বাক্ষর করতে বলায় মুজিব ভাই বললেন, না এটা আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে থাকবে। আমাকে ট্রেইটার বলবে। কিন্তু তখন তো আমরা ট্রেইটার হওয়ার জন্যই রাজি। আমরা চলে যাচ্ছি স্বাধীনতার দিকে।

শেখ সাহেব এ কাজটি করে তার দীর্ঘদিনের সতীর্থদের ভয়াবহ বিপদের মুখে ঠেলে দিলেন। আমার বাবা বলেছিলেন, ‘দেখুন মুজিব ভাই লেনিন, মাও সেতুং বিশ্বের যারাই স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা মূল নেতা এবং জনগণের সাথে ছিলেন। তারা তো সারেন্ডার করেননি। আপনি তো বলে দেননি আপনার পরে সেকেন্ড ম্যান, থার্ড ম্যান কে হবে?’ উনি তখন বললেন, ‘যাও যাও তোমরাই পারবা।’

উনি কোন নির্দেশনা দিয়ে যাননি। কেবল ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ বললেই তো হয়ে যায় না। আমরা তো পরে এর ভয়াবহতা দেখলাম। প্রবাসী সরকার গঠন তো একটা বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু এর বিরুদ্ধে লেগে গেল একটা ইয়াং ফোর্স। তারা মুজিব বাহিনী হিসেবে পরিচিত ছিল। তারা শেখ সাহেবের আস্থাভাজন ছিলেন। তাদেরকে তিনি গোপনে নির্দেশনা পাঠিয়েছেন। এতে বিরাট এক বিভাজন তৈরি হলো। শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে এই গ্রুপটির বিরোধিতা যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হলো। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপরও ব্রাশফায়ার করেছে। কিন্তু বিষয়গুলোকে গোপন রাখতে হলো। অন্যদিকে খন্দকার মোস্তাক গোপনে সিআইএ এবং পাকিস্তানের সাথে যোগসাজশ করছে। এক দিকে এই সব ভেতরের আত্মঘাতী ষড়যন্ত্র এবং বাইরের শত্রুদের মোকাবিলা ওই মুক্তিযুদ্ধের সরকারকেই করতে হয়েছে। শেখ সাহেব যদি থাকতেন মুক্তিযুদ্ধে তাহলে তো বিষয়গুলোকে ফেস করতে হতো না। এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে ওনার ইচ্ছাকৃত অনুপস্থিতির খেসারত জাতিকে দিতে হতো না।

প্রশ্ন: ‘তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা’ বইতে আপনি উল্লেখ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিব চেতনায় উপস্থিত থাকলেও শারীরিকভাবে না থাকায় এ বিষয়ে জানতে তিনি খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না, আপনার এ ভাবনার পেছনের কারণটা বলবেন?

উত্তর: উনি যে জানতে চাইলেন না, এটা কেবল আমার কথা না। মুক্তিযোদ্ধারাও এটা জানেন। মুক্তিযোদ্ধারা অধিকাংশই ছিলেন গ্রামের এবং সাধারণ পরিবারের। কিন্তু যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তাদের মনোজগতে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। দেশ মুক্ত করে তাদের ভেতরে একটা উচ্ছ্বাস ছিল নতুন দেশকে নিয়ে। তাজউদ্দীন আহমদ ন্যাশনাল মিলিশিয়া গঠনের মাধ্যমে তাদের কে এই নবজাত রাষ্ট্র গঠনের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু শেখ সাহেব এসে তা আর করতে দিলেন না। তিনি মুজিব বাহিনীকেই আপন মনে করলেন।

অথচ তারা অস্ত্র ধরেনি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি। জনযুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধাদের উনি সরিয়ে দিলেন। ওনাদের মূল্যায়নও করলেন না। ওনার ভাগ্নে শেখ মণির অনুগত মুজিব বাহিনী দিয়েই গড়লেন রক্ষী বাহিনী । যার ফল শুভ হয়নি।

