ঐতিহ্যে, সংগ্রাম ও অর্জনে ৭৫ বছরেও অম্লান আওয়ামী লীগ
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ রাজনৈতিক দল। দলটি একদিকে যেমন অসাধারণ নেতৃত্ব ও জনআকাঙ্ক্ষার রাজনীতিচর্চার ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ, অপরদিকে তেমনি বাঙালি জাতির অনন্য সব অর্জনের গর্বিত অংশীদার।
এই রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরেই একদিন শোষণ আর বঞ্চনার অবসানে মুক্তিকামী বাঙালি স্বাধীকারের স্বপ্ন বুনেছিল। আর আজ বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতিটি সোপানে, বিশ্ব দরবারে বাঙালির মাথা উঁচু করা দাঁড়াবার প্রতিটি উপলক্ষ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম। তাই প্লাটিনাম জুবিলির এই মাহেন্দ্রক্ষণে খানিকটা পৌঢ়ত্বেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের মূল ধারার রাজনীতিতে পূর্বের সমলয়ে প্রাসঙ্গিক, সমান দাপুটে।
বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশার প্রাপ্তিতে রূপায়ণ, নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে গণতন্ত্রের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যাওয়া, আর্থসামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট দেশে রুপান্তর-প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অনিবার্যতা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকেলে ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগ নামে যে দলটির আত্মপ্রকাশ হয়েছিল, সেটিই আজকের আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ক্রমেই জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক একটি জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টি। আর এ দলটি সংগঠিত করা থেকে শুরু করে গৌরবময় উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত যিনি ছিলেন মূল চালিকাশক্তি, তিনি রাজনীতির কবি, ইতিহাসের কালজয়ী মহানায়ক, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের বাতিঘর আর মুক্তিপাগল বাঙালির আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল।
বাঙালি জাতির ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শুধু প্রাসঙ্গিকই নয় বরং অপরিহার্য। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের সৃষ্টি ও ধারাবাহিক সমৃদ্ধি একইসূত্রে গাঁথা।
পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ বঙ্গন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আবার বিপর্যয়ের মুখে পড়া বাংলাদেশকে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করেছেন বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও আদর্শের সুযোগ্য উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনা। এখানেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম। আধুনিক ও উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা একই বৃন্তে অবিচ্ছিন্ন সত্তা।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট একটুখানি ফিরে দেখাটা এখানে প্রাসঙ্গিক বটে। চল্লিশের দশকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে জনমুখিতার প্রশ্নে বিভক্তি দেখা দেয়। সে সময় ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আকরাম খাঁ এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী উদারপন্থী নেতারা সে সময় অবহেলিত হয়ে পড়েছিলেন। তখন তারা ঢাকার মোগলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠ কথা চিন্তা করছিলেন। কলকাতা থেকে এসে তখনকার তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সাথে যুক্ত হন।
তখন টাঙ্গাইলের একটি আসনের উপনির্বাচনে দুই দফায় মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দেয়া মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। শামসুল হকের নির্বাচনী ফলাফল নির্বাচন কমিশন অবৈধ ঘোষণা করলে তখন তারাও এসে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী উদারপন্থী নেতাদের সঙ্গে মিলে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করেন। মুসলীম লীগের নানা নিপীড়ন-নির্যাতন উপেক্ষা করে কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে তারা ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন কর্মী সম্মেলন আহ্বান করে। সেখানেই ২৩ জুন বিকালে প্রায় তিনশো প্রতিনিধির উপস্থিতিতে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি ও শামসুল হককে দলের সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
মাওলানা ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী সেই দলের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম সম্পাদক হয়েছিলেন তৎকালীন কারাবন্দী তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। কারণ ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য অস্তমিত হয়েছিল।
এই ২৩ জুনকেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতারা দলের আত্মপ্রকাশের দিন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠনের প্রেক্ষাপট বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন এভাবে, “কর্মী সম্মেলনের জন্য খুব তোড়জোড় চলছিল। আমরা জেলে বসে সে খবর পাই। ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে অফিস হয়েছে।....আমরা সম্মেলনের ফলাফল সম্বন্ধে খুবই চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলাম। আমার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল, আমার মত নেওয়ার জন্য। আমি খবর দিয়েছিলাম, আর মুসলীম লীগের পেছনে ঘুরে লাভ নেই। এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।....এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না।....আমাকে আরো জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব, না রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করা হলে তাতে যোগদান করবো? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি আর করবো না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।”
