top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

কিংস পার্টিতে হাফিজ-সাকিবের যুক্ততা নিয়ে সরগরম রাজনীতি

কিংস পার্টিতে হাফিজ-সাকিবের যুক্ততা নিয়ে সরগরম রাজনীতি
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতা হাফিজ উদ্দিন আহমেদের বাসায় গিয়ে কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিত বিএনএমে যোগ দেওয়ার ফরম পূরণ করেছিলেন সাকিব আল হাসান— সম্প্রতি এমন একটি ছবি রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। ছবি : সংগৃহীত

নির্বাচনের আগে দল বদলের কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঝিমিয়ে পড়া রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বিরোধী শিবিরে বিরাজ করছে হতাশা। রোজার মাস উপলক্ষে মাঠের রাজনীতিও নেই।

এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে যে, জনপ্রিয় অলরাউন্ডার ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান নির্বাচনের আগে ‘কিংস পার্টি’ খ্যাত বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্টের (বিএনএম) কো-চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এ-সংক্রান্ত একাধিক ছবি প্রকাশ পেয়েছে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। একইসঙ্গে বেরিয়ে এসেছে বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ সেই সময় দলটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

আরও জানা যাচ্ছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে তাদের একাধিক বৈঠকের খবর। যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘সাকিবের অন্য দলে যোগ দেওয়ার বিষয়টি তার জানা নেই।’

গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাকিব আল হাসান। সক্রিয় রাজনীতিতে পা রাখা নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই সাকিবকে নিয়ে বিতর্ক ছিলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মাঠের বাইরে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি বিশেষভাবে আলোচিত।

রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসায়ী হিসেবে হাতেখড়ি সাকিব আল হাসানের। এরপর দ্রুতই নিজের ব্যবসায়িক পরিমণ্ডল বিস্তৃত করেছেন তিনি। দেশের শেয়ারবাজার, বিদ্যুৎকেন্দ্র, প্রসাধনী, ট্রাভেল এজেন্সি, হোটেল, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, কাঁকড়া ও কুঁচের খামারসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ রয়েছে তার। খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আরাভ খানের দুবাইয়ে জুয়েলারি শো রুম উদ্বোধন করে সমালোচনার মুখে পড়েন এই ক্রিকেটার।

এদিকে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে ঘিরে বিএনপিতে অবিশ্বাস রয়েছে। গত নির্বাচনের আগে দলছুট হওয়ার খবর প্রকাশ হওয়ার পর তিনি তা অস্বীকার করে বিএনপির সঙ্গে আজীবন থাকার ঘোষণা দেন।

গতকাল মঙ্গলবার বিএনএম-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গেছেন বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। ওই দলে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়টি ছিল রাজনীতিতে অনেকটা ওপেন-সিক্রেট।

এদিকে সাকিব আল হাসানকে নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের রাজনৈতিক ম্যারপ্যাচে জবাব দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আওয়ামী লীগের দলীয় শর্ত পূরণ করেই সাকিব আল হাসান দলের মনোনয়ন পেয়েছেন জানালেও এ বিষয়ে বেশি কিছু জানেন না বলেও দাবি করেন তিনি।

হাফিজ ও সাকিবের কিংস পার্টিতে যোগদান করার বিষয়টি এখন রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে সাকিব আল হাসানের কর্মকাণ্ড নিয়েও। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দল পরিবর্তন করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকলেও এখন তা অস্বীকার করছেন বিএনপি নেতা হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। আর এ বিষয়ে মঙ্গলবার প্রকাশ্যে কথা বলেননি সাকিব আল হাসান।

তবে রাজনীতির যে নাজুক অবস্থা এবং কেনাবেচার যে রাজনীতি হচ্ছে সেখানে এমন বিতর্ক অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ।

রাজনীতি ডটকমকে তিনি বলেন, ‘মেজর হাফিজের সঙ্গে সাকিবের কোনো ঝামেলা আছে কি না বা তাদের মধ্যে কোনো সমস্যা ছিলো কি না তা জানা নেই। সাকিব আল হাসানের কথা উল্লেখ করেছেন মেজর হাফিজ। তাহলে সাকিব আল হাসান নির্বাচনের আগে বিএনএম থেকে নির্বাচন করতে চাইলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, সাকিব আসলে আওয়ামী লীগ করতেন কি না অথবা তার আওয়ামী লীগের সদস্য পদ ছিলো কি না?’

