top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

অলাভজনক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে কর নেওয়া অযৌক্তিক

অলাভজনক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে কর নেওয়া অযৌক্তিক
আবদুল মান্নান চৌধুরী। ফাইল ছবি

বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য; তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতাও। তিনি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একমাত্র শিক্ষক; যিনি দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। প্রথমে প্রধান উপদেষ্টা ও তারপর উপাচার্য হিসেবে গত ২২ বছর ধরে তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনা করছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আয়কর দিতে হবে বলে আপিল বিভাগের আদেশ সম্পর্কে রাজনীতি ডটকমের মুখোমুখি হয়েছেন ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহরিয়ার শরীফ

রাজনীতি ডটকম: গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ডেন্টাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে ১৫ শতাংশ আয়কর দিতে হবে। আপনারা আপত্তি তুলছেন কেন?

আবদুল মান্নান চৌধুরী: কর দেওয়া নাগরিকের দায়িত্ব, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য কর দিতে হবে। এখানে আপত্তি করার কিছু নেই। তবে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলবো, জাতীয় রাজস্বা বোর্ড (এনবিআর) অযৌক্তিকভাবে এই কর আরোপ করেছিল। বকেয়াসহ সেই কর দিতে হলে অর্ধেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই খাতে সৃষ্টি হতে পারে অস্থিরতা।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নানা কারণে এমনিতেই ধুঁকছে। বিশেষ করে কোভিডের পর সংকট প্রকট হয়েছে। সেই সময়ে অনেকেই সঞ্চয় খরচ করতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের তহবিল শূন্য হয়েছে বা শূন্যের কাছাকাছি। তার ওপর যদি ২০০৭ সাল থেকে বকেয়া আয়কর দিতে হয়, সেটি হবে বড় ধরনের ধাক্কা।

আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা ২০২১ সাল থেকে আয়কর দিয়ে আসছি। কিন্তু ২০০৭ সাল থেকে যদি বকেয়া আয়কর দিতে হয়, তাহলে অনেকেরই প্রায় নিঃস্ব হওয়ার মতো অবস্থা হতে পারে। এটি মোটেও কাম্য নয়। এর ফলে উদ্যোক্তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের শিক্ষার্থীরা, যা বুঝতে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। তবে কীভাবে এবং কখন থেকে আয়কর দিতে হবে তা অবশ্য আপিল বিভাগের আদেশের পূর্ণাঙ্গ পাঠ প্রকাশের পর জানা যাবে।

রাজনীতি ডটকম : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর দেওয়ার আদেশের বিরুদ্ধে আপনারা মামলা করলেন কেন?

আবদুল মান্নান চৌধুরী: ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত অলাভজনক বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়কর দেওয়ার বিধান নেই; ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে এমন কোন বিধান নেই। কিন্তু যখন এনবিআর আয়কর দেওয়ার জন্য আদেশ জারি করল, আমরা সরকারের সঙ্গে নানাভাবে আলোচনা করলাম। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তারা বুঝতে চায়নি। এরপর আমরা আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হই এবং আপিল বিভাগের এই আদেশের আগ পর্যন্ত সবগুলো রায় আমাদের পক্ষেই এসেছে। আমার যতদূর মনে পড়ে মোট ৪৬টি মামলা হয়েছে এবং দীর্ঘ সময় ধরে এসব মামলা পরিচালনা করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনেক টাকা খরচ করতে হয়েছে। এ নিয়ে ছাত্ররা বিক্ষোভ করেছে, আদালতের রায় আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করলেও সরকারের সঙ্গে আমরা আলোচনা চালিয়ে যাব।

রাজনীতি ডটকম: এই পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা কী?

আবদুল মান্নান চৌধুরী: আমাদের চাওয়াটা খুবই পরিষ্কার। সেটি হল যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লাভজনকভাবে চালাতে চান এবং সেখানকার আয় থেকে ডিভিডেন্ড নিতে চান তারা তা নেবেন, আয়করও দেবেন। কিন্তু যারা ট্রাস্টের অধীনে অর্থাৎ অলাভজনকভাবে চালাবেন, তাদের ট্যাক্স দিতে হবে না। তারা এই আয় দিয়ে প্রতিষ্ঠানের উন্নতি করবেন। জমি কেনা, ভবন তৈরি করা, গবেষণাসহ শিক্ষার উন্নয়নে এই টাকা খরচ করবেন। এখানে ট্রাস্টের সংজ্ঞার মধ্যেও ঝামেলা আছে। আমরা সরকারকে এসব বিষয় বলেই যাব।

আপনি একদিকে বলবেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক, ট্রাস্টের অধীনে চলবে। আবার আয়করও দিতে বলবেন-এই স্ববিরোধিতা নিয়েই আমাদের আপত্তি। আমার মতে, আইন সংশোধন করে সরকার অপশন দিতে পারে। যারা ট্রাস্টের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে চায় তারা সেটি করুক। আবার যারা বাণিজ্যকভাবে চালাতে চায়, তারাও সেই সুযোগ নিতে পারে। এখানে অহেতুক জটিলতা সৃষ্টি করে রাখার মানে হয় না।

রাজনীতি ডটকম: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে নানা ধরনের সমালোচনা আছে, বিশেষ করে সেখানে শিক্ষার মান, টিউশন ফি, তহবিলের টাকা ব্যক্তিগত তহবিল হিসেবে ব্যবহার করা ইত্যাদি। এগুলো থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