এ বিষয়ে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন, “সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হল জয়েন্ট সেক্রেটারি। খবরের কাগজে দেখলাম, আমার নামের পাশে লেখা আছে ‘নিরাপত্তা বন্দী’।”
বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী থেকে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পেছনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য নয়। তিনি ১৯৪৭ সালের শেষদিকে বঙ্গবন্ধু সতীর্থ-সহযোদ্ধাদের নিয়ে ১৫০, মোগলটুলিতে ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ সংগঠিত করেন ও ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ‘ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ বছরের ১১ মার্চ বঙ্গন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সফল ধর্মঘটের মাধ্যমে সূচিত হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ১৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে কারারুদ্ধ ও পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
বঙ্গবন্ধু সে দিন অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। সে সময় তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও বঞ্চণার বিরুদ্ধে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ জাগরণের একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে তিনি দূরদৃষ্টি দিয়ে আওয়ামী লীগ সৃষ্টিকে ভেবে রেখেছিলেন। নবসৃষ্ট আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পেয়ে একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ছাত্রলীগের নতুন ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করেন এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রসারে মনোনিবেশ করেন। ভাষার অধিকার আদায়ের দাবিতে নিয়মিত ছাত্রলীগ নেতাদের নির্দেশনা দেন তিনি। নিজের দূরদর্শী চিন্তা-চেতনা, মতাদর্শ আর অসাধারণ নেতৃত্বগুণে মাত্র অল্প বয়সেই আওয়ামী লীগের অপরিহার্য মুখ হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধু। তার কথায় মুগ্ধ হয়ে ১৯৫০ সালের ১৮ ও ১৯ মার্চ নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন অখন্ড বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পুরো পাকিস্তানজুড়ে একটি রাজনৈতিক আবহ সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর জোরালো উদ্যোগেই প্রাদেশিক দল থেকে পুরো পাকিস্তানের জাতীয় দলে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ।
১৯৫৩ সালে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং একজন বাঙালি নেতা হিসেবে তাঁর আবির্ভাব হয়। ১৯৫৪ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে ১৩ হাজার ভোটে পরাজিত করে বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত হন। এ সময় যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি আসনের ২২৩টিতে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ পায় ১৪৩টি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক তৎপরতায় সুস্পষ্ট ছিল তাঁর দূরদর্শী রাজনৈতিক সচেতনতা। ফলে আওয়ামী লীগকে তিনি মাটি ও মানুষের খুব কাছাকাছি নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলার মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তিনি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে নিয়ে আপোষহীন আন্দোলন গড়ে তোলেন।
১৯৫৫ সালের ২১ থেকে ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সব ধর্মের মানুষের অন্তর্ভুক্তি এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি প্রত্যাহার করে নাম রাখা হয় ‘আওয়ামী লীগ’। সাহসী এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫৬ সালে খান আতাউর রহমানের নেতৃত্বে প্রাদেশিক সরকারে মন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু যোগ দেন। মাত্র নয় মাস তিনি মন্ত্রী পদের দায়িত্ব পালনের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে বেগবান করা এবং সংগঠনকে আরো সুসংহত করার উদ্দেশ্যে ১৯৫৭ সালের ৩০ মে বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন এবং সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করেন। ১১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। একের পর এক মিথ্যা মামলায় কারাভোগ করে ১৯৬১ সালে হাইকোর্ট কর্তৃক আটকাদেশ অবৈধ ঘোষণা করার পর বঙ্গবন্ধু থেকে মুক্তি লাভ করেন। এ সময়ই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য উদ্যমী ছাত্র নেতৃবৃন্দদের নিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৬২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু লাহোরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে অন্যান্য বিরোধীদলকে সাথে নিয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এই অধিবেশনে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট থেকে আলাদা হয়ে আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ৬ থেকে ৮ মার্চ কাউন্সিল সভায় মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান যথাক্রমে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। দাঙ্গার পর বঙ্গবন্ধু তৎকালীন সেনাশাসক আইয়ুব বিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সম্মিলিত বিরোধী দল বা কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি গঠিত হয়। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ‘তথাকথিত’ আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তাঁকে এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় এবং পরবর্তীতে হাইকোর্টের আদেশে তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। প্রস্তাবিত ছয় দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। এই ছয় দফা বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির বীজ বুনে দেয়।
