এ তিমির কাটবে কবে!
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম। বলেছিলেন, সহজ কথা যায় না বলা সহজে। অতীব সত্য কথা।
আমিও কঠিনেরে ভালবাসি। সত্য আর কঠিন কথা উচ্চারণ করি সাহসের সাথে । কিন্তু তাতে লাভ তেমন হয় না। সত্য কথা বললে, লিখলে সে লেখা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশ হয় না। তাই মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়।
লেখক যদি সত্য না লেখে, সংবাদপত্র যদি সত্য প্রকাশে দ্বিধাহীন না হয় তাহলে কী করে দেশ এগোবে। আমরা তো যে তিমিরে আছি সেই তিমিরেই থেকে যাব।
যখন সরকারি চাকরিতে ছিলাম, ভাবতাম অবসরে গেলে দুহাত খুলে লিখব। তখন কত বাধার সম্মুখীন হয়েছি, কতবার আমাকে জবাবদিহি করতে হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা নিয়ে গল্প লেখায় ভাল পোস্টিং থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ১৫ আগস্ট নিয়ে কলাম লেখায় জবাবদিহি করতে হয়েছে। তখন দিন গুনতাম কবে অবসরে যাব, আর মন খুলে লিখব। অবসরে গেলাম, সাহস নিয়ে লিখি, তার কমই ছাপা হয়। আজকাল তাই লেখার স্পৃহা অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
তারপরও কিছু ঘটনা দেখলে মন উচাটন হয়ে ওঠে, আঙ্গুল নিসপিস করতে থাকে, মাথায় ড্রাম বাজতে থাকে । বলে, লেখ লেখ । তাই লিখতে বসতেই হয়।
এই যেমন আমাদের সাবেক আইজিপি সাহেব। এত সুন্দর তার চেহারা বেশভূষা, কথাবার্তা। সারাদেশের লোক তাকে চেনে। আর তিনি তো শুধু সাবেক আইজপি নন, তিনি ্যাবের ডিজি এবং পুলিশ কমিশনার ছিলেন। যাকে বলে ক্ষমতার একেবারে শীর্ষে। ভাবা যায়, কতটা সৌভাগ্যবান তিনি! পাঁচ পাঁচবার পুলিশ পদক পেয়েছেন, শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছেন। আমরা চোখ মেলে দেখেছি আর হাততালি দিয়েছি। মনে মনে ভেবেছি, কী যোগ্য মানুষ! যথার্থ সিলেকশন হয়েছে।
শুদ্ধাচার পুরস্কার তো দেয়া হয় প্রকৃত শুদ্ধাচারীকে। নিশ্চয়ই খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে তিনি চূড়ান্ত শুদ্ধাচারী, তাই এই পুরস্কার। আমরা আনন্দিত হয়েছি! আহা তিনি পুলিশের রোল মডেল। জুনিয়র পুলিশরা তাকে দেখে শিখবে, জানবে।
তার সম্পর্কে কথা বলা বা লেখাও তো একটা ধৃষ্টতার ব্যাপার। যেখানে সাধারণ একজন পুলিশ দেখলে মানুষ ভয় পায় সেখানে তিনি পুলিশের রাজাধিরাজ, মাথার মুকুট। সেই তিনিই কিনা সরকারি পাসপোর্ট না নিয়ে সাধারণ পাসপোর্টে বিদেশ ভ্রমণ করতেন! ভানুমতির খেল আর কাকে বলে!
বিমানবন্দরে গিজ গিজ করে পুলিশ । ইমিগ্রেশনের পুরোটাই তো পুলিশ। তিনি তাদের সবার কর্তা। দেশের ১৯ কোটি জনগণের অধিকাংশ তাকে চেনে। তিনি কী করে ইমিগ্রেশন পার হন, বিমানে ওঠেন, যান, ফেরেন, দিনের পর দিন বছরের পর বছর প্রাইভেট পাসপোর্টে? সেই পাসপোর্ট ইস্যু হয়, রিনিউ হয় আবার এমআরপিও হয় কীভাবে? তিনি তো লাল পাসপোর্ট পেতেন, সেটাও নেননি। ওই পোসপোর্ট তো মর্যাদার প্রতীক। সেটাও তিনি অক্লেশে ত্যাগ করলেন কোন বড় প্রাপ্তির আশায়?
পাসপোর্ট অফিস একবার নাকি ধরেছিল, সেটাও ম্যানেজ করলেন। কেন ম্যানেজ করলেন, এর পেছনে কারণ কী? যারা ম্যানেজ করে দিলেন তারাই বা কেন অনিয়মটা করলেন! এসব প্রশ্নের জবাব কে দেবে!
