top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ— ভারতবর্ষের রাজনীতি-অর্থনীতিতে মুসলিমদের অবদান

মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ— ভারতবর্ষের রাজনীতি-অর্থনীতিতে মুসলিমদের অবদান
প্রচ্ছদের ছবিতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ ভারতের এক বৈঠকের ছবি। এই দলটি ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ছবি: সংগৃহীত

সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ভারতীয় রাজনীতির বিকাশসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে মুসলিমদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতা-পূর্ব যুগ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় পর্যন্ত, এবং বর্তমান রাজনীতিতেও তাদের অবদান ভারতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিস্তৃত। একইভাবে ভারতের অর্থনীতিতেও মুসলিমদের অবদান গভীর ও বহুমুখী।

এই লেখায় সংক্ষেপে ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতির ইতিহাসে মুসলিমদের অবদানের কিছু মূল দিক তুলে ধরা হলো।

রাজনীতিতে মুসলিমদের অবদান

স্বাধীনতা-পূর্ব যুগ: স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ

খিলাফত আন্দোলন (১৯১৯-১৯২৪): মওলানা মুহাম্মদ আলী ও মওলানা শওকত আলীর মতো ব্যক্তিত্বদের নেতৃত্বে মুসলিমরা খিলাফত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন, যা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ আন্দোলনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অস্থায়ী মৈত্রী গড়ে উঠেছিল।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস: মওলানা আবুল কালাম আজাদসহ একাধিক মুসলিম নেতা কংগ্রেসের বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন। আজাদ কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন তিনি।

অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা: ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রাথমিকভাবে মুসলিম রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। পরবর্তী সময়ে এটি একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়, যা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের দিকে পরিচালিত করে।

All-Indian-Muslim-Leage-Lahore-Session-27-02-2025

১৯৪০ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের লাহোর বৈঠকে তোলা ছবিতে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, এ কে ফজলুল হকসহ অন্য নেতারা। ছবি: সংগৃহীত

স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগ

ভারতীয় গণতন্ত্রে একীভূতকরণ: স্বাধীনতার পর ভারতীয় মুসলিমরা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামোতে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও আন্দোলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে চলেছে।

রাজনৈতিক দলে প্রতিনিধিত্ব: মুসলমানরা কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেসসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক দলে সক্রিয়। তারা মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও বিধায়ক হিসেবে নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

সংখ্যালঘু অধিকারের আন্দোলন: মুসলিম নেতা ও সংগঠনগুলো শিক্ষা, চাকরি ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের মতো ইস্যুতে সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার।

সমসাময়িক অবদান

রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব: সংসদ, রাজ্য বিধানসভা ও স্থানীয় সরকারে মুসলমানদের অংশগ্রহণ অব্যাহত রয়েছে।

সামাজিক ও শিক্ষামূলক আন্দোলন: শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে মুসলিম সংগঠনগুলো কাজ করছে।

ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচার: মুসলিম নেতারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বহুত্ববাদী সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন।

Greatest-Indian-Muslim-Leaders-27-02-2025

ভারতের তিন মুসলিম রাজনৈতিক নেতা: (বাঁ থেকে) মওলানা আবুল কালাম আজাদ, ড. জাকির হুসাইন ও এ পি জে আব্দুল কালাম। ছবি কোলাজ: রাজনীতি ডটকম

প্রখ্যাত মুসলিম রাজনৈতিক নেতা

মওলানা আবুল কালাম আজাদ: স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ও কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা হিসেবে তিনি ভারতের শিক্ষানীতির রূপরেখা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

ড. জাকির হুসাইন: তিনি ভারতের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি ও এই পদে অধিষ্ঠিত প্রথম মুসলিম। শিক্ষা ও ধর্মনিরপেক্ষতায় তার অবদান স্মরণীয়।

এ পি জে আব্দুল কালাম: মূলত একজন বিজ্ঞানী হলেও তিনি ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি ও জাতীয় গর্বের প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি।

ভারতীয় মুসলিমদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অভাব, সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলেও তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সমৃদ্ধির প্রচেষ্টা জাতীয় উন্নয়নে তাদের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন।

সার্বিকভাবে বলা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতিতে মুসলিমদের অবদান কোনোভাবেই উপেক্ষা করার মতো নয়। তাদের নেতৃত্ব, আন্দোলন ও অধিকার সংরক্ষণের সংগ্রাম ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে।

অর্থনীতিতে মুসলিমদের অবদান

মধ্যযুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ভারতের অর্থনীতিতে মুসলিমদের অবদান গভীর ও বহুমুখী, যা উদ্ভাবন, বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রকে গঠন করেছে। এখানে সংক্ষেপে তার একটি কাঠামোগত বিবরণ তুলে ধরা হলো।

মধ্যযুগ (দিল্লি সুলতানাত ও মুঘল আমল)

কৃষি উদ্ভাবন: পারসিয়ান চক্র (পানি উত্তোলন যন্ত্র) ও নতুন ফসলের (যেমন—জাফরান, ফল) প্রবর্তন, যা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করেছিল। মুঘল জাবৎ ব্যবস্থা ভূমি রাজস্বকে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করেছিল।