একই বছরের ১৮-২০ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে তখন তিনি সারা বাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন। এ সময় প্রায় তিন বছর বঙ্গবন্ধু কারা অন্তরীন ছিলেন। ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি আইয়ুব সরকার মোট ৩৫জন বাঙালির (রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা) বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে।
জেলে বন্দী থাকা অবস্থাতেই ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর উপর পুনরায় গ্রেফতার আদেশ জারি করা হয়। ভারতের সহায়তায় পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে ১ নম্বর আসামি করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী টানা গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকল বন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। একই বছর ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত আওয়ামী লীগের এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের নাম রাখেন ‘বাংলাদেশ’।
‘বাংলাদেশ’ নামটি সৃষ্টির নেপথ্যেও জাড়য়ে আছে আওয়ামী লীগ। এরপর ১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে ৩১৩ আসনের বিপরীতে ১৬৭ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৯৭০ এর নির্বাচন শুধু বাঙালি জাতির জন্য একটি টার্নিং পয়েন্টই ছিল না, আওয়ামী লীগের জন্যও ছিল একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তর না করা এবং তার পরিণতিতে অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধ শেষে দীর্ঘ শোষণ ও বঞ্চনার অবসানে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম, দূরদর্শী চেন্তা-চেতনা, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্যতা ও আপোষহীন নেতৃত্বে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়ায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জন্ম নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে সোনালী অর্জন।
স্বাধীনতার অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি প্রিয় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন বাঙালির মুক্তিদূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশে ফিরে সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে মনোযোগী হন জাতির পিতা। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে স্বাধীনতার দশ মাসের মধ্যেই প্রণয়ন করা হয় সংবিধান। জাতীয় ঐক্য ও শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে ঘোষণা করা হয় জাতীয় চার নীতি হিসেবে। সংবিধানে মানবতা, বৈষম্যহীনতা, অসাম্প্রদায়িকতাসহ জনগণের মৌলিক মানবাধিকারের বিষয়গুলোর প্রতিফলন হয়েছে।
চারটি মৌলিক নীতির এ সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছে যা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করেছে। তিনি চেয়েছিলেন দীর্ঘদিন ধরে শোষিত ও নিপীড়িত বাঙালি জাতিকে বিচারহীনতার দুঃসহ সংস্কৃতি থেকে মুক্তি দিতে, চেয়েছিলেন মানুষের মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দিতে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে অনেক অভ্যন্তরীণ দুর্বৃত্তায়ন এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দেশকে প্রায় গুছিয়ে আনতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু এর মধ্যেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এরপর স্বৈরশাসকদের হিংস্র থাবায় ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে সোনার বাংলা। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ।
১৫ আগস্টের কালরাতে বিদেশে থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে জীবনের মায়া উপেক্ষা করে দল ও দেশকে বাঁচাতে স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসেন তিনি।
স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির আগ্রাসনে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়া নিষিদ্ধই ছিল এই দেশে। নানা ষড়যন্ত্র ও প্রতিবন্ধকতা প্রতিহত করে আবার মূলধারার রাজনীতিতে ফেরা খুব একটা সহজ ছিলো না আওয়ামী লীগের জন্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ জনগণের ভেতর থেকে উঠে আসা একটি রাজনৈতিক শক্তি। জনগণ চেয়েছিল বলেই ফিনিক্স পাখির মতো আবার পুনর্জীবন হয় আওয়ামী লীগের।
১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দলের কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতির দায়িত্ব পান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। দায়িত্ব পাওয়ার পর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে নানা ষড়যন্ত্র ও নেতৃত্বের কোন্দলে বিভাজিত ও পর্যুদস্ত আওয়ামী লীগকে আবার সংগঠিত করে সদর্পে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনেন। স্বৈরাচারী বাহিনী ও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি সে সময় তার বিরেুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টানা ৯ বছর রাজপথে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এই ৯ বছরের মধ্যে প্রত্যেক বছরেই আটক ও বন্দি করা হয় তাঁকে। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পঞ্চম জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ তনয়া শেখ হাসিনা। এ সময় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চাপ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ। ফলে ফিরে আসে সংসদীয় গণতন্ত্র। সে সময় সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে দল হিসাবে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল অনবদ্য।