শোনা যাচ্ছে তিনি নামে-বেনামে অর্ধেক বাংলাদেশ কিনে ফেলেছেন। অজস্র ফ্লাট, প্লট, বিঘার পর বিঘা জমি, ব্যাংকে টাকা, শেয়ার বাজার, হোটেল সবই তার আছে, দেশে বিদেশে নামে বেনামে।
সরকারের এতো এতো মেশিনারি, এতগুলো গোয়েন্দা সংস্থা কেউ কিছু জানলো না বুঝলো না? এটা কীভাবে সম্ভব! যদি একজন সাধারণ লোক এটা করত বুঝতাম যে তাকে কেউ চেনে না, এমনটা হতে পারে। কিন্তু তিনি তো সুপারস্টার, সবার চেনা। তার প্রতিটি গতিবিধির উপর সবার নজর থাকে। তাহলে কীভাবে সম্ভব এটা?
আর তিনি চাকরিতে থাকা অবস্থায় কিছুই জানা গেল না। জানাজানি হলো অবসর নেবার পর । কেন? এখন শুনছি টাকা-পয়সা সব নাকি তুলে ফেলেছেন ব্যাংক থেকে। সম্পত্তিও অনেক বিক্রি করে দিয়েছেন। খবরটা তো প্রকাশ হয়েছে অনেক আগে । এত সময় তিনি পেলেন কেন? তার একাউন্ট কী সিজ করা হয়নি? শুনেছি দুদক তদন্ত করছে । তিনি হাজিরা না দিয়ে তারিখ বাড়াচ্ছেন। কতরকম কথা ভাসছে বাতাসে। তিনি এখন দেশেই নেই। তার বিদেশ যাত্রার ওপর কি নিষেধাজ্ঞা ছিল না? একবার শুনি তুরস্কে সেকেন্ড হোম, স্পেনে নাগরিকত্ব, আরও কত কি!
অথচ দেশের কত মানুষ যে হোমলেস তার কী কোন পরিসংখ্যান আছে? শোনা যাচ্ছে, এই সব জমি-জমার অধিকাংশ জবর দখল করে নেয়া। তিনি হিন্দু এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকের উপর বলপ্রয়োগ করে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করেছেন। হিন্দু খ্রিস্টান তো দূরের কথা, একজন মুসলিমকেও যদি তিনি শুধু একবার চোখ লাল করে বলেন , জমি দে, কার সাধ্য আছে যে দেবে না। আমরা কথায় কথায় অসাম্প্রদায়িক দেশ বলি। অথচ তিনি এভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করে তাদের নিঃস্ব করেছেন। এসব সম্পদ দেখাশোনা করার জন্য কতিপয় পুলিশকে নিয়ে একটা সিন্ডিকেট বানিয়েছিলেন তিনি। শোনা যায় নিম্ন বেতেনভূক পুলিশরা তার জমিজমা পরিচর্যা করত, তরমুজের চাষ করত।
খুবই অসহায় লাগে। এর আগে একজন পিকে হালদার পিপলস লিজিং- এর টাকা মেরে হাওয়া হয়ে গেল। কত মানুষ পথে বসে গেল। এখনও কপাল চাপড়াচ্ছে তারা। সে কিন্তু পাশের দেশে দিব্বি আছে। অথচ পাশের দেশে মেডিকেল ভিসা নিতে গেল সাফ বলে দেয় ‘স্ট্রেচারে করে হলেও রোগি আনতে হবে’। উনি গেলেন কী করে? যতদূর জানি তার বিদেশ যাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল।
তারপরও গেল, এবং দিব্বি আছে খেয়ে দেয়ে।
এদিকে আবার ছাগল-কাণ্ডে তোলপাড় দেশ। মতিউর সাহেব একা অভিযুক্ত নন। তাকে ধরে টান দিতে একের পর এক বেরোচ্ছে নানা ঘটনা। কোনও অঙ্কই কোটির নিচে নয়। যা শুনলে মাথা ঘোরে। তার স্ত্রী আবার বলেছেন, সব সাংবাদিককে কিনে ফেলেছেন।কী মারাত্মক কথা! সেভাবে সাংবাদিকদের প্রতিবাদ করতেও দেখলাম না!
এই ঘটনায় বাপ-ছেলে সম্পর্ক যায় যায়। টাকার কী অসামান্য শক্তি! সুমহান মাজেজা! এদিকে ছাগলটা পড়েছে মহাবিপদে। সাদেক এগ্রোতে তো অভিযান হলো। ছাগল বেচারা এখন কোথায়! কী সুন্দর হরিণের মতো চেহারা! তার কী দোষ! সে তো অবলা! ওর যেন কোন কষ্ট না হয়, ওর প্রতি যেন সুবিচার করা হয়, এই দাবি রাখছি। কিন্তু দাবি রাখব কার কাছে! সে কোথায়!