আমার মনে হয় শেখ সাহেবের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। যেটা হলো আমি ছাড়াই দেশ স্বাধীন হয়ে গেল! আর মুক্তিযোদ্ধারা হলো তাজউদ্দীন, নজরুল ইসলামদের অনুগত। উনি এটাকে খুব সংকীর্ণ দৃষ্টিতে দেখলেন। এটার ফল তো ভালো হয়নি। উনি কখনও মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতে চাইতেন না। তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ অন্যরা ডিনারের আয়োজন করে তাকে শোনাতে চাইলেন যুদ্ধের ঘটনা। উনি ডিনারের আসরে ঘুমিয়ে পড়লেন। এটা যে কতো দুঃখের। এটা আমাদের ইতিহাসের নির্মম বিষয়। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখলাম শেখ পরিবার মুক্তিযুদ্ধ শব্দটিকে হাইজ্যাক করল। নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করল।

প্রশ্ন: সম্প্রতি আপনি এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে একটিমাত্র পিলারের ওপর দাঁড় করিয়েছে, এর মধ্য দিয়ে দলটি কি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছিল? আপনার মতামত জানতে চাই।

উত্তর: অবশ্যই না। দেখুন একটা বাড়ি মজবুত হয় অনেকগুলো পিলারের ওপর দাঁড় করালে। গণতন্ত্র কিন্তু বৈচিত্র্যময়। এখানে বহু মানুষের অবদান রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা যেমন দেখি এক ডলারের নোটে জর্জ ওয়াশিংটনের ছবি, পাঁচ ডলারে আব্রাহাম লিংকনের ছবি, দশ ডলারের নোটে আলেকজান্ডার হেমিলটনের ছবি, বিশ ডলারের নোটে দেখি জ্যাকসনের ছবি। এভাবেই সকলকে সম্মান জানানো হয়েছে। একটা পিলারের ওপর দাঁড় করালে হয়কি তখন জনগণ আর এটাকে নিজের মনে করে না, ওউন করে না। মনে করে এটা অন্য এক পরিবারের কাহিনী, একজনের কাহিনী। কিন্তু যখন আমরা সকলের কথা বলব, তখন মানুষ সেটাকে ওউন করবে। নিজের মনে করবে।

প্রশ্ন: কিছুদিন আগে আপনি দেশে থাকাকালে জুলাই বিপ্লবে আহতদের দেখতে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটেছেন, কোন দায় থেকে আপনি গেলেন? সে কি কেবলই মানবিক দায়?

উত্তর: আমি দেশে থাকাবস্থায় ২৬ দিনে পঙ্গু পুনর্বাসন কেন্দ্র সাভারের সিআরপিতে তিনবার গেছি। এটা কেবল মানবিক দায় নয়। আমরা তো তাদের কাছে ঋণী। গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আমরা তাদের কাছে দায়বদ্ধ। তাঁরা আমাদের করুণার পাত্র নন। এঁরা অসাধারণ মানুষ। আমার জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষদের একজন তারা। আমিই বরং সম্মানিত বোধ করেছি তাদের দেখা পেয়ে। যদিও আমরা এখনও তাদের যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি।

এ ছাড়া আমি অবাক হলাম, সারা বাংলাদেশে সিআরপি একমাত্র পঙ্গু পুনর্বাসন কেন্দ্র। যার ফলে তাদের ওপর অনেক চাপ। আমরা সিতারা ও জাগরণ সংগঠনের পক্ষ থেকে যতটুকু পারছি তাদের জন্যে করার চেষ্টা করছি। সবাই যদি এগিয়ে আসেন তাহলে তো তাদের সকলকে পুনর্বাসন করা সম্ভব। তাই আমার আহ্বান আপনারা যে যেখানে আছেন তাদের পাশে দাঁড়ান। আমরা আজ যে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি তা তাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের কারণে- এ কথা ভুললে চলবে না। এনারাই আমাদের সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি।

r1 ad
r1 ad