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে বিএনপির একটি সাজানো নির্বাচনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলেন শেখ হাসিনা। এই আন্দোলনের মুখে ৩০ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয় এবং জুন মাসে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণতন্ত্রের মানসকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ২১ বছর পর আবার আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে পথ হারানো বাংলাদেশ সঠিক পথে চলতে শুরু করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যমতম সাফল্য হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী হয়েই দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত থাকা গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বণ্টনে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদন করে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেন তিনি। ১৯৯৮ সালের বন্যায় আওয়ামী লীগ সরকার দুই কোটি বন্যার্ত মানুষের কাছে বিনামূল্যে খাদ্য সহযোগিতা পৌঁছে দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে অনবদ্য নজির স্থাপন করে। তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে একসময় অভিহিত বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির জন্য জীবনের প্রায় ১৪টি বছর কারা অন্তরালে ছিলেন। আর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা স্বাধীন দেশে বাঙালির অধিকার আদায় ও গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য অন্তত ১৯ বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সুশীল সমাজের ছদ্মবেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে দেশের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর অপচেষ্টা শুরু হয়। মিথ্যা মামলায় ২০০৭ সালে তাঁকে জেলে নেয়ার পর ১৩টি মামলা সাজানো হয় তার নামে। সে সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর আইনজীবী হিসাবে তাঁর পক্ষে আইনি লড়াইয়ের সুযোগ হয়েছিল।
পরবর্তীতে তাঁর মুক্তির জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গণজোয়ার সৃষ্টি হওয়ায় জনগণের নেত্রীর জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তিত্বের সামনে কুচক্রীদের সব রকমের ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ২০০৮ সালের ১১ জুন তাঁকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তারা। জেল থেকে বের হয়ে গণমানুষের ভাগ্য বদলের জন্য ‘দিন বদলের সনদ’ ঘোষণা করেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও দুঃসাহসী নেতৃত্বে ভর করে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আয়োজিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একচেটিয়া জয় লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। জোটের মোট অর্জিত ২৬৭ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগই পায় ২৩০টি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ও রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করে ২০১৪ সালের নির্বাচনেও জয়লাভ করেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এ ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, অধিষ্ঠিত হয়েছে মর্যাদার আসনে। সর্বশেষ, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নিবাচনেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতহাসে সবচেয়ে সফলতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত দেড় দশকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও উদ্ভাবনী নেতৃত্বে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে তা অতীতের যেকোনো সরকারের চেয়ে বেশি।
সবচেয়ে বড় যে বিষয় সেটি হলো, গত ১৫ বছরে শুধু যে দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে তাই নয়, অদৃশ্য যে বড় উন্নয়নটি আমাদের হয়েছে, তা হলো আমাদের স্বপ্ন দেখার ও বাস্তবায়ন করার সাহস বেড়ে গেছে বহুগুণ। এ সময়ে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে, মানুষ আজ স্বপ্ন দেখে উন্নত জীবনের। স্বপ্ন দেখে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ, রাজধানীতে মেট্রোরেল চালু করা, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল চালু করা, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু করা, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন-আওয়ামী লীগ সরকারের এতোসব মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন নতুন করে সাহসের সঞ্চার করেছে আমাদের মধ্যে। আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরেই বাংলাদেশ একটি গতিশীল ও দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে বিশ্বে আবির্ভুত হয়েছে।
২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ বছরে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা কেমন ছিল, আর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে সেই চিত্র তুলে ধরা এখানে কিছুটা হলেও প্রাসঙ্গিক হবে। এ সময়ে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ ধশমিক ৭ শতাংশের বেশি, মাথাপিছু আয় ৫ গুণ বৃদ্ধি, বাজেটের আকার ১২ গুণ বৃদ্ধি, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ১৩ গুণ বৃদ্ধি, জিডিপি’র আকার ১২ গুণ বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ৩৬ গুণ বৃদ্ধি, রপ্তানি আয় ৫ গুণ বৃদ্ধি, বার্ষিক রেমিটেন্স ৬ গুণ বৃদ্ধি, বৈদেশিক বিনিয়োগ এফডিআই ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬ গুণ বৃদ্ধি, রপ্তানি আয় ৫ গুণ বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার ৪১ দশমিক ৫১ শতাংশ থেকে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে হ্রাস, অতি দারিদ্র্যের হার ৫ গুণ কমেছে, সুপেয় পানি ৫৫ শতাংশ থেকে ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৮ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগের হার ২৮ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশু মৃত্যুহার হাজারে ৮৪ থেকে কমে ২১ জন হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু হয়েছে ৭২ দশমিক ৮ বছর।