বাণিজ্য ও অবকাঠামো: কারাভানসরাই ও সড়ক ব্যবস্থা দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্যকে সহজ করেছিল। সুরাট ও কালিকটের মতো বন্দরগুলো ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কাপড়, মশলা ও নীল রপ্তানির কেন্দ্রে পরিণত হয়।

বঙ্গের মসলিন ও গুজরাটি সিল্ক বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে, যা ঔপনিবেশিক-পূর্ব ভারতের রপ্তানি আধিপত্যকে চালিত করেছিল।

নগরায়ন: দিল্লি, আগ্রা ও লাহরের মতো শহরগুলো বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হয়, যেখানে বাজার (মণ্ডি) ও বিশেষ কারুশিল্প গিল্ড ছিল।

আর্থিক ব্যবস্থা: হুন্ডি (বিনিময় পত্র) লেনদেনকে সহজ করেছিল, একটি প্রোটো-ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক গঠনে ভূমিকা রেখেছিল।

Adamjee-Hazi-Dawood-And-Adamjee-Jute-Mill-27-02-2025

(বাঁয়ে) আদমজী হাজি দাউদ ও (ডানে) তার পরিবারের গড়ে তোলা আদমজী জুট মিলস। বর্তমানে সেনাবাহিনীর অধীনে পরিচালিত আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজটিও তার অর্থায়নেই প্রতিষ্ঠিত হয়। ছবি: সংগৃহীত

ঔপনিবেশিক যুগ (১৮শ - ২০শ শতাব্দী)

শিল্প উদ্যোগ: ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শিল্প-পক্ষপাতিত্ব সত্ত্বেও আদমজি পরিবার (বঙ্গে পাট শিল্প) ও ওয়াজির সুলতানের (হায়দারাবাদে তামাক শিল্প) মতো মুসলিম শিল্পপতির আবির্ভাব ঘটে। মোরাদাবাদের ধাতুশিল্প ও কাশ্মীরি কার্পেটের মতো কারুশিল্প বৈশ্বিক চাহিদা ধরে রেখেছিল।

প্রতিরোধ ও বয়কট: স্বদেশি আন্দোলনের (১৯০৫) মতো সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে স্থানীয় শিল্পকে ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে শক্তিশালী করা হয়।

স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগ (১৯৪৭–বর্তমান)

করপোরেট নেতৃত্ব: আজিম প্রেমজি (উইপ্রো) ভারতের আইটি খাতকে বিপ্লবিত করেছেন। ইউসুফ হামিদ (সিপ্লা) বিশ্বব্যাপী ওষুধকে সাশ্রয়ী করেছেন।

ক্ষুদ্র শিল্প: চামড়া (উত্তর প্রদেশ), হস্তচালিত তাঁত (বারাণসী) ও চুড়ি উৎপাদনে (ফিরোজাবাদ) আধিপত্য। হায়দারাবাদের স্টার্টআপ ও বেঙ্গালুরুর প্রযুক্তি ইকোসিস্টেমে মুসলিম উদ্যোক্তাদের উত্থান ঘটছে।

সাংস্কৃতিক অর্থনীতি: এ আর রহমান ও শাহরুখ খানের মতো বলিউড আইকনরা বিনোদন শিল্পকে চালিত করছে। ইরফান পাঠানের মতো ক্রীড়া তারকারা ব্র্যান্ড এন্ডোর্সমেন্ট ও পর্যটনে অবদান রাখছেন।

Shahrukh-Khan-AR-Rahman-And-Irfan-Pathan-27-02-2025

শাহরুখ খান, এ আর রহমান ও ইরফান পাঠান। এমন অনেক মুসলিম ব্যক্তিত্বই ভারতের সংস্কৃতি ও ক্রীড়া জগতে প্রভাব রেখে চলেছেন। ছবি কোলাজ: রাজনীতি ডটকম

বৈশ্বিক সংযোগ

প্রবাসী আয়: উপসাগরীয় দেশে কর্মরত ভারতীয় মুসলমানরা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন (যেমন কেরলের অর্থনীতি)।

কারুশিল্প রপ্তানি: লখনউ চিকনকারি ও আজমির প্রিন্টের মতো হস্তশিল্প রপ্তানির মূল পণ্য হিসেবে টিকে আছে।

প্রাতিষ্ঠানিক অবদান

শিক্ষা ও সমাজসেবা: আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া দক্ষ পেশাদার তৈরি করছে। হামদর্দ ফাউন্ডেশনের মতো সংস্থা স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় সহায়তা করে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগ-পরবর্তী অভিবাসন ও আর্থসামাজিক বৈষম্য (সাচার কমিটি রিপোর্ট) সত্ত্বেও মুসলমানরা অনানুষ্ঠানিক খাত, প্রযুক্তি ও শিল্পে টিকে রয়েছে।

সার্বিক ভাবে বলা যায়, মধ্যযুগীয় কৃষি সংস্কার থেকে আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন পর্যন্ত মুসলমানরা ভারতের অর্থনৈতিক ক্যানভাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছেন, যা সহনশীলতা, বৈচিত্র্য ও বৈশ্বিক সংযোগকে এগিয়ে নিয়েছে। তাদের উত্তরাধিকার ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশেলে ভারতের উন্নয়নের গল্পকে সমৃদ্ধ করেছে।

লেখক: কোম্পানি সচিব, সিটি ব্যাংক পিএলসি

r1 ad
top ad image