তিনি বলেন, ‘কাউকে দলের মনোনয়ন পেতে হলে আরপিওর ধারা অনুযায়ী কমপক্ষে তিন বছর ওই দলের সক্রিয় সদস্য থাকতে হয়। সেটি কি সাকিবের ছিল? যদি না থাকে তাহলে সাকিবের বিএনএমএর কাছে যাওয়া অপরাধ নয়। নতুন রাজনৈতিক দল থেকে নির্বাচনের মনোনয়ন নিতেই পারে। যদি আরপিওর ধারা মানা হয়, তাহলে বিএনএম থেকে মনোনয়ন নেয়া তার জন্য যথাযথ হতো না।

সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশে হরহামেশাই রাজনীতিসংক্রান্ত আইন-কানুনকে কেউ তোয়াক্কা করছেন না। তাদের ব্যক্তিগত কোনো সমস্যার কারণে এই ঘটনা সামনে আসলো কি না, সেটিও ভেবে দেখার বিষয়। তবে এটা সত্য যে, সাকিবের ভাবমূর্তি আবারও প্রশ্নের মুখে পড়ল।’

বিএনপি নেতা হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে জড়িয়ে এই আলোচনা-সমালোচনা সম্পর্কে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘একজন মানুষ তিনি নিজে বলছেন, তাকে নানাভাবে চাপ দেয়া হয়েছে একটা অপরাধ করার জন্য। তিনি সেটা সাহস দিয়ে মোকাবিলা করেছেন। এজন্য তাকে দোষারোপ না করে ধন্যবাদ জানানো দরকার। যারা এই কাজটা করেছেন তাদের চেহারা জনগণের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করতে হবে।’

এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সাকিব আওয়ামী লীগের টিকেটে মাগুরা থেকে ইলেকশন (নির্বাচন) করেছে, জয় লাভ করেছে। পার্টির কাছে নমিনেশন (মনোনয়ন) চাওয়ার সময় সে পার্টির সদস্য। তার আগে তো সাকিব আমাদের পার্টির কেউ ছিল না। নমিনেশন যখন নেয় তখন তাকে তো প্রাইমারি সদস্য পদ নিতে হয়। যে শর্ত পূরণ করা দরকার, সেটি সে করেছে। সেভাবেই আমরা মনোনয়ন দিয়েছি। সে এমপি হয়েছে নির্বাচনে। আমি এই বিষয়ে আর কিছু জানি না।’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার কিংস পার্টি তৈরি করেছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারি দল কিংস পার্টি করতে যাবে কেন? নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে অনেক ফুল ফোটে। কোনটা কিংস পার্টি, কোনটা প্রজা পার্টি। এটি (বিএনএম) সম্পর্কে আমার জানা নেই। এটার রেজিস্ট্রেশন করে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। কোন দল কে রিকগনিশন (প্রতিনিধিত্ব) করে এটা নির্বাচন কমিশনের বিষয়। এখানে আমাদের কিছু বলার নেই।’

এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের অপচেষ্টা এ সংবাদে লক্ষ্য করেছি। ৭৯ বছর বয়স... আমার জীবন খোলা বই... গত ৩২ বছর ধরে বিএনপিতে। ৪ মাস পর এমন সংবাদ অবমাননাকর, মানহানিকর। জাতীয়তাবাদের পরীক্ষিত সৈনিক হিসেবে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সার্ভিস দিতে চাই। নিজে খেলোয়াড় ছিলাম বলে ক্রীড়াবিদদের প্রতি দুর্বলতা আছে।’

তিনি বলেন, ‘অবসরপ্রাপ্ত দুজন সামরিক কর্মকর্তা বিএনএম গঠন করে, সাকিব আল হাসানকে আমার কাছে নিয়ে আসে। নির্বাচনের ৪-৫ মাস আগে আমার কাছ থেকে উৎসাহ না পেয়ে সাকিব চলে যায়। বিএনএম-এ যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, আমি যোগ দেইনি। এটি গোপন করার বিষয় না। সাকিব আমার কাছ থেকে উৎসাহ না পেয়ে, সহজে নির্বাচিত হতে নিজের পছন্দ বেছে নিয়েছে। বিএনএম-এর নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে কাউকে পাঠাইনি।’

হাফিজ উদ্দিন আহমদ প্রশ্ন করেন, ‘কী করেছি আমি? বিএনএমে যোগ দিয়েছি? দল ভেঙেছি?’ তিনি বলেন, ‘এটা তো পরিষ্কার যে তাকে নতুন দলে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনি সেটা গ্রহণ করেননি। এখন অপপ্রচার চালিয়ে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা চলছে।’

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ধরনের ‘কিংস পার্টি’ গঠনের ইতিহাস নতুন নয়। অতীতেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বলয়ের বাইরে গিয়ে ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় দল গঠন করে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন অনেকেই। কেউবা নিজে নেতৃত্ব গড়ার চেষ্টা করেছেন।

এটা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ড. কামাল হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল জলিল, মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপির নেতা আবু হেনাসহ অনেকেই দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন।

গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনএম-এ যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন বিএনপি নেতা শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা একরামুজ্জামান।

বিএনপির রাজনীতিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সাবেক কূটনীতিক শমসের মুবিন চৌধুরী ও তৈমূর আলম খন্দকার তৈরি করেন তৃণমূল বিএনপি। নির্বাচনে অংশ নিয়ে অধিকাংশ প্রার্থীর জামানাত হারায় দলটি।

দেশের রাজনীতিতে দুই বলয়ের বাইরে গিয়ে নির্বাচনকালীন নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান হতে দেখা যায়। কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বলয়েই রাজনীতি প্রবাহিত হতে দেখা যায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি থেকে বের হয়ে কোনও নেতা নিজের অবস্থান গড়তে পারেননি। কেউবা নিজ দলে ফিরে এসেছেন, কেউবা হারিয়ে গেছেন।

r1 ad
r1 ad