অর্থনীতির যেকোনো সূচকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০০৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে উৎকর্ষ সাধন হয়েছে। ২০০৯ সালের জিডিপির পরিমাণ ছিল মাত্র ১০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২৩ সালে জিডিপির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৩ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশ এখন ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বে পদার্পণের অপেক্ষায় আছে।
দেশের এই উন্নয়নকে টেকসই করা, জনগণের জীবনমান উন্নয়ন, বাংলাদেশকে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলা, উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, দারিদ্র্য হ্রাস, ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারগুলির ঘরবাড়ি ও জীবন- জীবিকার স্থায়ী ব্যবস্থা করা, যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের আজকের শিশু এবং তরুণদের সুশিক্ষিত করা, স্বাস্থ্যসেবর মানোন্নয়ন, একশো অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন কর্মক্ষেত্র খুঁজে বের করা, গ্রামের মানুষের জন্য নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা, রাস্তাঘাট অরও উন্নত করা, বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা টেকসই করে সকল মানুষের জীবনমান উন্নত করা আওয়ামী লীগ সরকারের নতুন মেয়াদের লক্ষ্য।
আগামী পাঁচ বছরে নদী, খাল, পুকুর, জলাধার খনন, ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন সৃষ্টি, উপকূলীয় অঞ্চলে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করে সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদী ভাঙ্গনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করাসহ দেশের জনগণকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সড়ক, রেল, নৌ, বিমান পথ ও সেবা উন্নত করে যোগাযোগ অবকাঠামো ব্যাপক উন্নত করতে হবে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, অধিক ফসল উৎপাদন, খাদ্য সংরক্ষণ, খাদ্য ও কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাত করা, দেশের চাহিদা পূরণ করা ও বিদেশে রপ্তানি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করা ও উপযুক্ত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যাপক বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এই লক্ষ্যে কৃষিপণ্য, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, প্রযুক্তি বিজ্ঞান, পরমাণু গবেষণা, অ্যারোস্পেস ও এভিয়েশন গবেষণা, সমুদ্র গবেষণা, জলবায়ু পরিবর্তন, গবেষণার জন্য ইনস্টিটিউশন ও গবেষণাগার তৈরির কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এ কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সত্যিকার অর্থেই অবিকল্প।
২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গণতান্ত্রিক ধারা ও স্থিতিশীলতা বজায় রেখে জনকল্যাণমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক দেশ বিনির্মাণের পথে জাতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে। ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার যে সুযোগ পাওয়া যাবে তা কার্যকর করা এবং যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই মোকাাবিলা করা সম্ভব হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নত-সমৃদ্ধ, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিকল্প নেই।
বর্ণাঢ্য ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত একটি রাজনৈতিক দল। এটি দিবালোকের সত্য ও স্পষ্ট। দলটি সদা-সর্বদা দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে বদ্ধপরিকর। রাজনৈতিক ইতিহাসে সমৃদ্ধ দলটি বিশ্বাস করে এ দেশের মালিক জনগণ। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে দলটি সব সময় একনিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে।
আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের ইতিহাস দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধিতে নিবেদনের ইতিহাস। গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষায়, সুসময়-দুঃসময়ে, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সদা সর্বদা জনগণকে সাথে নিয়ে প্রতিবন্ধকতা জয় করে দৃপ্ত প্রত্যয়ে এগিয়ে যাওয়াই আওয়ামী লীগের ধর্ম। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালি জাতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের নিরন্তর সংগ্রাম অদ্যাবধি চলমান রয়েছে। যে সংগ্রামের সূচনা সে সময়কার তরুণ নেতা, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। আর যা দৃঢ় প্রত্যয়ে চলমান রেখেছেন বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও আদর্শের সুযোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, বাঙালির অস্তিত্বের সংগ্রামে আর গৌরবময় সকল অর্জনে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অনিবার্যতা চির অম্লান হয়ে থাকবে।
প্লাটিনাম জুবিলিতে এই শুভ প্রত্যাশা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাঙালির চিরআকাঙ্ক্ষার একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে বেঁচে থাক শত-সহস্র বছর।
লেখক: শ ম রেজাউল করিম, এমপি, সাবেক মন্ত্রী; সভাপতি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।