কিছু মানুষ লুটেপুটে খাচ্ছে। এতোকাল জানতাম ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়, টাকা পাচার হয়, সেদিন এক মহিলার গহনা ব্যাংকের লকার থেকে চুরি হলো। প্রায় দেড়শ ভরির উপরে, পরিবারের সবার গহনা। তিনি নাকি দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন! হাস্যকর! এখন শুনছি তার বিরুদ্ধে জিডি করা হয়েছে। লকারের গহনা চুরির জন্য তাকেই দায়ি করা হচ্ছে। তিনি নাকি ঠিকমতো লকার বন্ধ করেননি। যে মহিলা ২০০৬ সাল থেকে লকার পরিচালনা করছেন তিনি লকারের চাবি লাগাতে জানেন না এটা হয়! মরার উপর খাড়ার ঘা আর কাকে বলে!
ঝিনাইদহের তিন তিনবারের নির্বাচিত এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার খুন হয়েছেন কলকাতার একটা ফ্লাটে। এলাকায় তিনি জনদরদী নেতা বলে পরিচিত ছিলেন। সাধারণ জীবনযাপন করতেন , মোটর সাইকেলে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি খুন হবার পর জানা গেল সোনা চোরাচালানের জেরে এই খুন। একশ কোটি টাকার উপর সোনার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে তিনি খুন হয়েছেন। তার এক বন্ধু সোনার বার দুবাই থেকে আনতেন আর তিনি সেটা পাঠাতেন ভারতে। শেষ চালানে তিনি বন্ধুকে টাকা দেননি। সেই নিয়ে রেশারেশি। মীমাংসা করার জন্য বান্ধবীসহ কলকাতা গিয়েছিলেন, সেখানেই খুন হয়েছেন। সবই কিন্তু পত্রিকার খবর। তার পরিবার এসব কথা অস্বীকার করে বলেছে, জীবিত অবস্থায় কেন এসব বলা হয়নি। সাধারণ মানুষ বলছে তারা আগেই জানত। এমনকি একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেছেন, তিনি এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন।
এই যদি হয় অবস্থা আমরা কোথায় যাবো! ক্ষতির পর ক্ষতি, লোকসানের উপর লোকসান হচ্ছে তার তার চাপ এসে পড়ছে গরিব জনগণের উপর। বিদ্যুৎ পানি গ্যাসের বিল মেটাতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস। বার বার বিল বাড়ানো হচ্ছে। পানির বিল নাকি ১০ শতাংশ বাড়বে, বিদ্যুৎ বিল, গাস বিল তো বেড়েই চলেছে । বেড়েছে অকটেন পেট্রলের দাম। এসবের প্রভাব পড়ছে বাজারে। দ্রব্যমূল্য হুহু করে বাড়ছে। মধ্যবিত্ত গরিব হচ্ছে, গরিব হচ্ছে হতদরিদ্র আর হতদরিদ্র না খেয়ে মরছে।
অবসরভোগিদের জীবনে বড় অবলম্বন তাদের পেনশনের টাকা। সেই টাকাটা দিয়ে প্রায় সবাই সঞ্চয়পত্র কিনে রাখে। সেখান থেকে মাস মাস যা পায় তা দিয়ে কোনক্রমে চলে। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের উপর ট্যাক্স দিনের পর দিন বাড়ছে। প্রথমে সীমা বেধে দেয়া হলে। এখন টাকা যত বেশি হবে কর তত বেশি কাটা হবে। আগে একজন মানুষ সঞ্চয়পত্রের টাকা দিয়ে কোনক্রমে চলতে পারতেন, এখন পারেন না কারণ টাকা পান অনেক কম।
সেদিন দেখলাম দশ লাখ টাকার বেশি ব্যাংকে রাখলে বাড়তি টাকা দিতে হবে। টাকা তো ব্যাংককে এমনিতেই দিতে হয়, এখন আরও বেশি দিতে হবে। সঞ্চয়পত্র ক্রয়েও সীমাবদ্ধতা আসছে। মধ্যবিত্ত খেয়ে না খেয়ে টাকা দেবে, ট্যাক্স দেবে আর কিছু বড়লোক সেগুলো চুরি চামারি করবে, বিদেশে পাচার করবে, দেশের অবস্থা খারাপ করবে, অর্থনীতিতে ধস নামাবে। সরকার আরও কর চাপাবে জনগণের উপর । এই চক্র থেকে কী কোন রেহাই নেই? বৃদ্ধ বয়সে মানুষের অসুখ বেশি হয়। আগে যেখানে হেঁটে যেতে পারত সেখানে যানবাহন ছাড়া যেতে পারে না। নানাভাবেই তাদের খরচ বাড়ে। অথচ তাদের উপরই খাড়ার ঘা বেশি পড়ে।
এই যে ক্ষমতাধারী ব্যক্তিরা মহাসাগর চুরি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে সে অভিযোগের যথাযথ তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। তাদের সাহায্যকারীদেরও সনাক্ত করা প্রয়োজন। প্রয়োজন এদেশের সম্পদ উদ্ধার করা। জোরদার করা দরকার মনিটরিং, টাকা পাচার যাতে না হয় সেই ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। দেশবাসী কিন্তু সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে।
লেখক: কথাশিল্পী , গবেষক