আবদুল মান্নান চৌধুরী: আমি এসব অভিযোগ সামান্য হলেও স্বীকার করব। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহু ছেলে-মেয়ে আজ পড়াশোনা করছে। এখন দেশে অন্তত ১১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ৩ লাখের বেশি ছেলে-মেয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এতে দেশের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হ্রাস পেয়েছে। এই সাশ্রয়টুকু শিক্ষার অন্যখাত উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেয়ে অনেক ভালো করছে। এমনকি আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যেখানে পৃষ্ঠপোষকতা করার কথা সেখানে বরং হাত-পা বেঁধে নদীতে সাঁতার কাটতে বলা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলে রাখি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সরকার কিন্তু ন্যূনতম কোনও আর্থিক সহায়তা করে না। নিজের আয়ে বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি দিয়ে সবকিছু করতে হয়। তারপরও আমলাতান্ত্রিক খবরদারির কারণে অনেক সময় সুষ্ঠুভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চালানো কঠিন হয়ে পড়ে।

আমরা চাই আইনি বাধাসহ যেসব সমস্যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে, সেগুলোর দ্রুত সমাধান হোক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা উদ্যোক্তা তাদের প্রতি সরকার ও সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন হওয়া দরকার। যথাযথ মর্যাদা বা সম্মান না পেয়ে উদ্যোক্তাদের অনেকেই মনোকষ্টে ভোগেন। আর যদি কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল তছরুপ করে, অনিয়ম করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার দায় সবার ওপর পড়তে পারে না।

রাজনীতি ডটকম: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আয়কর দিলে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বাড়বে কি?

আবদুল মান্নান চৌধুরী: পত্রপত্রিকায় দেখলাম অ্যাটর্নি জেনারেল মহোদয় বলেছেন যে, শিক্ষার্থীদের ওপর করের ভার চাপানো যাবে না। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নিজের তহবিল থেকে তো এই কর দেবে না। এই করের টাকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই হোক অটোমেটিক্যালি শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের ওপর পড়বে। ফলে টিউশন ফি বাড়তে পারে, যা অনেক অভিভাবকের সাধ্যের বাইরে চলে যাবে।

তাছাড়া এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা আরও বাড়তে পারে। অনেকে মনে করবে বেশি টাকা দিয়ে দেশে না পড়ে বরং বিদেশে পড়াই শ্রেয়। তাছাড়া বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখাগুলোতে ভর্তির আগ্রহ তৈরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশের টাকা লভ্যাংশ আকারে কিন্তু বিদেশে চলে যাবে। এসব বিষয় সরকারকে ভেবে দেখতে হবে।

এই কর আরোপের কারণে সরকারের বছরে মোট আয় হতে পারে ৪৫ থেকে ৫০ কোটি টাকা। কারণ শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি-সহ অন্যান্য আয় থেকে সব পরিচালন ব্যয়, বেতন ইত্যাদি মেটানোর পর উদ্বৃত্ত অর্থের ওপর এই কর ধার্য হবে। এই টাকাটা অন্যভাবে ও সরকারি কোষাগারে আনা যায়। চোখ মেলে দেখলে ক্ষেত্র বা খাতগুলো চিহ্নিত হবে। এখনকার বাস্তবতায় এই অল্প টাকার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খাতে যেসব পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তার মূল্য কয়েক শ কোটি টাকা বলে আমি মনে করি।

রাজনীতি ডটকম: অভিজ্ঞতার আলোকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে কিছু বলবেন?

আবদুল মান্নান চৌধুরী: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা অনেক। অনেক সমালোচনা ও কিছু খারাপ কাজের মধ্যে প্রচুর ভালো কাজও হচ্ছে। বাংলাদেশে বিশ্বমানের কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় ব্যাপক আকারে ডিজিটালাইজেশন করা হচ্ছে। বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে তথ্য ও প্রযুক্তির মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার কোর্স কারিকুলাম দেখে আমাদের শিক্ষার্থীরা উপকৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা আসছে।

সরকারের উচিত এগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করা। সরকারের তো এই খাতে টাকা খরচ করতে হয় না। আইন-কানুনসহ কিছুটা দেখভাল করাটাই যথেষ্ট। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসির সক্ষমতা কম। তারপরও বুঝে বা না বুঝে তারা এটা করতে চান। ফলে অনেক ভালো কাজ বা উদ্যোগ তাদের কারণে আটকে যায়।

এখনকার বড় সংকট হচ্ছে, শিক্ষার্থী কমে যাওয়া। এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, আরও অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করতে চায় সরকার। অথচ এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে শিক্ষক কোথায় পাওয়া যাবে? একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠায় শিক্ষার্থী ভাগাভাগি হচ্ছে। তার ওপর বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলা হচ্ছে। কোভিড-পরবর্তী বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অনেক অভিভাবক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানকে দিতে পারছে না। আবার দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কিছুটা বেড়েছে। সব মিলিয়ে প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও এই খাত খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই।

রাজনীতি ডটকম: এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আবদুল মান্নান চৌধুরী: গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি পাঠকের কাছে তুলে ধরতে রাজনীতি ডটকমের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।

r1 ad
r1 ad